দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এখনো বন্যার আঘাতে বিপর্যন্ত মানুষ৷ এ ছাড়াও দ্রব্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লোডশেডিং, বিপর্যস্ত পরিবহণ এসবও রয়েছে৷ বাংলাদেশে এবারের ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ মুসলমানদের জন্য কতটুকু আনন্দের হবে?
বিজ্ঞাপন
নাজমুল হক ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন৷ এবার কোরবানির ঈদে পরিবার নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ গত দুই বছর ঈদে করোনার কারণে যেতে পারেননি৷ তাই এবার গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছেটা ছিলো প্রবল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি৷ ঢাকাতেই থেকে গিয়েছেন৷ তিনি জানান, আর্থিক সংকটই প্রধান কারণ৷ গ্রামে গেলে আসা যাওয়ার খরচসহ বাড়তি আরো অনেক খরচ আছে৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে হাতে বাড়তি কোনো টাকা তো নেইই, উল্টে ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে৷ তিনিঢাকাতে গরুর একভাগ কোরবানিদিচ্ছেন তাও বাজেট অনেক কাটছাঁট করে৷ আর ঢাকায় তেমন লোডশেডিং না হলেও গ্রামের অবস্থা খুবই খারাপ বলে জানান তিনি৷
তিনি বলেন, ‘‘ আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব যারা আছেন তাদের প্রায় সবারই একই অবস্থা৷ কেউ কেউ আর্থিক সংকটের কারণে কোরবানির চিন্তাই বাদ দিয়েছেন৷ আসলে মধ্যবিত্ত আছে চরম সংকটে৷ সে কাউকে বলতেও পারেনা৷ সইতেও পারেনা৷''
বাংলাদেশে মূল্যবৃদ্ধি গত আট বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছে৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোই এই হিসাব দিয়েছে৷ তারা বলছে এখন মূল্যবৃদ্ধি গড়ে শতকরা ৭.৪২ ভাগ৷ আর এটা শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণেই এই মূল্যবৃদ্ধি৷ তবে বাস্তবে এটা আরো বেশি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা৷ কিন্তু এই সময়ে সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি৷
করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ তার উপর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভোজ্য তেল এবং জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার প্রভাবও পড়েছে এখানে৷ কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)-এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘‘বিশ্ববাজারের চেয়ে এখানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার হার বেশি৷ কারণ ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেয় কোনো অজুহাত পেলেই৷ সরকারেরও কোনো মনিটরিং নেই৷''
‘‘ঈদের সেই আনন্দ আর আশা করা যায়না’’
ইএনডিপির কান্ট্রি ইকনোমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘এখন বেরো ধানের ভরা মৌসুম৷ বন্যার আগেই আমন উঠে গেছে৷ তাহলে তো চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই৷ কিন্তু তারপরও চালের দাম বাড়ছে৷''
দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়িত হওয়ার কথা কিছুদিন আগে বলা হলেও এখন লোডশেডিং শুরু হয়েছে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে এলপিজির দাম বেড়ে যাওয়ায় সব বিদ্যুৎ কারখানা চলানো যাচ্ছেনা বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে৷ আর দেশেও গ্যাসের ঘাটতি চলছে৷ এখন প্রতিদিন কমপক্ষে দুই হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে৷
