পাঠ্যপুস্তক থেকে ইতিহাস যতই ছেঁটে ফেলা হোক, ভারতীয় সংস্কৃতি বদলে দেওয়া তত সহজ নয়।
বিজ্ঞাপন
চীনা কাগজের চেন আর থোকা থোকা ঝুলন্ত লম্ফ আকাশ ঢেকে দিয়েছে। আলোর মায়ায় চাঁদ আর তারা। জামা মসজিদের প্রতিটি থাম সোনালি আলোয় আগুনের মতো জ্বলছে। আর মসজিদের গম্বুজের ঠিক উপরে ফালি চাঁদে কাস্তের ধার।
শাহী ইমাম মিনিটখানেক হলো আকাশ দেখে ইদের ঘোষণা দিয়েছেন, আর তাতেই উল্লাসের জোয়ার জামা মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে মিনা বাজারের কাবাব, শরবতি পেরিয়ে, রাজপথ পার করে লালকেল্লার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে চাঁদনি চকের গলিতে। সেখানে জমকালো শেরওয়ানি আর লহেঙ্গার দোকানে তিল ধারণের জায়গা নেই। শেষ মুহূর্তের ইদের বিকিকিনি চলছে জোর কদমে।
এ দৃশ্য দেখতে দেখতে কল্পনার স্রোত পৌঁছে যায় কয়েকশ বছর পিছনে। মুঘল বাদশা নিশ্চয় ওই লালকেল্লার পাঁচিলের ধারে অপেক্ষা করতেন শাহী ইমামের ঘোষণার জন্য। তারপর ঠিক এই পথ বেয়েই তো সম্রাট আর তার রানিদের কনভয় পৌঁছাতো মিনা বাজারে। ঘণ্টাঘরের পাশে সম্রাটের হাতি পেতো জিলিপি। আর রানিরা একে একে দেখে নিতেন গয়না, কাপড়, খাবার.... মশালের আলোয় ইদের দিন তখনো ঠিক এভাবেই নিশ্চয় জ্বলে থাকতো শাহী জামা মসজিদ, একফালি চাঁদ মাথায় নিয়ে।
ইদের এই অভূতপূর্ব উৎসবের নাম ভারতবর্ষ। জামা মসজিদের ওই প্রতিটা গম্বুজ আসলে ভারতবর্ষ। মতি মহলের রাস্তায় পুরনো দিল্লির কাবাব আসলে ভারতবর্ষ। মিনা বাজারের শরবত-ই-মোহাব্বত আসলে ভারতবর্ষ। লালকেল্লার গ্রানাইটের প্রতিটি পাথর আসলে দীর্ঘ ভারতীয় সভ্যতার এক জীবন্ত ইতিহাস।
রাজা বদলায়, বদলায় শাসকের চরিত্র। কিন্তু এই ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল ইতিহাস সরিয়ে দিয়ে একটি প্রজন্মকে কেবল অর্ধশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলা যায়। কিন্তু তাতে ইতিহাসের রোশনাই স্তব্ধ হয় না। আর হয় না বলেই, আজও জামা মসজিদের সিঁড়িতে বসে এক আশ্চর্য, অভূতপূর্ব ইতিহাস চাক্ষুস করা যায়, অনুভব করা যায়। বোঝা যায়, শাসক যা-ই বলুক, ইতিহাসের ঐতিহ্য খতম করে দেওয়া যায় না। সেই সাবেক কাল থেকে যে প্রথায়, যে আচারে ইদ পালন হয়েছে মুঘল শাহজাহানাবাদে, এখনো সেই ঐতিহ্য অব্যাহত।
মুঘলের দিল্লি থেকে এবার পা বাড়ানো যাক নবাবি কলকাতায়। বন্দরের ধারে নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি। আর অন্যদিকে নাখোদা মসজিদের রোশনাই। এদিকে জোড়াসাঁকো, মার্বেল প্যালেসের সাবেকিয়ানা, ওদিকে চিৎপুর রোডের খাবারের পসরা। রমজান শুরু মানেই নাখোদা পার্শ্ববর্তী জাকারিয়া স্ট্রিটে গাড়ি চলাচল বন্ধ। রাস্তার উপর উনুন বানিয়ে হালিম। কাঠ-কয়লার আগুনে সুতোকাবাব, সুদূর আগ্রা থেকে এসেছেন মিষ্টির বিক্রেতা। শরিমলে শুকনো ফল লাগাচ্ছেন দিল্লির রাঁধুনি।
