ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান নতুন ঘটনা নয়৷ হিটলার-মুসোলিনির দাপট থেকে শুরু করে আজকের চরম দক্ষিণপন্থি ও পপুলিস্ট শক্তির প্রতি জনসমর্থনের পেছনে প্রায় একই কারণ দেখা যায়৷
বিজ্ঞাপন
তথ্য ও বাস্তবের প্রতি বিতৃষ্ণা
ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ফেসবুক, টুইটারের জমানায় এমন সব তথ্য সাধারণ মানুষের নাগালে চলে এসেছে, মাত্র এক যুগ আগেও তেমনটা কল্পনাও করা যেত না৷ অন্যদিকে যে কোনো মানুষ বৃহত্তর সমাজের কাছে তার বার্তাও পোঁছে দিতে পারছে৷ এমন অবাধ আদানপ্রদানের সুযোগ সত্ত্বেও বাস্তব সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ কিন্তু সার্বিকভাবে কমে চলেছে৷ এমনকি তথ্য-পরিসংখ্যান সম্পর্কে তাচ্ছিল্য ও অবহেলার মনোভাবও দেখা যাচ্ছে৷ নিজের বদ্ধমূল ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকলে কোনো খবরই সঠিক মনে হচ্ছে না৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম মানুষের মতাদর্শ বুঝে তাদের মনের মতো খবর সাজিয়ে রাখছে৷ ‘ফেক নিউজ' বা ভুয়া খবর এমন বদ্ধমূল ধারণায় ইন্ধন জোগাচ্ছে৷
ইউরোপে অস্থিরতা
এমনই প্রেক্ষাপটে ইউরোপে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে নানা ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি৷ একদিকে দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি, বর্ণের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের প্রতি অসহিষ্ণুতা, অন্যদিকে বিশ্বায়ন, মুক্ত বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমন্বয় প্রক্রিয়ার মতো প্রবণতার বিরুদ্ধে বিষাদগার করে চলেছেন এইসব দলের নেতারা৷ গত কয়েক দশকে মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির ব্যর্থতার ফায়দা তুলে এই সব শক্তি মানুষের মন জয় করতে চাইছে৷ জেনেশুনে ভুল চিত্র তুলে ধরে, তথ্য-পরিসংখ্যান সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিছক আবেগ সৃষ্টি করে তারা নিজেদের লক্ষ্য পূরণ করতে চাইছে৷ এবং সেই কাজে তারা সফলও হচ্ছে৷ ইউরোপের অনেক মানুষ ক্ষোভ, হতাশা, শূন্যতার অনুভূতির ভিত্তিতে সেই গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেদের ভাসিয়ে দিচ্ছেন৷
সর্বনাশা আচরণ
এমন সর্বনাশা প্রবণতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘ব্রেক্সিট'৷ প্রথমে যুক্তরাজ্যের ‘স্বাধীনতা'-র প্রবক্তা ইউকিপ দল ইইউ থেকে ব্রিটেনকে বিচ্ছিন্ন করার আন্দোলন শুরু করে৷ তারপর মূল স্রোতের দুই দলও সেই বিতর্ককে গুরুত্ব দেয়৷ ইইউ ত্যাগ করার সার্বিক পরিণতি তুলে না ধরেই গণভোটের আয়োজন করা হয়৷ ভয়ভীতি, আবেগ, ভিত্তিহীন কিছু ধারণাকে সম্বল করে ব্রেক্সিট-প্রবক্তারা সংখ্যাগুরু ভোটারদের সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হন৷ তার দু'বছর পরেও ব্রেক্সিটকে ঘিরে চরম অরাজকতা চলছে ব্রিটেনে৷
শরণার্থীরা যখন জুজু
২০১৫ সালে শরণার্থীদের ঢলও ইউরোপে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের শক্তিশালী করে তুলেছে৷ হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডসহ পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে বিদেশি ও ইইউ বিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে৷ জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়ে জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের বিরাগভাজন হয়েছেন৷ ফলে এএফডির মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছে৷ শরণার্থীদের ঢল সামলাতে নাজেহাল ইটালিতে দু-দু'টি উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি জোট সরকার গঠন করেছে৷ অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপের অন্য কিছু দেশেও এমন দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে৷ আসন্ন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনেও এইসব দল শক্তিবৃদ্ধি করতে চলেছে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের মতে, ইউরোপ এই মুহূর্তে ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে৷ বর্তমান যুগের নানা চ্যালেঞ্জের মুখে মানুষের মনে অনেক রকমের ভয়ভীতি কাজ করছে৷ মূল স্রোতের রাজনৈতিক শক্তিগুলি সেইসব ভয়ভীতি দূর করতে পারলে উগ্র জাতীয়তবাদীদের রাশ টানা সম্ভব হবে৷ কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের অনুকরণ করলে আখেরে তাদেরই নৈতিক জয় হবে৷ জার্মানির বাভেরিয়া রাজ্যের সিএসইউ দল ঠিক সেই ফাঁদে পা দিয়ে নির্বাচনের আগে জনসমর্থন হারাচ্ছে৷ বাকিদেরও সতর্ক থাকতে হবে৷
উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসন: সেকাল-একাল
সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডানপন্থি শাসনব্যবস্থার প্রতি মানুষের সমর্থন বেড়েছে৷ গত শতকেও এমন ধারা দেখা গিয়েছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP
আডল্ফ হিটলার