সরকার বলছে, এই পরিস্থিতি কমপক্ষে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে৷ এই ঈদেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই৷ সারা দেশে এখন বিদ্যুতের রেশনিং চলছে৷ গড়ে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে৷ দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ব্যবসায়ি মিজানুর রহমান মিজু বলেন, ‘‘ শহরে কী অবস্থা জানিনা তবে আমাদের গ্রামের দিকে এখন দিনে চার থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকেনা৷''
ব্র্যাকের গত বছরের হিসেবে বাংলাদেশে করোনায় অতিরিক্ত নতুন করে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন৷ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে চলতি বছরে নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন আরো ২১ লাখ মানুষ৷ এই জরিপও ব্র্যাকের৷ দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে৷ এখন ৭০ ভাগ মানুষকেই তাদের আয়ের বড় অংশই খাদ্য কিনতে ব্যয় করতে হয়৷
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ অন্যান্য জেলার বন্যার পানি নামলেও তাদের আশ্রয় নষ্ট হয়েছে৷ সম্পদ ও ফসল হারিয়েছেন তারা৷ সিলেটের সাংবাদিক ওয়াসে খসরু জানান, ‘‘ওই অঞ্চলের অনেকেরই এবার ঈদ হবে আশ্রয় কেন্দ্রে৷ আর আগে যারা তিন-চারটি গরু কোরবানি দিতেন তারা একটি দিচ্ছেন৷ আর যারা ভাগে দিতেন তারা দিতে পারছেন না৷ গরুর হাটেও ক্রেতাদের তেমন ভিড় নেই৷ গরুও কম৷''
তবে তিনি জানান, দেশের অন্যান্য এলাকার বিত্তশালীরা কোরবানির গরু সিলেটের গরিব মানুষের জন্য পাঠাচ্ছেন৷ কিছু এনজিও সেখানে গরু কোরবানির ব্যবস্থা করছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাংস পাঠানো কঠিন৷ এখনো যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি৷
ক্যাব-এর এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘‘মানুষ এখন দারিদ্র্য আর দ্রব্যমূল্যের চাপে আছে৷ তার উপরে শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ সংকট৷ ঈদে যানবাহনের চিরাচরিত ভোগান্তি একটু কমেনি৷ ফলে ঈদের সেই আনন্দ আর আশা করা যায়না৷ আর সিলেট অঞ্চলের মানুষ তো চরম সংকটে আছেন৷''
দিল্লিতে কোরবানি ঈদ : চড়াদামে বিক্রি হচ্ছে খাসি, ভেড়া
দিল্লিতে জমজমাট ঈদের বাজার। জামে মসজিদের পাশে এসে গিয়েছেন পশু-ব্যবসায়ীরা। প্রচুর দামে বিক্রি হচ্ছে খাসি ও ভেড়া।
ছবি: Rouf Fida/DW
প্রচুর পশু
রোববার বকরিদ। তার আগে জমে উঠেছে জামে মসজিদের পাশে পশু-বাজার। তবে এবার দাম বেশ চড়া। খাসি ও ভেড়া বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ছয় লাখ টাকা দামে।
ছবি: Rouf Fida/DW
আকর্ষণ শেরু
এই ভেড়াটির নাম শেরু। শেরুর ওজন ১১০ কিলোগ্রাম। জামে মসজিদের পাশের পশু বাজারে অন্যতম আকর্ষণ হলো এই শেরু।
ছবি: Rouf Fida/DW
বিপুল দামে
বৃহস্পতিবার শেরু বিক্রি হয়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার টাকায়। গর্বিত বিক্রেতা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার এটাই ছিল সর্বোচ্চ দাম।
ছবি: Rouf Fida/DW
ছয় লাখের খাসি
এই খাসির দাম ছয় লাখ টাকা। বিক্রেতার বক্তব্য, এত দাম হওয়ার কারণ হলো, এই খাসিটির বৈশিষ্ট্য। তার গায়ে এমন কিছু লেখা আছে, যা দেখে মানুষ এই দাম দিয়ে তা কিনবে। তবে সেই লেখা তিনি দেখাননি।
ছবি: Rouf Fida/DW
তিন রাজ্য থেকে
