‘আমাদের সাথে নয়' শিরোনামে শনিবার বেশ কিছু মুসলিম সংগঠন ও সুশিল সমাজের প্রতিনিধিরা উগ্র ইসলামপন্থি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে অংশ নিচ্ছেন৷ কিন্তু বিষয়টিকে নিয়ে বিতর্কও কম নয়৷
বিজ্ঞাপন
হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ কট্টরপন্থি ইসলামি ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে হিংসার পথ বেছে নিলে বৃহত্তর মুসলিম সমাজের কি তা মেনে নেওয়া উচিত? নীরব থেকে পরোক্ষভাবে সেই কাজে কার্যত সমর্থন জানানো হচ্ছে কি? নাকি সংখ্যাগুরু সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে তার সক্রিয় বিরোধিতা করা উচিত? বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতোজার্মানিতেও এ নিয়ে বিতর্ক চলছে৷ জার্মানির কেন্দ্রীয় মুসলিম পরিষদ শনিবার কোলন শহরে সন্ত্রাবসাদের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশের আহ্বান জানিয়েছে৷ কিন্তু তার বিরোধিতা করছে তুর্কি ইসলাম সংগঠন ডিটিব৷
কেন্দ্রীয় মুসলিম পরিষদের সভাপতি আইমান মাসিয়েক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমাদের পথে নামতে হবে, নিজেদের দেখাতে হবে, সমাজের ঐক্য বজায় রাখতে ও শান্তির জন্য সংগ্রাম করতে হবে এবং উগ্রপন্থার নিন্দা করতে হবে৷'' তিনি আরও বলেন, তথাকথিত ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য উগ্রপন্থিরা তাদের হত্যালীলার মাধ্যমে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে চায়৷ তাদের বিরোধিতা করতে জার্মানির কেন্দ্রীয় মুসলিম পরিষদ শনিবার কোলন ও এক সপ্তাহ পর রাজধানী বার্লিনে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি মিছিলে অংশ নেবে৷
জার্মানিতে তুর্কি সম্প্রদায়ের শক্তিশালী মসজিদ সংগঠন ডিটিব অবশ্য এই মিছিলের বিরোধিতা করছে৷ নীতিগতভাবে তারা সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করার পক্ষে হলেও যেভাবে দুই ব্যক্তির ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোলন ও বার্লিন শহরে মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছে, তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়৷ তাছাড়া ‘মুসলিম সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল' বললে সামগ্রিকভাবে মুসলিম সমাজের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ পায়৷ উল্লেখ্য, এক বিকল্প কর্মসূচির আওতায় শুক্রবার ডিটিব তাদের মসজিদগুলিতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ও শান্তির পক্ষে প্রার্থনাসভার আয়োজন করছে৷
তাদের এই অবস্থানের সমালোচনা করেছেন জার্মানির সবুজ দলের নেতা ফল্কার বেক৷ তাঁর মতে, এর মাধ্যমে ডিটিব সুশিল সমাজের অংশ হিসেবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করছে৷ যারা ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে জার্মানিতে লক্ষ লক্ষ মুসলিমের প্রতিনিধিত্ব করতে চায়, তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করা উচিত৷ কিন্তু ডিটিবের কাঠামো সেই দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত নয়৷
শনিবারের মিছিলে দশ হাজারেরও বেশি মানুষ অংশ নেবেন বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ কেন্দ্রীয় মুসলিম পরিষদ ছাড়াও তুর্কি সমাজ তাতে অংশ নিচ্ছে৷ বেশ কিছু খ্রিষ্টীয় সংগঠন, জার্মানির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির নেতা সেখানে উপস্থিত থাকবেন৷
জার্মানির মুসলমানদের সম্পর্কে তরুণরা যা ভাবছেন
জার্মানিতে বসবাসরত মুসলমানদের নিয়ে আটটি প্রশ্ন করা হয়েছিল আট তরুণ-তরুণীকে৷ তাঁদের উত্তর থেকে বেরিয়ে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: DW/J. Chase
নিজেকে কি জার্মান মনে করেন?
জার্মানির বিলেফিল্ডে থাকেন মরোক্কান বংশোদ্ভূত আয়া৷ গত মার্চে বার্লিনে অনুষ্ঠিত হলো ‘ইয়ং ইসলাম কনফারেন্স ২০১৭’৷ তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল – নিজেকে কি জার্মান মনে করেন? জবাবে ১৮ বছর বয়সি এই তরুণী বলেন, ‘‘আমি নিজেকে যতটা মরোক্কান মনে করি, তার চেয়ে বেশি জার্মান মনে করি৷ জার্মান সংস্কৃতির মাঝেই বেড়ে উঠেছি আমি৷ এর (জার্মান সংস্কৃতির) সঙ্গে যোগাযোগ আমার অন্য দেশের (মরক্বো) চেয়ে অনেক বেশি৷’’
ছবি: DW/J. Chase
ইউরোপে কি ইসলামীকরণ চলছে?