১৯৩৩ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে জার্মানিতে ক্ষমতায় আসেন আডল্ফ হিটলার৷ তার দলের কর্মীরা রাজনৈতিক বিরোধী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ভয় দেখাতেন৷ আর ইহুদিদের প্রতি হিটলারের মনোভাব ও হলোকস্টের কথা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন৷ প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়৷ তবে অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে সক্ষম হওয়ায় কিছু শ্রেণির মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/AFP
বেনিতো মুসোলিনি
‘ইটালির ফ্যাসিবাদের জনক’ বলা হয় তাকে৷ ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টির নেতা মুসোলিনি ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন৷ ১৯২৫ সালে গণতন্ত্র বাতিল করে একনায়কতন্ত্র চালু করেন তিনি৷ গোপন পুলিশের সহায়তায় মুসোলিনি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করেন৷ এছাড়া কয়েকটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন৷
ছবি: AP
জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকো
হিটলার ও মুসোলিনির সহায়তায় স্পেনের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন জেনারেল ফ্রাংকো৷ এরপর ১৯৩৯ সালে ক্ষমতায় যান৷ ১৯৭৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি স্পেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন৷ ক্ষমতার প্রথম দশকে তাঁর অনেক রাজনৈতিক প্রতিদন্দ্বী ও ভিন্ন মতাবলম্বী হত্যার শিকার হন৷ এছাড়া নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ও শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি মানুষের মগজ ধোলাই প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন৷
ছবি: picture alliance/EFE
ভিক্টর অর্বান
গত মে মাসে চতুর্থবারের মতো হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী হন ডানপন্থি এই নেতা৷ শপথ গ্রহণের পর দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘‘উদার গণতন্ত্রের বদলে আমরা একবিংশ শতকের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্র চালু করেছি৷’’ শরণার্থীরা হাঙ্গেরির খ্রিষ্টান পরিচয়ের জন্য হুমকি বলে মনে করেন তিনি৷ তাঁর সময়ে আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া অপরাধ হিসেবে গণ্য করে সংসদে একটি আইনও পাস হয়েছে৷ এছাড়া গণমাধ্যমের উপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/S. Nenov
ডোনাল্ড ট্রাম্প
সাম্প্রতিক সময়ে মেক্সিকো থেকে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা অভিবাসীদের সন্তানদের আলাদা করার ঘোষণা দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন ট্রাম্প৷ বিশ হাজার শিশুকে আটকে রাখার মতো ক্যাম্প তৈরির কথাও বলেছেন তিনি৷ এছাড়া কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন৷ দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সেটি অনুমোদনও করেছে৷ রিপাবলিকান দল ট্রাম্পের এসব সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আসছে৷
ছবি: Getty Images/C. Somoevilla
মাটেও সালভিনি
তিনি ইটালির নতুন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷ তাঁর ডানপন্থি দল ‘লিগা নর্ড’ জোট সরকারের একটি অংশ৷ সম্প্রতি তিনি প্রায় সাড়ে আটশ আফ্রিকান ও আরব শরণার্থী বোঝাই দুটি জাহাজ ইটালির উপকূল থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন৷ সালভিনি বলেছেন, ইটালি ‘মাদক ব্যবসায়ী, ধর্ষক আর চোরে’ ভরে গেছে৷ তিনি তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে চান৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
নরেন্দ্র মোদী
ভারতীয় লেখক পংকজ মিশ্র নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে মোদীকে ‘ফ্যাসিস্ট ও নাৎসিদের দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি ডানপন্থি হিন্দু সংস্থার সদস্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ তাঁর শাসনামলে সংখ্যালঘু মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চালিয়েছে গোঁড়া হিন্দুরা৷ তাছাড়া মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পরিবর্তন আনতে তাঁর সরকার হিন্দুদের উৎসাহিত করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Singh
রেচেপ তাইয়্যেপ এর্দোয়ান
সম্প্রতি আবারও প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন তিনি৷ তবে এবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর ক্ষমতা বেড়েছে অনেক৷ ২০১৬ সালে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর এর্দোয়ান সরকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে, এক লক্ষ ১০ হাজারের বেশি মানুষকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে, অনেক গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