জামে মসজিদের পাশে এই পশুর বাজারে খাসি ও ভেড়া আসে মূলত রাজস্থান, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ রাজ্য থেকে। বিক্রেতাদের মধ্যে মুসলিম বেশি। তবে হিন্দুরাও আছেন। পশুর বাজার ঘুরে হরিয়ানার কয়েকজন হিন্দু পশু বিক্রেতার সঙ্গে কথাও হয়েছে ডিডাব্লিউর।
ছবি: Rouf Fida/DW
পশুর দাম
এবার খাসি ও ভেড়া বিক্রি হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ছয় লাখ টাকায়। শনিবার শেষবেলায় দাম আরো বাড়তে পারে। দশ হাজারের খাসি খুবই ছোট। তাতে মাংস খুব বেশি পাওয়া যাবে না। ১০-১৫ হাজারে যে খাসি বিক্রি হচ্ছে, তা থেকে আট থেকে ১০ কিলোগ্রাম মাংস পাওয়া যাবে।
ছবি: Rouf Fida/DW
করোনা কম বলে
গত দুই বছর করোনার ভয় ছিল। এবার দিল্লিতে করোনার ভয় তেমন নেই। ফলে পশু-বাজারে প্রচুর বিক্রেতা। তারা অস্থায়ী ছাউনির নীচে পশু বিক্রি করছেন।
ছবি: Rouf Fida/DW
জামে মসজিদ
আলোয় সেজে উঠেছে জামে মসজিদ। ঈদ আসছে। জামে মসজিদ ও তার সামনে ও আশপাশের এলাকা এখন জমজমাট।
ছবি: Rouf Fida/DW
রকমারি খেজুর
ঈদ এলে প্রচুর খেজুরের দোকান বসে জামে মসজিদের সামনে। বিভিন্ন ধরনের খেজুর পাওয়া যায় সেখানে।
ছবি: Rouf Fida/DW
ঈদের সিমাই
ঈদে সিমাই তো খেতেই হবে। জামে মসজিদের সামনে আছে সিমাইয়ের প্রচুর দোকান। নানা ধরনের সিমাই পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।
ছবি: Rouf Fida/DW
শিরমাল রুটি
শিরমাল হলো মিষ্টি রুটি। উপরে ছড়ানো থাকে কাজু, কিসমিস, পেস্তা, বাদাম। মুঘল বাদশারা এই রুটি পছন্দ করতেন। দিল্লির ঈদে বিশেষ আকর্ষণ হলো এই শিরমাল।
ছবি: Rouf Fida/DW
নানা ধরনের পসরা
জামে মসজিদের পাশে নানা ধরনের জিনিস নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। ঈদের বিক্রিবাটা ক্রমশ জমে উঠেছে।
ছবি: Rouf Fida/DW
12 ছবি1 | 12
তিনি বলেন, ‘‘ মধ্যবিত্ত তার সাধ্যের মধ্যে ছোট গরু কোরবানি দিত৷ এবার সেইছোট গরুর দামও বেড়ে গেছে৷ কারণ আর্থিক সংকটের কারণে চোট গরুর চাহিদা বেড়েছে৷ তাই কেউ কেউ কোরবানি দিচ্ছেন না৷''
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘ এখন ঈদের খুশির চেয়ে মানুষের বড় প্রয়োজন খাদ্য৷ সরকার ওএমএস-এর মাধ্যমে যে পণ্য বিক্রি করছে তার পরিধি বাড়াতে হবে৷ আর এটা যাতে সবাই পায় তা নিশ্চিত করতে হবে৷ এর সঙ্গে সরকার যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী করেছে তাও বিস্তৃত করতে হবে৷'
ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবারও বেড়েছে৷ ঈদের আগের ছয়দিনে সাত হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছে৷
ঈদের খুশির চেয়ে মানুষের বড় প্রয়োজন খাদ্য: নাজনীন আহমেদ
নাজনীন আহমেদ বলেন, তাতে রিজার্ভ হয়তো কিছুটা বাড়বে৷ আর প্রবাসীদের পরিবার পরিজন ঈদটা ভালোভাবে করতে পারবেন৷ কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে হয়না৷ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে৷ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে৷
মুসলমানদের কোরবানির ঈদ সক্ষমদের জন্য৷ এই সময়ে তারা কোরবানির মাংস গরিব এবং আত্মীয় স্বজনদের দেন৷ আর তারা টাকা পয়সা দানও করেন৷ কিন্তু আয় বর্ধক না হলে তাতে লাভ নেই বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ৷
তার কথায়, কোরবানিতে গরিব মানুষ যে মাংস পান তাও তারা সংরক্ষণ করতে পারেন না৷ কারণ তাদের তো আর ফ্রিজ নাই৷ ফলে তারা ওই মাংস কম দামে বিক্রি করে দেন৷ এতে লাভবান হয় হোটেল মালিকরা৷
