উচ্চ মাধ্যমিকে সপ্তম স্থানে রূপান্তরকামী
২৫ মে ২০২৩![ট্রান্সজেন্ডারের সাফল্য](https://static.dw.com/image/65731650_800.webp)
বুধবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এই পরীক্ষায় প্রথম ১০ স্থানাধিকারীর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন জনাই ট্রেনিং হাই স্কুলের পড়ুয়া স্মরণ্যা। কলা বিভাগে ৫০০ নম্বরের মধ্যে ৪৯০ নম্বর পেয়ে চমকে দিয়েছেন রূপান্তরকামী এই ছাত্রী। মেধাবী স্মরণ্যা বাংলায় ৯৪, ইংরেজিতে ৯৫, অর্থনীতিতে ৯৭, ভূগোলে ৯৯ ও ইতিহাসে ১০০ নম্বর পেয়েছেন।
পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের থেকে বেশি আলোচ্য হয়ে উঠেছে স্মরণ্যার আত্মপরিচয়ের লড়াই। পুরুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন
স্মরণ্য। ১৮ বছরের তরুণীর নাম এখন স্মরণ্যা। যদিও বোর্ডের খাতায় এখনো তার নামের পাশে রয়েছে 'পুরুষ' পরিচয়। সেটা বদল করার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে।
রূপান্তরের ইচ্ছা
রূপান্তরের লক্ষণ কৈশোরই দেখা দিয়েছিল স্মরণ্যার মধ্যে। এরপর অভিভাবক থেকে প্রতিবেশী, বন্ধু থেকে শিক্ষক, সকলের সমর্থনে আজ সাফল্য পেয়েছেন তিনি। ভবিষ্যতে ধর্ম-বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষের পাশে দাঁড়ানোই লক্ষ্য তার।
স্মরণ্যা বলেন, "আমি সিভিল সার্ভিসে যোগ দিতে চাই। অধ্যাপনা করার ইচ্ছা আছে। যে পেশাতেই থাকি না কেন, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করব। বঞ্চনা দূর করার চেষ্টা করব।"
মেয়ের পরীক্ষার ফল খুশি করেছে বাবা সৌরভ ও মা দেবস্মিতাকে। কিন্তু গোড়ার দিকে লড়াইটা কঠিন ছিল। সমাজ-সংস্কার নিয়ে মাথাব্যথা ছিল। পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক সৌরভের বক্তব্য, "প্রথমে ওর পরিবর্তন দেখে একটু বিমর্ষ থাকতাম। কিন্তু সকলকে পাশে পেয়েছি। তাই মেয়েকে নিজের মত বেড়ে উঠতে বাধা দিইনি।"
স্কুলও সমর্থন জুগিয়েছে ছাত্রীকে। জনাই ট্রেনিং হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রজতকুমার কুণ্ডু বলেন, "স্মরণ্যা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।ওকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল, যেমন খুশি পোশাক পরতে পারে। ইলেভেন থেকে ক্লাসে মেয়েদের সঙ্গেই ও বসতো।"
পুরুষ থেকে নারী
নিজের পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন স্মরণ্যা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার হরমোন সংক্রান্ত বদল লক্ষ্য করা যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া হয়, কাউন্সেলিং করানো হয়েছিল। তাতে বোঝা যায়, পুরুষের দেহে এক নারী বাস করছে।
স্মরণ্যা বলেন, "আমি প্রথম থেকেই নারী ছিলাম। ঈশ্বর আমাকে পুরুষের শরীর দিয়েছেন, কী আর করা যাবে। এটা প্রকৃতির খেলা।" এবার পুরুষ নারীর এই দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে শুধু নারীর পরিচয় পেতে বাধা নেই। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় এই সংক্রান্ত অস্ত্রোপচার হয়েছে স্মরণ্যার।
সারাদিন পড়ার অভ্যাস নেই স্মরণ্যার। যতটুকু পড়েন, তাতে ফাঁকি থাকে না। অবসরে নিজে হাতে মূর্তি গড়েন। পুজো হয় সেই দুর্গা প্রতিমার। এটাও যেন এক রূপান্তকামীর নারীত্বের আহ্বান। তিল তিল করে যেমন দেবীকে রূপ দেন, নিজের অন্দরের বদলটাও অনুভব করতে থাকেন।
চাই আরো স্মরণ্যা
কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রূপান্তরকামী মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয় স্মরণ্যার। ফেসবুকে মানবীর বক্তব্য, "খুব বকেছি মেয়েটাকে। পরীক্ষার আগে আগে আমাকে বারবার ফোন করতো হুগলির জনাই থেকে। জানতে চাইতো, একজন ট্রান্স হিসেবে কী করবে, কীভাবে চলবে? আমি বলতাম, সব ভুলে যাও, তুমি ট্রান্স। ছাত্রাণাম অধ্যয়নং তপঃ, শুধু এইটা মনে রাখবে।"
মফসসলের এক কিশোরী ও তার পরিবারের পক্ষে এই লড়াইটা খুবই কঠিন। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় রূপান্তকামীরা উদযাপন করছে এই সাফল্য। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'প্রান্তকথা'র কর্ণধার বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বড়। যদি সবার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে, তা হলে আরো কত স্মরণ্যা উঠে আসবে। এই সমর্থন না থাকার ফলে মাত্র দুই শতাংশ রূপান্তরকামী পরিবারে থাকতে পারেন। তাই স্মরণ্যার অভিজ্ঞতা সকলের কাছে শিক্ষণীয়।"