চীন সরকারের বিপুল পরিমান গোপন নথি ফাঁস হয়েছে৷ দেশটির সিনচিয়াং প্রদেশের বসবাসরত মুসলিমদের দমনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নির্দেশনাসহ, কর্মকর্তাদের আচরণের বিভিন্ন তথ্য রয়েছে তাতে৷
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞদের হিসাবে উইগুর এবং অন্য সম্প্রদায় মিলে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের ক্যাম্পগুলো প্রায় ১০ লাখ মুসলমান রয়েছে৷ তাদের উপর দেশটির সরকারের মনোভাব কেমন, নিরাপত্তা বাহিনীকে কী ধররের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে - সেটি বেরিয়ে এসেছে সদ্য ফাঁস হওয়া গোপন নথি থেকে৷
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস এই নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে৷ ৪০৩ পৃষ্ঠার এসব নথিতে আছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর অপ্রকাশিত বক্তব্য, বিভিন্ন নির্দেশনা, উইগুরদের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের বিবরণ৷ তবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে মুসলমানদের উপর চালানো দমনমূলক আচরণ নিয়ে অসন্তোষও রয়েছে৷ টাইমস বলছে, দেশটির তেমনই একজন রাজনৈতিক সদস্য এইসব নথি ফাঁস করেছে৷ তার আশা এর ফলে মুসলমানদের অবরুদ্ধ করে রাখার জন্য শি জিনপিংসহ চীনের নেতৃবৃন্দ নিন্দা থেকে আর রেহাই পাবে না৷
কবরস্থান সরাচ্ছে চীন
01:19
নথি অনুযায়ী, ২০১৪ সালে কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক বক্তৃতায় শি ‘সন্ত্রাসী, অনুপ্রবেশকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ স্বৈরতান্ত্রিক সব উপায়ে দমনের নির্দেশ দেন৷ বলেন তাদের প্রতি কোন ধরনের ক্ষমা যাতে প্রদর্শন করা না হয়৷ দক্ষিণ পশ্চিম চীনের একটি রেল স্টেশনে উইগুরদের হামলায় ৩১ জনের মৃত্যুর পর এই বক্তব্য দিয়েছিলেন শি৷
২০১৬ সালে সিনচিয়াং প্রদেশের দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান চেন কুয়ানগুয়ো৷ তিনি শির নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন৷ তার সময়ই বাড়তে থাকে মুসলিম বন্দি ক্যাম্পের সংখ্যা৷
নথি অনুযায়ী পরিবারের নিখোঁজ সদস্যদের খুঁজতে আসলে ছাত্রদের কী বলতে হবে তার একটি নির্দেশনাও ছিলো৷ তাদের বলা হত নিখোঁজ ব্যক্তি উগ্রবাদি চিন্তার ভাইরাসে আক্রান্ত৷ ‘‘ছোট এই রোগ ভয়াবহ আকার নেয়ার আগেই তার চিকিৎসা করা প্রয়োজন৷’’
কোন কর্মকর্তা নির্দেশ অমান্য করলে তাকে পড়তে হয় শাস্তির মুখে৷ তেমনই একজন ওয়াং ইয়ংসি৷ সিনচিয়াংয়ের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে তিনি সাত হাজার বন্দীকে নিজ উদ্যোগে মুক্ত করে দেন৷ ২০১৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলে৷ এর বিস্তারিত রয়েছে নথিতে৷
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও এই বিষয়ে কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি৷
চীনে উইগুরদের উপর চালানো নির্যাতনের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে দেশটির সরকার৷ উইগুরদের আটকে রাখা নয়, ক্যাম্পগুলোতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেয়া হয় বলে দাবি তাদের৷
এফএস (এএফপি, রয়টার্স)
মুসলমানরা বন্দিশিবিরে, পর্যটকরা শিনচিয়াংয়ে
চীনের শিনচিয়াং প্রদেশে মুসলমানদের নতুন করে শিক্ষিত করে তোলার নামে বন্দি করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ৷ রাজ্যের এমন ভাবমূর্তি দূর করতে সেখানে পর্যটক আকর্ষণের চেষ্টা চলছে৷
ছবি: AFP/G. Baker
মুসলিমদের বাস