সার্বিক বিবেচনায় দুই বছর করোনার পর এবার কোরবানির ঈদ যে খুশির বার্তা নিয়ে আসার কথা তা আসেনি৷ শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ তাই যদি সম্ভব হয় বন্যা দুর্গত এলাকায় গিয়ে পশু কোরবানি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ যাতে তারা কোরবানির মাংস খেতে পারেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি আমার গরু সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি৷ অন্যরাও করতে পারেন৷ আর যারা একাধিক পশু কোরবানি দেন তারা একটি দিয়ে বাকি টাকা গরিব মানুষকে দিতে পারেন৷ কোরবানি হলো ত্যাগের উৎসব৷ আমরা যদি সবাই ত্যাগের মনোভাব দেখাই তাহলেই সেটা হবে আনন্দের৷’’
তাদের ঈদ ভাবনা
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সেতুর উদ্বোধন, প্রথমবারের মতো মহাসড়কের মোটরবাইক নিষিদ্ধকরণ, করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের আশঙ্কা৷ এর মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ঈদ ভাবনা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘মানুষ কেজি দরে গরুর দাম বলে’
বিক্রির উদ্দেশে ঢাকার গাবতলীতে পশুর হাটে কুষ্টিয়া থেকে ছয়টি গরু এনেছেন মো. বিল্লাল মিয়া৷ তিনি জানান, ‘‘এবারের হাটে এখন পর্যন্ত ক্রেতার সংখ্যা কম৷ ভোজ্য এবং জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর গো-খাদ্যের মূল্য ৫০ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে৷ অথচ হাটে মানুষ গরুর দাম বলছে মাংসের কেজির হিসাব করে৷’’ এতে গরু লালন-পালনের খরচও উঠবে না বলে দাবি করেন বিল্লাল মিয়া৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘কোরবানি দিতে পারতেসি না এইবার’
ঢাকার গুলিস্তান মোড়ে নতুন টাকার ব্যবসা করেন হারুনুর রশীদ৷ তিনি প্রায় ২০ বছর যাবত এই পেশায় আছেন৷ গত বছর কোরবানি দিলেও এবার সেই সামর্থ্য হচ্ছে না৷ বলেন, ‘‘মানুষের এইবারের মতো খারাপ অবস্থা আগে দেখি নাই৷ আমার নিজের অবস্থাই তো করুণ৷ গত বছর বাচ্চাদের শখ পূরণ কইরা একটা ছোট ছাগল কুরবানি দিসিলাম, কিন্তু এইবার কোনভাবেই সম্ভব হইতেসে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘পদ্মা সেতু দিয়ে পার হবো’
ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের নোঙর করা ঢাকা-হাতিয়া রুটে চলাচলকারী এমভি তাসরিফ-১ এর কর্মচারী মোঃ নাসির হোসেনের বাড়ি পটুয়াখালি৷ কিন্তু তিনি নিজেই পদ্মাসেতু দিয়ে বাসে করে এবার বাড়ি যাবেন৷ দক্ষিণবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পদ্মাসেতু হওয়ায় তিনি খুশি৷ আবার নিজের পেশায় এর নেতিবাচক প্রভাবও টের পাচ্ছেন৷ এবার ঈদে বোনাস পাবেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘‘এইবার বোনাস চাইলে মালিক নিশ্চিত মাইর দিবে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তবুও লঞ্চেই যাচ্ছেন জুনায়েদ
ঈদ করতে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে সপরিবারে হাতিয়ায় গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন জুনায়েদ হোসেন৷ পদ্মা সেতু দিয়ে না গিয়ে কেন লঞ্চে যাচ্ছেন জানতে চাইলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী জুনায়েদ জানান, বাসে যাওয়ার চেয়ে পরিবার নিয়ে লঞ্চে যাওয়াই তার জন্য সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘দুইটা টাকা কামাই করে সংসার চালানো কি অন্যায়?’
