উচ্চশিক্ষায়ও জালিয়াতি!
২০ আগস্ট ২০১৮‘‘গত ৭ দিন ধরে আমরা মালদার একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ #gkciet এর ছাত্র-ছাত্রীরা কলকাতার নন্দন চত্বরে রানুছায়া মঞ্চে অবস্থান বিক্ষোভ করে চলেছি... গত রাতে বৃষ্টির মাঝে সারারাত গাছ তলায় জুবুথুবু হয়ে বসে ছিলাম... সকাল থেকেও অঝোরে বৃষ্টি... আমাদের এখন পশু-পাখির মতো অবস্থা... লাগাতার ভিজে থাকায় সর্দিজনিত সমস্যায় সকলেই ভুগছি...''
চার দিন আগে ফেসবুকে এই পোস্ট দিয়েছিলেন মালদার গনি খান চৌধুরি ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্র-ছাত্রীরা৷ আজ ১১ দিন হয়ে গেল ওঁরা একইভাবে ঝড়-জল মাথায় করে অনশন অবস্থানে বসে আছেন কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসআর রবীন্দ্রসদনের মাঝের খোলা চত্বরে৷ সংস্কৃতিমনস্ক নাগরিক সিনেমা-থিয়েটার দেখতে নিয়মিত আসেন এই এলাকায়৷ তাঁরা কেউ থমকে দাঁড়াচ্ছেন, কেউ এগিয়ে গিয়ে হয়ত দু-চারটে সহানুভূতির কথা বলছেন, অনেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে ফেসবুকে ওদের হয়ে কথা বলছেন, ছবি, ভিডিও পোস্ট করছেন৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না৷ এই আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের অনুযোগ, অভিমান, ওরা যেহেতু কলকাতা শহরের কেউ নয়, মালদা থেকে এসেছেন, তাই এই শহর, তার বাসিন্দারা, শহরের সংবাদ মাধ্যম ওদের সমস্যার ব্যাপারে নির্বিকার৷
এর মধ্যে নাজমুল, মারুফ ইমদাদ এবং শাহিদ নামে তিন ছাত্রকে রবিবার রাতে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে৷ একজন ৯ দিনের লাগাতার অনশনের কারণে অসুস্থ, বাকি ২ জনের সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লেগেছে৷ কিন্তু ওঁরা হাল ছাড়তে নারাজ৷ ওঁদের নেতা শাইন জাহেদি ডয়চে ভেলেকে সোমবার টেলিফোনে বললেন, ‘‘আমরা সার্টিফিকেট হাতে নিয়েই শহর ছাড়ব৷ নয়ত আমাদের লাশ ফিরবে মালদায়!'
উচ্চশিক্ষা নিতে এসে জালিয়াতির শিকার হয়েছেন মালদার ওই গনি খান চৌধুরি ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির প্রায় ৮০০ ছাত্র-ছাত্রী, যাঁরা ভর্তি হয়েছিলেন ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে৷ ২০১৬ সালে ওই কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা শেষ করে যখন পরীক্ষা পাসের সার্টিফিকেট হাতে পাবেন, তখন জানতে পারেন যে, ওই সার্টিফিকেটের কোনো দাম নেই৷ কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ওই ইনস্টিটিউটের কোনো বৈধতা নেই৷ কোনো ডিগ্রি, বা ডিপ্লোমা দেওয়ার ক্ষমতাই নেই তাদের৷ ক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথমে কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হন৷ কয়েক মাস সময় চায় কর্তৃপক্ষ৷ সেই সময় ফুরিয়ে গেলে জানিয়ে দেয়, কিছু করার নেই৷ তারপরই ছাত্ররা রাস্তা অবরোধ, রেল অবরোধ, মিছিল, অনশন বিক্ষোক্ষের মতো কর্মসূচি নিতে বাধ্য হন৷
কেন্দ্র সরকার গোড়া থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ব সতর্কভাবে এড়িয়ে চলেছে৷ তারা সংসদে এটিকে ‘নন ফরমাল ইনস্টিটিউট' হিসেবে চিহ্নিত করেছে৷ অগত্যা ছাত্র-ছাত্রীরা তখন রাজ্য সরকারে দ্বারস্থ হয়৷ একটা রফাসূত্র মেলে যে, পলিটেকনিক ডিপ্লোমার সমতুল্য সার্টিফিকেট দেওয়া হবে সবাইকে৷ কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের হাতে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়, সেই দুর্গাপুর পলিটেকনিক শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যায়৷ ফলে যে সার্টিফিকেট শেষ পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে রাজ্য সরকারের কারিগরি শিক্ষা দপ্তর থেকে তুলে দেওয়া হয়, তারও কোনো দাম নেই৷ সেই সার্টিফিকেট দেখিয়ে কোনো চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না, এমনকি অন্য কোনো কলেজে উচ্চতর শিক্ষার জন্য ভর্তিও হওয়া যাচ্ছে না৷
এরই মধ্যে, মালদায় ইনস্টিউটিউটের চত্বরে প্রতিবাদ অবস্থান করছিলেন যে ছাত্র-ছাত্রীরা, তাঁদের ওপর বহিরাগত গুন্ডারা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ৷ অনেকেই সেই হামলায় জখম হন৷ অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানেরই এক শিক্ষক নাকি এক ছাত্রীকে হুমকি দিয়েছেন, ‘‘ক্যামেরাগুলো না থাকলে তোকে রেপ করে শিটিয়ে দিতাম!'' ছাত্র-ছাত্রীদের আরও অভিযোগ, তাঁদের প্রাপ্য সার্টিফিকেট দিতে না পারলেও কোটি কোটি সরকারি টাকা নয়ছয় হয় মালদার এই গনিখান চৌধুরি ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে৷ নিয়োগ নিয়েও হয় ঢালাও দুর্নীতি, লাখ লাখ টাকা হাতবদল হয়৷ মালদায় অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট এবং যাদবপুরে পথ অবরোধ করে ছাত্র-ছাত্রীরা৷ কিন্তু এতজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ কী হবে, তার কোনো দিশা এখনো নেই৷ এঁরা অধিকাংশই মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান৷ অনেক কষ্ট করে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে হয়েছে এঁদের৷ নিজেদের পড়াশোনায় কোনো ফাঁকি রাখেননি এঁরা৷ তার পরেও কেন এদের এভাবে পথে বসতে হলো, সেই জবাবদিহির দায় কারও নেই!