চীনের শিনচিয়াং রাজ্যে মূলত উইগুরসহ তার্কিক ভাষা বলা অন্য মুসলিমদের বসবাস ছিল৷ গত শতকের ৫০ থেকে ৭০ দশকের মধ্যে সেখানে সরকারিভাবে হান চীনাদের সংখ্যা বাড়ানো হয়৷ তখন থেকে মুসলমান ও হানদের মধ্যে প্রায়ই সংঘর্ষ লেগে থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eisele
মুসলমানেরা বন্দিশিবিরে
মুসলমানদের নতুন করে শিক্ষা দেয়ার নামে চীন সরকার কয়েক বছর আগে মুসলিমদের বিভিন্ন ক্যাম্পে (ছবি) নিয়ে যাওয়া শুরু করে৷ সেখানে তাঁদের মান্দারিন ভাষা শেখানো ও কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয় বলে চীনের দাবি৷ তবে জাতিসংঘের অভিযোগ, ‘ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ’ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য আনতে উইগুরদের ‘রাজনৈতিক শিবিরে’ জোর করে আটকে রাখা হয়েছে৷
ছবি: AFP/G. Baker
নজরে রাখতে অ্যাপ
তথাকথিত এসব বন্দিশিবিরের বাইরে যে উইগুররা আছেন তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের উপর নজর রাখতে সম্প্রতি একটি অ্যাপ চালু করেছে চীন৷ এই অ্যাপের সাহায্যে উইগুরদের ৩৬ ধরনের আচরণের তথ্য সংগ্রহ করা হয়৷ যেমন, প্রতিবেশীর সঙ্গে বেশি না মেশা, স্মার্টফোন ব্যবহার না করা, ‘উৎসাহী হয়ে’ মসজিদে দান করা ইত্যাদি৷
এছাড়া ফেসিয়াল-রিকগনিশন ক্যামেরা, ওয়াইফাই স্নিফার্স (এর মাধ্যমে চেকপয়েন্ট দিয়ে পার হওয়ার সময় মানুষের কাছে থাকা মোবাইলের সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়), পুলিশি চেকপয়েন্ট ইত্যাদির মাধ্যমেও উইগুরদের তথ্য সংগ্রহ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Azubel
পর্যটক বাড়ছে
তাকলামাকান মরুভূমি, বরফে ঢাকা তিয়ানশান, দেখার এমন অনেক কিছুই আছে শিনচিয়াংয়ে৷ মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরকারের আচরণ নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে শিনচিয়াং সম্পর্কে নেতিবাচক খবর এলেও সেখানে পর্যটক যাওয়া কমেনি, বরং বেড়েছে৷ ২০১৮ সালে আগের বছরের তুলনায় পর্যটকের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বেড়েছে বলে সরকারি তথ্য বলছে৷ অবশ্য বেশিরভাগই দেশি পর্যটক৷
ছবি: AFP/G. Baker
পর্যটকদের ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে
২০১৪ সালে শিনচিয়াং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ছুরি হামলায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটার পর সেখানে পর্যটকের সংখ্যা কমে গিয়েছিল৷ এই অবস্থায় প্রাদেশিক সরকার পর্যটক প্রতি ৭৩ ডলার বা ছয় হাজার টাকা ভর্তুকি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ এখনও সেটা আছে৷
ছবি: AFP/G. Baker
সব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি নেই
শিনচিয়াংয়ের সব জায়গায় যাওয়ার অনুমতি নেই পর্যটকদের৷ মুসলমানদের যে শিবিরগুলোতে বন্দি করে রাখা হয়েছে তার আশেপাশে যাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন এএফপির দুই সাংবাদিক৷ এছাড়া শিনচিয়াংয়ে চেকপয়েন্ট ও সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তাঁরা৷ অবশ্য এতসব নিরাপত্তা তল্লাশিকে সমস্যা মনে করছেন না চীনা পর্যটকরা৷
ছবি: Reuters/T. Peter
কোথায় ভয়!
শিনচিয়াংয়ের কাশগর শহরে উইলিয়াম লি নামের এক পর্যটকের সঙ্গে এএফপির প্রতিবেদকদের দেখা হয়েছিল৷ তিনি জানান, ঘুরতে গিয়ে তাঁর মনে হয়নি যে উইগুররা কোনো ভয়ের মধ্যে (যদি না আপনাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়) আছেন৷ ‘‘এটা আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি,’’ বলেন লি৷