ইটালিতে যাযাবর জাতি রোমাদের বিরুদ্ধে চলছে উগ্র ডানপন্থিদের আন্দোলন৷ তেমনই এক বিক্ষোভে রুখে দাঁড়ালেন ১৫ বছরের বালক সিমোনে৷ তাঁর কথার তোড়ে কথা হারালেন বিক্ষোভকারীরা৷
বিজ্ঞাপন
ঘটনার শুরু ২ এপ্রিল৷ রাজধানী রোমের পাশেই শহরতলী তোরে মাউরায় ৭০ জন রোমাকে আবাসন দেয়ার ঘোষণা দেয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ৷ এর পর থেকেই এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে উগ্র ডানপন্থিরা৷
আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে কাসাপাউন্ড নামের রাজনৈতিক দল৷ এদিকে, রোমের স্থানীয় সরকার বা সিটি কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণও রয়েছে ফাইভ স্টার মুভমেন্ট (এমফাইভএস) নামের আরেকটি উগ্র ডানপন্থি দলের হাতে৷
২ এপ্রিলই রোমাদের জন্য নির্মিত আবাসন কেন্দ্রের বাইরে জড়ো হয় তিন শতাধিক বিক্ষোভকারী৷ রাস্তায় পার্ক করে রাখা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে আগুনও ধরিয়ে দেয় তারা৷ এক পর্যায়ে তছনছ করা হয় রোমাদের জন্য পাঠানো খাবারও৷ এসময় ‘ওরা না খেয়ে মরে যাক' বলে শ্লোগান দিতেও দেখা যায় অনেককে৷
বিক্ষোভের মুখে দাবি মেনে নিয়ে বুধবার রোমাদের অন্য এলাকায় সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেয় রোম৷
কিন্তু এর পরও থামেনি ডানপন্থিদের বিক্ষোভ৷ এ ঘটনাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় কমতি নেই কাসাপাউন্ড দলের কর্মীদের৷
কিন্তু এমন এক বিক্ষোভ চলাকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় অপ্রত্যাশিত এক বাধার মুখোমুখি হতে হয় এক কাসাপাউন্ড নেতার৷ তিনি সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘স্থানীয় জনগণ রোমাদের এই এলাকায় দেখতে চায় না৷' ঠিক তখনই পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা ১৫ বছরের বালক সিমোনে এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানান৷ সাংবাদিকরাও তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করে নেন৷
সিমোনে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘‘আমি আপনার সঙ্গে একমত না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আপনারা তোরে মাউরায় জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছেন৷ নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য আপনারা ক্ষোভকে ভোটে রূপান্তরের চেষ্টা করছেন৷''
সিমোনে আরো বলেন, ‘‘সবসময় কিছু হলেই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে কথা বলার সঙ্গে আমি একমত নই৷ যখন আপনারা এই অঞ্চলে ইউরোপীয় বিনিয়োগের কথা বলেন, আমি বলি এই ফান্ড সবার জন্য ব্যবহার হোক৷ ইটালিয়ান, রোমা, আফ্রিকান, কাউকেই বঞ্চিত করা উচিত না৷''
তাঁর এই পালটা যুক্তির তোড়ে পুরোটা সময় অস্বস্তিকর মুখভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় কাসাপাউন্ড নেতাকে৷
সিমোনের এই সাহসী অবস্থান ও বক্তব্য সংবাদ আকারে প্রকাশ হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও৷ তাঁর বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে অনলাইনে৷ উগ্র ডানপন্থিদের ‘ভুল বুঝিয়ে ফায়দা নেয়ার' চেষ্টাকে এভাবেই রুখে দেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে৷
