উগান্ডায় সমকামীরা নিপীড়নের শিকার৷ কারাগারেও নিক্ষেপ করা হয় তাঁদের৷ এ সম্পর্কে উগান্ডার অ্যাক্টিভিস্ট কাশা জ্যাকলিন নাবাগেসেরা জার্মান সংসদে বক্তব্য রাখেন৷
বিজ্ঞাপন
বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার
তাঁরা বাসে চলাচল করতে পারেন না৷ নিরাপত্তার অভাবে তাঁদের গাড়িতে যাতায়াত করতে হয়৷ কখনও একা পথেঘাটে বের হন না৷ ‘‘আমি প্রায়ই রাস্তায় মারধোর খেয়েছি৷ হত্যার হুমকিও পেয়েছি৷'' বলেন এই অ্যাক্টিভিস্ট৷ তিনি উগান্ডার সমকামীদের অধিকার রক্ষায় বিশেষ তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এ জন্য ২০১৩ সালে ন্যুর্নব্যার্গ শহরের পক্ষ থেকে ‘মানবাধিকার পুরস্কার' দেওয়া হয় তাঁকে৷ এই সূত্র ধরে জার্মান সংসদের সঙ্গে সম্পৃক্তি গড়ে ওঠে তাঁর৷ সংসদের উন্নয়ন সাহায্য সংক্রান্ত কমিটিতে ৩৩ বছর বয়সি নাবাগেসেরা তাঁর দৈনন্দিন জীবনের চিত্র তুলে ধরেন৷ লেসবিয়ান নারী হিসাবে সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয় তাঁকে৷ রাজধানী কাম্পালায় তাঁর বাসাটি এক আত্মীয়ের নামে ভাড়া করতে হয়েছে৷ কেননা নিজের নাম প্রকাশ পেলে বাড়ির মালিক সমস্যায় পড়তে পারেন৷
আত্মহত্যারপথও বেছে নেন অনেকে
উগান্ডায় শুধু সমকামীরাই নয়, তাঁদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি ব্যবসার সহযোগীদেরও হয়রানির শিকার হতে হয়৷ এই চাপ মাঝে মাঝে এত বেশি হয়ে ওঠে, যে অনেক সমকামী আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন৷ এই ধরনের ঘটনা ঘটলে প্রকাশ্যে আবার উল্লাসও করা হয়৷ অজ্ঞানতা, উপেক্ষা ও ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে অনেকেই সমকামীদের সম্পর্কে ঘৃণার মনোভাব পোষণ করেন৷
উগান্ডার একটি আইন এই ফোবিয়া বা ভীতিকে আরে তীব্রতর করেছে৷ ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই আইনে স্বাক্ষর করেছেন প্রেসিডেন্ট ইয়োভেরি মুসেভেনি৷ এতে বলা হয়েছে, সমকামীদের তো বটেই – তাঁদের সহায়তাকারীদেরও কারাদণ্ড হতে পারে৷ সমকামীদের নাম ও ছবি প্রকাশ পেলে তাদের চাকরি হারাতে হয়৷ বের করে দেওয়া হয় বাড়ি থেকে৷ ‘‘এই বিষয়টিকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না৷'' বলেন উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা কমিটির ডাগমার ভ্যোর্ল৷ ইতোমধ্যে আফ্রিকার ৩৪টি দেশ সমকামিতাকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা হয়৷ চারটি দেশে এ কারণে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়৷
এর মধ্যে অনেক দেশই জার্মানির উন্নয়ন সাহায্য পেয়ে থাকে৷ এদিক দিয়ে দেশগুলির ওপর চাপ সৃষ্টি করার একটা সুযোগ রয়েছে জার্মানির৷
ইউরোপে সমকামীদের অধিকার
সমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের৷ ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ তবে পূর্ব ইউরোপের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ বিস্তারিত দেখুন এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফ্রান্স
সমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার দিতে সরকারি পরিকল্পনার সমর্থনে গত রবিবার প্যারিসে হাজির হন লাখো মানুষ৷ কিছুদিন আগে অবশ্য সেখানে সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে লাখো মানুষ সমবেত হয়৷ এই ইস্যু নিয়ে বেশ উত্তপ্ত সেদেশ৷ বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চ এবং ডানপন্থি বিরোধী দল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদকে এই আইন করা থেকে বিরত রাখতে চাইছে৷
ছবি: Reuters
নেদারল্যান্ডস
ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতি মিশ্র৷ নেদারল্যান্ডস হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম দেশ যেখানে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ ঘোষণা করা হয়৷ ২০০১ সালের এপ্রিল থেকে সেদেশে এই আইন কার্যকর আছে৷
ছবি: AP
বেলজিয়াম
২০০৩ সালের জুন মাসে নেদারল্যান্ডসের প্রতিবেশী দেশ বেলজিয়ামে সমলিঙ্গের মধ্যে বিবাহ বৈধ করা হয়৷ প্রথম দিকে সেদেশে বিদেশিদের মধ্যে এ ধরনের বিবাহে খানিকটা জটিলতা ছিল৷ কিন্তু ২০০৪ সালের অক্টোবর থেকে সকল দেশের নাগরিকদের এই সুবিধা দেওয়া হয়৷ এক্ষেত্রে যে কোনো একজনকে কমপক্ষে তিন মাস বেলজিয়ামে থাকতে হবে৷ ২০০৬ সাল থেকে সমকামী পুরুষ এবং নারীকে সন্তান দত্তক নেওয়ার সুবিধাও প্রদান করা হয় বেলজিয়ামে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্পেন এবং পর্তুগাল
খোসে লুইস রোদ্রিগেজ সাপাতেরো-র সমাজতন্ত্রী সরকারের মেয়াদকালে পৃথিবীর তৃতীয় দেশ হিসেবে স্পেন সমকামীদের মধ্যে বিয়ে বৈধ করে৷ ফ্রান্সের মতো সেদেশেও ক্যাথলিকদের শক্ত অবস্থান রয়েছে৷ তা সত্ত্বেও ২০০৫ সালের জুলাই মাসে স্পেনে এ ধরনের বিয়ে বৈধ করা হয়৷ ২০১০ সাল থেকে পর্তুগালও একই পথের পথিক হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আইসল্যান্ড
আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইওয়াহানা সিগুরডোটির এবং তাঁর সঙ্গিনী ইওহিনা লিওসডোটির সমকামীদের বিয়ে বৈধ ঘোষণার পর প্রথমেই সেই সুযোগ নিয়েছেন৷ সিগুরডোটির হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মেয়ে সমকামী রাষ্ট্রপ্রধান৷ ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি৷ এরপর ২০১০ সালে সেদেশে সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হলে সঙ্গিনী লিওসডোটিরকে বিয়ে করেন সিগুরডোটির৷
ছবি: Getty Images
স্ক্যান্ডিনেভিয়া
সমকামীদের অধিকারের বিষয়ে আইনিভাবেই সচেতন স্ক্যান্ডিনেভিয়া৷ সুইডেনে ২০০৯ সালে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ করা হয়৷ পুরুষ এবং নারী সমকামী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে সেদেশে কোনো বাধা নেই৷ নরওয়ে ২০০৮ সালে এ সংক্রান্ত এক বিল অনুমোদন করেছে৷ ২০১২ সালের গ্রীষ্ম থেকে ডেনমার্কেও সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হয়েছে৷ ফিনল্যান্ডও এ ধরনের বিয়েকে বৈধতা প্রদানের পথে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুক্তরাজ্য
এই ছবিটি গত শতকের ৮০-র দশকের৷ এতে দেখা যাচ্ছে, সমকামীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করছেন একদল মানুষ৷ এরপর অনেকদিন পেরিয়েছে৷ যুক্তরাজ্যে সমলিঙ্গের পুরুষ বা নারী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি রয়েছে৷ ২০০৫ সাল থেকে রয়েছে এই প্রথা৷ তবে চার্চে সমলিঙ্গের নারী বা পুরুষ বিয়ে করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জার্মানি