ঢাকার কারওয়ান বাজার মোড়ে কথা হয় রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের একজন মোটরবাইক চালকের সাথে৷ শুরুতে পদ্মা সেতুতে, পরে ঈদ উপলক্ষে মহাসড়কে মোটরবাইক নিষিদ্ধে ক্ষুব্ধ তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘কিছু হইলেই আমাদের উপর বিধিনিষেধ আসে৷ লকডাউনে সব চলছে, রাইড শেয়ারিং বন্ধ, ট্রাফিক পুলিশ কথায় কথায় জরিমানা করে, এখন আবার মহাসড়কে আমাদের চলাচল নিষেধ৷ আমাদের উপর কেন সব ঝড় আসে? দুইটা টাকা কামাই করে সংসার চালানো কি অন্যায়?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘এবার ঈদে আয় নাই’
মো. আবুল বাশার ঢাকার গুলিস্তানের ফুটপাথে দর্জির কাজ করে পরিবার চালান৷ ঈদ এলে তার কাজ বাড়ে, আয়ও বাড়ে৷ কিন্তু এবার খুশি নন তিনি৷ বাশার বলেন, ‘‘গত বছর লকডাউন থাকলেও সাত দিনে যা আয় করেছি এবার ঈদ চলে আসলেও সেই তুলনায় তেমন আয়ই হয়নি৷ তেলের দাম বৃদ্ধি আর প্রতিদিনের খরচ দুইগুণ বেড়েছে৷ খরচ মেটানোর পর হাতে আর কোনো টাকা থাকে না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
খুশি নন বাসচালক শরীফ
গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জ রুটের শীতল পরিবহণের চালক মো. শরীফ বলেন, ‘‘দেশে সেতু, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন হচ্ছে৷ এতে আমরা খুশি৷ কিন্তু রাস্তা-ঘাটে যানজট বেড়েই চলেছে৷ গত কোরবানির ঈদে লকডাউন থাকায় রাস্তায় গাড়ি কম ছিল, ট্রিপ বেশি মারতে পারায় বেতনও ছিল বেশি৷’’ রাস্তায় তীব্র জ্যামে এই ঈদে গতবারের তুলনায় আয় অর্ধেকও হবে না বলে জানান তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদের দিন বাড়ি যাবেন জব্বার
ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে কুলির কাজ করেন মো. জব্বার৷ ঈদ নিয়ে তার বাড়তি কোনো ভাবনা নেই৷ কোরবানি দেয়ার সামর্থ্যও নেই৷ তিনি বলেন, ‘‘গরিব মানুষের ঈদ নাই৷ ঈদ হলো ধনী মানুষের জন্য৷‘’ তার মতে, দেশে প্রতিবছর বড়লোক আরো বড়লোক হচ্ছে, গরিব আরো গরিব হচ্ছে৷ ‘‘ঢাকায় যে কয়টা প্রাইভেট গাড়ি আছে, সে কয়জনই শুধু টাকাওয়ালা, বাকিদের অবস্থা খারাপ,’’ বলেন জব্বার৷ ঈদের দিন পর্যন্ত কাজ করে লঞ্চে বাড়ি ফিরবেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আয় না বাড়লেও খরচ বাড়ছে ম্যালা’
তৈয়ব মিয়া ঢাকার রাস্তায় ফেরি করে শুকনো খাবার বিক্রি করেন৷ করোনাকালীন সময়ের চেয়ে তার আয় বেড়েছে৷ কিন্তু তার চেয়েও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খরচ৷ তৈয়ব মিয়া বলেন, ‘‘করোনার সময় রাস্তাঘাটে মানুষ কম থাকায় আমাগো ইনকাম কম আছিল৷ কিন্তু এমনিতে আমগো ইনকাম প্রায় একই৷ তয় এই কথা ঠিক যে এহন মানুষের আয় না বাড়লেও খরচ বাড়ছে ম্যালা৷’’ ঈদের আগের দিন পিরোজপুরে গ্রামের বাড়ি যাবেন তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ঈদ আগের মতো নেই’