ইউটিউবে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা পুরো ভিডিও প্রকাশ করেছে ৫ এপ্রিল৷ মাত্র তিন দিনেই আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ দেখেছেন ভিডিওটি৷
এডিকে/জেডএইচ
টাইমলাইন: উগ্র-ডানপন্থিদের সন্ত্রাসী হামলা
গত দশ বছরে উগ্র-ডানপন্থিদের অসংখ্য হামলা করেছে৷ এর মধ্যে কয়েকটি বড় ঘটনার দিকে ফিরে তাকিয়েছে ডয়চে ভেলে৷
ছবি: picture-alliance/empics/PA Wire/D. Lawson
জার্মানি ২০০৯: ড্রেসডেন কোর্টে নারীকে ছুরিকাঘাত
২০০৯ সালের ১ জুলাই, ড্রেসডেনের জেলা জজ আদালতে মারওয়া এল-শেরবিনি নামের নারীকে ছুরির আঘাতে হত্যা করা হয়৷ ঐ নারী ছিলেন একজন ফার্মাসিস্ট৷ স্বামী ও ছেলে সন্তান নিয়ে ড্রেসডেনে থাকতেন৷ ২৮ বছর বয়সি এক রাশিয়ান-জার্মানের বিরুদ্ধে কোর্টে কটূক্তির অভিযোগের সাক্ষ্য দেয়ায়, যুবক হামলা চালান৷ ঐ যুবক মারওয়াকে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘উগ্র মুসলিম’ বলে গাল দিয়েছিলেন৷ মারওয়া জার্মানিতে ইসলামবিদ্বেষের প্রথম হত্যার শিকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Hiekel
নরওয়ে ২০১১: ব্রাইভিকের গণহত্যা
২০১১ সালের ২২ জুলাই অ্যান্ডার্স বেহরিং ব্রাইভিক নামের এক উগ্র ডানপন্থি যুবক একাই দু’টি ঘটনায় ৭৭ জনকে হত্যা করেন৷ তিনি প্রথমে অসলোর সরকারি ভবনে বোমা বিস্ফোরণ করেন এবং এরপর উটোয়া দ্বীপে নিরীহ তরুণদের এক সামার ক্যাম্পে গিয়ে গুলিবর্ষণ করেন৷ হামলার আগে তিনি একটি ইশতাহার প্রকাশ করেন৷ সেখানে তিনি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ‘ইউরোপের ইসলামীকরণ’-এর নিন্দা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Berit
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫: চ্যাপেল হিল শ্যুটিং
২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ৪৬ বছর বয়সি এক ব্যক্তি প্রতিবেশী তিন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা করেন৷ নিহতরা হলেন দেয়াহ বারাকাত, তাঁর স্ত্রী ইউসর আবু-সালহা ও তাঁর বোন রাজান আবু-সালহা৷ হামলাকারী হত্যাকাণ্ডের আগে নিজেকে একটি সংঘবদ্ধ ধর্মের বিরোধী বলে উল্লেখ করেন৷ এই হত্যাকাণ্ডে অনলাইনে ব্যাপক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়৷ টুইটারে #MuslimLivesMatter নামে হ্যাশট্যাগ জনপ্রিয় হয়৷
২০১৫ সালের ১৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লেস্টনে এমানুয়েল আফ্রিকান মেথডিস্ট এপিস্কোপাল চার্চে এক শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণপন্থি গুলিবর্ষণ শুরু করেন৷ এটি যুক্তরাষ্ট্রে কালোদের সবচেয়ে পুরোনো চার্চ৷ গুলিতে নয়জন নিরীহ আফ্রিকান-অ্যামেরিকান মারা যান৷ এর মধ্যে একজন যাজকও ছিলেন৷ ২১ বছর বয়সি সেই হত্যাকারীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিদ্বেষমূলক অপরাধে দণ্ডিত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: Getty Images/J. Raedle
জার্মানি ২০১৬: মিউনিখে গুলি