২২ বছর বয়সি মার্টিন থাকেন ফ্লেনসবুর্গে৷ ইউরোপে কি ইসলামীকরণ চলছে? – এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘না, ইউরোপে অনেক সংস্কৃতি এসে মিলছে৷আমার মনে হয়, ইউরোপ এ মুহূর্তে বেদনাদায়ক কিছু শিক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ ব্রেক্সিট এর একটা উদাহরণ৷ কিন্তু তথ্য এবং পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ইউরোপে মোটেই ইসলামীকরণ চলছে না৷ এটা পুরোপুরি বাজে কথা৷’’
ছবি: DW/J. Chase
আপনার কাছে সংহতির মানে কী?
ফলকান বললেন, ‘‘আমার কাছে এর মূল কথা হলো, কোথাও অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকা বা না থাকার অনুভূতি৷ শরণার্থীদের অনেককে এমন অনেক প্রশ্নই শুনতে হয় যা থেকে বোঝা যায় যে, আপনি আসলে এ সমাজের বাইরের কেউ৷ ছোটবেলায় এ বিষয়টি আমার খুবই খারাপ লাগত৷ মনে হতো, কোথায় আছি, কী কাজ করছি– এসব ছাপিয়ে সবসময় আমি যেন শুধুই একজন বহিরাগত ’’
ছবি: DW/J. Chase
মুসলিম আর অমুসলিমদের সম্পর্কোন্নয়নে কী কী করা যেতে পারে?
‘ইয়ং ইসলাম কনফারেন্স ২০১৭’-এর সংলাপের শিরোনাম ছিল ‘রিপেয়ারিং ডায়ালগ’৷ হানা-র কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ‘‘মুসলিম আর অমুসলিমদের সম্পর্ক মেরামতের জন্য কী করা দরকার?’’ হানা বললেন, ‘‘বড় সমস্যা হলো, এখানে একজন আরেকজনের বিষয়ে যত কথা বলে, একজন আরেকজনের সঙ্গে ততটা বলে না৷ আরেকজনের কাছে গিয়েই কিন্তু জানতে চাওয়া যায়, ‘‘তুমি কেন হেডস্কার্ফ পরো?’’ আমরা যেন এভাবে জানার আগ্রহ প্রকাশ করতে শিখিইনি৷’’
ছবি: DW/J. Chase
মুসলমানদের মিডিয়া যেভাবে তুলে ধরে
ডুইসবুর্গের মার্ভ-এর কাছ থেকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘যখন নির্দিষ্ট একটা বিষয়ের দিকেই পুরো গুরুত্ব দিয়ে মুসলিমদের তুলে ধরা হয়, তখন খুব খারাপ লাগে৷ ধরা যাক, আমি হেডস্কার্ফ পরেছি৷ এর মানে তো এই নয় যে, আমি খুব গরিব৷ আমার তো এর বাইরেও অনেক কিছু আছে৷ আমি যে ডুইসব্যুর্গের মানুষ হিসেবে গর্বিত সেটাও তো খুব গুরুত্বপূর্ণ৷’’
ছবি: DW/J. Chase
মুসলিমবিরোধী ‘হেটস্পিচ’ বা ভুয়া খবর রুখতে কী করণীয়?
কোলনের ২৫ বছর বয়সি তরুণ আহমেদ মনে করেন, ‘‘সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হেটস্পিচ বা ভুয়া খবরের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি দরকার সরাসরি কথা বলা৷ এসব নিয়ে আলোচনা করতে আমি সবসময় প্রস্তুত৷ বিশেষ করে ফেসবুকে যে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করার সাহস থাকা উচিত৷ তুরস্ক নিয়ে বিতর্কে অংশ নেয়ার জন্য আমি সম্প্রতি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রি-অ্যাক্টিভেট করেছি৷’’
ছবি: DW/J. Chase
শরণার্থীবিরোধী পেগিডা বা এএফডি সম্পর্কে ভাবনা
১৯ বছর বয়সি আয়লিন বললেন, ‘‘এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না৷এসব লোকের সঙ্গে কথা বলার কোনো মানে হয় না৷ কিছু লোক কখনোই মনমানসিকতা বদলাতে চায় না৷ এএফডি মনে করে যে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি ঠিক৷ পেগিডাও তাই মনে করে৷ অথচ তাদের দৃষ্টিভঙ্গির বড় একটা অংশই কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ তবে আমার মনে হয়, এ মুহূর্তে এসবের একটা হুজুগ চলছে, একসময় সবার শুভবু্দ্ধির উদয় হবে৷’’
ছবি: DW/J. Chase
ইসলাম কি জার্মানির অংশ?
পল বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই৷ জার্মানি এমন এক ভৌগোলিক এলাকা, যেখানে একটিই সমাজের বসবাস এবং একটি সমাজই ক্রিয়াশীল৷ এখানে বসবাসরত প্রত্যেকটি গ্রুপই জার্মানির অংশ৷ জার্মানিতে বাস করলে আমি জার্মানিরই অংশ এবং আমার নিজেকে ‘জার্মান’ বলার অধিকারও আছে৷ সেক্ষেত্রে আমার তো মনে হয় কারো জার্মান ভাষায় কথা বলারও দরকার নেই৷’’