ঢাকার মিরপুর ১০ সার্কেলের একটি পোশাক তৈরির কারখানার কর্মী সালেহা আক্তার৷ প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি দুই বছর যাবত কাজ করেন৷ এই মাসে তার বেতন বেড়েছে এক হাজার টাকা৷ কিন্তু সার্বিক খরচ বেড়েছে ৩০-৪০ ভাগ পর্যন্ত৷ তাই বেতন কিছুটা বাড়লেও তিনি পুরোপুরি খুশি হতে পারছেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘আগের বেতন দিয়ে যেভাবে ঈদ পালন করতাম এখন বেতন বাড়ার পরেও তা সম্ভব হয় না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ঈদ নিয়ে বাড়তি পরিকল্পনা নেই’
ঢাকার পল্টনের ফুটপাথের হোটেল ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘এখন জিনিসপত্রের দাম বাড়তি হইলেও সাধারণ মানুষের কথা ভাইবা হোটেলের খাবারের দাম বাড়াই নাই৷ কিন্তু তা-ও কাস্টমার আগের মতন নাই৷ মানুষ দুপুরে ভাতের জায়গায় চা-রুটি খায়, যে ১০-২০ টাকা বাঁচে, সেইটাই এখন অনেক টাকা৷’’ তিনি বলেন, গত বছরের ধার-দেনায় এখনও আটকে আছেন, তাই ঈদে বাড়তি কিছু করার পরিকল্পনা তার নেই৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদে নতুন জামা
ঈদ উপলক্ষে ফুটপাথ থেকে নতুন জামা কিনছেন মো. আল আমিন৷ নরসিংদী থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছেন দশম শ্রেণির এই ছাত্র৷ কেনাকাটা সেরে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি যাবে সে৷ অন্যবার শপিং মল থেকে জামা-কাপড় কিনলেও এবার জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ফুটপাথেই কেনাকাটা সারছেন বলে জানান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদ কাটবে সড়কে
ঢাকার গুলিস্তান মোড়ে কথা হয় এই ট্রাফিক পুলিশের সাথে৷ ১৫ বছরের চাকরিজীবনে হাতেগোনা কয়েকটি ঈদ তিনি বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছেন৷ এবারও তাকে ঈদের দিন রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে হবে৷ নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, ‘‘আমরা সরকারি চাকরি করি, কিছু বলতে পারি না৷ বেতন যা পাই, বউ-বাচ্চা গ্রামে রেখে পালতেও কষ্ট হয়া যায়৷ তা-ও তো আমরা নিয়মিত বেতন পাই, সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ কিভাবে চলে আল্লাহই ভালো জানেন৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আমরাই সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত’
একটি সরকারি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু নাসের৷ ঈদ আসলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে হতাশ তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘খুব সম্প্রতি পত্রিকায় দেখলাম আমরা ১২২টি দেশের মধ্যে হতাশা ও দুঃখে সপ্তম অবস্থানে আছি, প্রথমে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান৷ আমার মতে, বাংদেশের যে সার্বিক পরিস্থিতি, আফগানিস্তান নয়, আমাদেরই তালিকায় এক নাম্বারে থাকা উচিত৷’’