দিল্লির জামা মসজিদ ছেড়ে কলকাতায় কেন? সাংবাদিকের প্রশ্নে বিরক্ত রাঁধুনির জবাব, এসব উত্তর পেতে হলে চার পুরুষ আগে যেতে হবে। সেই তখন থেকে পবিত্র রমজানে আমাদের গোটা পরিবার জামা থেকে নাখোদায় এসে পসার সাজায়।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। সেই ট্র্যাডিশন মেনেই আজও মশলার গোপন তালিকা ঘেঁটে ওয়াজেদ আলি শাহের পরিবার হালিম বানায়। মনজিলাত ফতেমার সেই হালিম খাওয়ার জন্য আগে থেকে ব্যবস্থা করে রাখতে হয়। আজও ইদের দিনে ওয়াজেদ আলির সঙ্গে আসা পানওয়ালার উত্তরসূরি স্পেশাল নবাবি পান বানান। আজও টিপু সুলতান মসজিদের পাশে বৃদ্ধ কাবাবওয়ালা রুটিতে জড়িয়ে দেন স্নেহের ছোঁয়া।
আজও ইদের দিনে বাল্যবন্ধু আতহারের মা ফোন করে জানিয়ে দেন, সারাদিনের খাওয়াদাওয়া কাকিমার হেফাজতে। গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এই নিয়ম চলে আসছে, কলকাতার ইতিহাসের ট্র্যাডিশন মেনে।
ঈদের ইতিহাস
মুসলিমদের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ৷ কীভাবে এই ঈদের শুরু, বাংলায় কবে ঈদ এলো - এসব তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Munir uz zaman/AFP via Getty Images
যেভাবে ঈদের শুরু
বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া বলছে, মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় যাওয়ার পর ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা শুরু হয়েছিল৷ সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন মদিনার মানুষ ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ নামে দুটি উৎসব পালন করে থাকে৷ তখন মদিনাবাসীকে মহানবি বলেন, ‘‘আল্লাহ তোমাদেরকে উক্ত দিবসদ্বয়ের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিবস দান করেছেন৷ দিবসদ্বয় হলো ঈদুল আযহার দিবস ও ঈদুল ফিতরের দিবস৷’’
ছবি: Munir uz zaman/AFP via Getty Images
ঢাকায় যেভাবে ঈদ এলো
ইতিহাস গবেষক রিদওয়ান আক্রাম ২০১৩ সালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে লিখেছিলেন, ১৬১০ সালে ঢাকায় মুঘলরা আসার পর ঈদ উৎসব পালন শুরু হয়েছিল৷
ছবি: Stringer/AA/picture alliance
যেভাবে পালন হত
মুঘলদের ঈদ উদযাপন হত দু-তিনদিন ধরে৷ চলত সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন৷ আত্মীয়স্বজন পরিবার পরিজন নিয়ে একরকম মেলাই বসে যেত৷ সম্ভবত বাদশাহী বাজারে (বর্তমান চকবাজার) এই মেলা আয়োজিত হত৷ বিশেষ করে তখনকার প্রশাসনিক সদরদপ্তর ঢাকা কেল্লার (ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার) আশপাশের এলাকা ঈদের সময়টায় থাকত জমজমাট৷
ছবি: bdnews24.com
ঈদের চাঁদ ওঠার পর
সন্ধ্যায় মোমবাতির আলোয় আলোকিত হত মুঘল আমলের ঢাকা শহর৷ ঈদের চাঁদ ওঠার পর বেজে উঠত শাহী তূর্য (রণশিঙ্গা)৷ আর গোলন্দাজ বাহিনী গুলির মতো একের পর এক ছুঁড়তে থাকত আতশবাজি৷ সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলত এই আতশবাজির খেলা৷ শেষরাতের দিকে বড় কামান দাগা হত৷ সে সময় ঢাকাবাসী বাদশাহী বাজার (বর্তমানে চকবাজার) থেকে ঈদের কেনাকাটা সারতেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঈদগাহ তৈরি
মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ সুজাকে সুবে বাংলার শাসক করে পাঠান ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে৷ তার নির্দেশে ১৬৪০ সালে বর্তমান ধানমণ্ডির সাত মসজিদ রোডের ঈদগাহটি নির্মিত হয়েছিল৷ তখন থেকে ঢাকায় অভিজাত শ্রেণির মুসলমানেরা ঐ ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়তেন৷ তবে সাধারণ নগরবাসীর সেখানে যাওয়ার তেমন একটা সুযোগ ছিল না৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জৌলুস ধরে রাখতে ঈদ মিছিল
১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে ইংরেজরা বাংলার-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব সংগ্রহের ভার পায়৷ সে কারণে ঢাকার নায়েব-নাযিমরা পরিণত হন ক্ষমতাহীন শাসকে৷ এই অবস্থায় পড়তি ঢাকার জৌলুস ধরে রাখার চেষ্টা করা হত ঈদ ও মহরমের মিছিল আয়োজনের মাধ্যমে৷ মিছিলে থাকত সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি, অস্ত্র হাতে সৈন্যদল৷ কারও কারও হাতে থাকত রং-বেরংয়ের ছাতা অথবা বাদ্যযন্ত্র৷ ছবিতে ১৮৪৩ সালের দিল্লির ঈদ উৎসব দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Metcalfe, Sir Thomas Theophilus, British Library/Wikipedia
ঈদ উৎসবে নতুন সংযোজন
উনিশ শতকের শেষের দিকে মুসলমানরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে শুরু করে৷ এতে মুঘল সম্রাজ্যের অংশীদার পরিবারগুলোর পাশাপাশি মুসলমানদের আরেকটি শ্রেণির উত্থান হয়৷ তারা ঈদ উৎসবে নতুন কিছু সংযোজন করেছিলেন- যেমন বিভিন্ন ধরনের পিঠা, সেমাই ও ঈদের দিনে মেলার আয়োজন৷ এসব মেলায় বিক্রি করতে নানারকম ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হতেন আশপাশের গ্রামের বিক্রেতারা৷
ছবি: Ahmed Salahuddin/NurPhoto/picture alliance
গত শতকের ঈদ উৎসব
গত শতকের ত্রিশের দশক থেকে ধীরে ধীরে ঢাকাবাসীর ঈদ উদযাপনে পরিবর্তন ঘটে৷ কারণ ততদিনে ঢাকায় জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে৷ টকি সিনেমা এসেছে৷ এসেছে রেডিও৷ ঈদ উপলক্ষে গ্রাম থেকে বেড়াতে এসে দর্শনার্থীরা যেতেন ঢাকার কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে৷ ঈদের দিন সিনেমা হলগুলোতে ঈদের বিশেষ ছবি প্রদর্শন করা হত৷
ছবি: Rehman Asad/NurPhoto/picture alliance
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ঈদ
বিজয়ের মাত্র এক মাস ১০ দিন পর ১৯৭২ সালের ২৭ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়েছিল৷ সেই ঈদ একদিকে যেমন ছিল স্বস্তির, আনন্দের, ঠিক তেমনি শহীদ পরিবার আর স্বজনদের মাঝে ছিল বেদনার৷ ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন৷ বঙ্গবন্ধু ঈদের নামাজ পড়েছিলেন ধানমন্ডি ক্লাব ময়দানে৷