২০১৬ সালের ২২ জুলাই মিউনিখের ১৮ বছর বয়সি এক তরুণ একটি শপিং মলে ঢুকে গুলি করা শুরু করেন৷ এতে ১০ জন নিহত ও ৩৬ জন আহত হন৷ নিহতদের মধ্যে ঐ হামলাকারীও ছিলেন৷ হামলাকারী একজন ইরানি বংশোদ্ভুত জার্মান নাগরিক ছিলেন৷ পুলিশ জানায়, হামলাকারী বর্ণবাদী মন্তব্য করছিলেন৷ তিনি অভিবাসীদের উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছিলেন৷
ছবি: Getty Images/J. Simon
যুক্তরাজ্য ২০১৭: ফিন্সবুরি পার্ক মসজিদে হামলা
২০১৭ সালের ১৯ জুন, ৪৭ বছর বয়সি এক ব্যক্তি উত্তর লন্ডনের ফিন্সবুরি মসজিদের সামনে ভ্যান চালিয়ে দিয়ে একজনকে হত্যা ও ১০ জনকে আহত করেন৷ আক্রান্তরা সবাই মুসলিম ছিলেন এবং রমজান মাসে তারাবির নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন৷ ইসলামবিদ্বেষী ওই ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/F. Augstein
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৭: শার্লটসভিলেতে নব্যনাৎসিদের ওপর গাড়ি হামলা
২০১৭ সালের ১২ আগষ্ট ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলেতে এক শ্বেতাঙ্গ নাগরিক বিরোধী শিবিরে হামলা চালান৷ বিরোধী শিবিরটিও সাদাদের ছিল এবং সেখানে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও নব্য নাৎসিরা জড়ো হন৷ এতে এক নারী নিহত ও অনেকে আহত হন৷
ছবি: Getty Images/AFP/P.J. Richards
ক্যানাডা ২০১৭: কুইবেকে মসজিদে হামলা
২০১৭ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে কুইবেকের ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে এক বন্দুকধারী সন্ধ্যার দিকে নামাজ পড়ার সময় হামলা চালান৷ এতে ছয় জন নিহত ও এক ডজনেরও বেশি মানুষ আহত হন৷ ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এই হামলাকে জঙ্গি হামলা বলে অভিহিত করেন৷
ছবি: Reuters/M. Belanger
যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮: সিনাগগে হামলা
২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর ৪৬ বছর বয়সি এক বন্দুকধারী পিটসবুর্গের ইহুদীদের একটি উপাসনালয়ে হামলা চালান৷ এতে ১১ জন নিহত ও ৭ জন আহত হন৷ হামলাকারী হামলার সময় বারবার ইহুদীবিদ্বেষী মন্তব্য করতে থাকেন৷ মার্কিন ইতিহাসে ইহুদীদের ওপর এটাই সবচেয়ে বড় হামলা৷
ছবি: picture-alliance/AP/M. Rourke
জার্মানি ২০১৯: নববর্ষে বোট্রোপ ও এসেনে হামলা
মধ্যরাতের কিছু পর যখন সবাই নিউইয়ার উদযাপন করছিলেন, তখন ৫০ বছর বয়সি এক ব্যক্তি জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের দু’টি শহর বোট্রোপ ও এসেনে হামলা চালান৷ তিনি তার গাড়ি উদযাপনরত অভিবাসীদের ওপর চালিয়ে দেন৷ বোট্রোপে গাড়ি উঠিয়ে দেন সিরিয়ান ও আফগান দু’টি পরিবারের সদস্যদের ওপর৷ এতে আট জন আহত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Kusch
নিউজিল্যান্ড ২০১৯: ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে হামলা
ক্রাইস্টচার্চে দুই মসজিদে জোড়া হামলায় কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়েছেন৷ একে উগ্র ডানপন্থিদের জঙ্গি হামলা বলে চিহ্নিত করেছে কর্তৃপক্ষ৷ বন্দুকধারী ব্যক্তি তার বর্ণবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী ইশতাহার অনলাইনে প্রকাশ করেন এবং হামলার ঘটনা লাইভস্ট্রিম করেন৷ কিউই প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডার্ন ঘটনাকে নিউজিল্যান্ডের ‘একটি অন্ধকারতম দিন’ বলে মন্তব্য করেন৷