২০০১ সাল থেকে সমলিঙ্গের যুগলের রেজিস্ট্রেশন বৈধ করেছে জার্মানি৷ এই প্রক্রিয়ায় জার্মানিতে বিয়ের সুযোগ সুবিধার অনেকটাই পান সমকামীরা৷ কিন্তু যৌথভাবে সন্তান দত্তক নেওয়া কিংবা পূর্ণ আয়কর সুবিধা এখনো পায়না সমকামী দম্পতিরা৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, জার্মানির ৬৬ শতাংশ জনসাধারণই সমকামীদের বিয়ের পক্ষে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পূর্ব ইউরোপ
তবে ইউরোপের পর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ সেখানকার সমাজে সমকামী নারী বা পুরুষকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়না৷ লিথুনিয়া, পোল্যান্ডের মতো লাটভিয়াতেও বিষমকামী দম্পতির মতো সমান অধিকার পায় না সমকামী দম্পতি৷ পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ জনগণই সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে৷
ছবি: Reuters
রাশিয়া
রাশিয়ার সংসদ সম্প্রতি শিশুদের মাঝে ‘সমকামীদের প্রচারণা’ নিষিদ্ধ করেছে৷ আর আগেই অবশ্য সেন্ট পিটার্সবুর্গের (ছবিতে) মতো বিভিন্ন শহরে সমকামিতাকে উৎসাহ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ নতুন এই আইনের ফলে সমকামীদের অধিকার বিষয়ক প্রচারণা রাশিয়ায় অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আয়োজকদের জরিমানা হবে৷ বলাবাহুল্য, রাশিয়াতে সমকামীদের বিয়ে বৈধ নয়৷
ছবি: Dmitry Lovetsky/AP/dapd
10 ছবি1 | 10
প্রধান শর্ত মানবাধিকারকে মর্যাদা দেওয়া
‘‘আমাদের উন্নয়ন সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডের প্রধান শর্ত হলো মানবাধিকারকে মর্যাদা দেওয়া৷'' উগান্ডার সমকামী বিরোধী আইন প্রসঙ্গে এই কথা বলেন ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী গ্যার্ড ম্যুলার৷
এ ক্ষেত্রে কাম্পালার সরকার লাল সীমারেখা অতিক্রম করে গিয়েছে৷ প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে উন্নয়ন সহযোগিতামূলক কর্মসূচিকে৷ মনে করেন উন্নয়ন সহযোগিতা বিষয়ক রাজনীতিবিদ ডাগমার ভ্যোর্ল৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা চিন্তাভাবনা করছি সাধারণত সরকারকে আমরা যে অর্থ দিয়ে থাকি, তা মানবাধিকার রক্ষা সংস্থাগুলিকে দেওয়া যায় কিনা৷''
চাপ সৃষ্টি করতে পারে জার্মানি
কাশা জ্যাকলিন নাবাগেসেরা ও তাঁর সহযোদ্ধারাও এই সাহায্য কৌশলগতভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমানো যেতে পারে বলে মনে করেন৷ তবে উন্নয়ন সাহায্য সবদিক দিয়ে কমিয়ে ফেলা ঠিক হবে না৷ তাহলে সাধারণ মানুষের ওপরেই চাপ সৃষ্টি হবে৷ নির্যাতন ও হয়রানির শিকার সংখ্যালঘুদের সহায়তা করতে হলে বিদেশ থেকে চাপ আসাটাই কার্যকর৷ ‘‘উগান্ডায় আমাদের কথা তো কেউ শোনেনা৷ তাদের কথা শুনবে৷'' বলেন কাশা জ্যাকলিন৷ জার্মান সংসদে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এতে এটাই বোঝা যায় যে, আমরা সম্পূর্ণ একা নই৷'' তিনি যে প্রকাশ্যে সমকামীদের অবস্থা সম্পর্কে কথা বলছেন, উগান্ডার আইন অনুযায়ী এটা এক দণ্ডনীয় অপরাধ৷