উত্তরাখন্ডে জার্মান মহিলা
৩০ জুন ২০১৩ভারতের হিমালয় পার্বত্য রাজ্য উত্তরাখন্ডে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি, বন্যা ও ধসে তীর্থভূমি কেদার-বদ্রী-গঙ্গোত্রী এক মৃত্যুপুরির চেহারা নেয়৷ গত আড়াই সপ্তাহ ধরে আটকা পড়া হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের উদ্ধার করে তাঁদের বিভিন্ন অস্থায়ী ত্রাণ শিবিরে পৌঁছে দেয় সামরিক বাহিনী৷ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত,অসুস্থ, মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত যাত্রীদের আহার পানীয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় চটজলদি প্রচুর প্লাস্টিকের সামগ্রী৷
এমনি একটি ট্রানজিট বেস ক্যাম্প ঋষিকেশ৷ উদ্ধার করা যাত্রীদের সাময়িক আস্তানা৷ দুয়েক দিন পর যে যার গন্তব্যে চলে যাবার পর দেখা যায় শিবিরের চারপাশটা ভরে আছে আবর্জনার স্তূপে যার বেশিরভাগ প্লাস্টিকের বোতল, থালা, গ্লাস আর প্লাস্টিক ব্যাগ৷ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে উচ্ছিষ্ট খাবার দাবার৷ ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক ব্যাগে বন্ধ নর্দমার নিকাশি ব্যবস্থা৷ সংক্রমণের আশঙ্কা প্রতি পদে৷ জঞ্জাল সাফাই-এর পরিকাঠামো অপ্রতুল৷
স্থির থাকতে পারেননি সেবাব্রতী, ধর্মপ্রাণা এক জার্মান পরিব্রাজিকা মহিলা যাঁর হিন্দু নাম কমলা এবং তাঁর ৯/১০ বছরের ছেলে রামো৷ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ছিলেন গঙ্গোত্রীতে৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে নেমে আসেন ঋষিকেশে৷ জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ত্রাণ শিবির ও ঋষিকেশ বাস টার্মিনালের আশপাশে প্লাস্টিকের জঞ্জাল সাফ করতে সেবিকার মত হাত লাগান৷ নাম কেনার জন্য নয়, অন্তরের তাগিদে৷ থাকতে চেয়েছিলেন প্রচারের আলোর বাইরে৷ তবু চাপা থাকেনি৷ খবরের কাগজে তাঁর ছবি বেরিয়েছে ফলাও করে৷
মায়ের মতই হাত লাগিয়েছে তাঁর ছেলে রামো৷ সাফাই কর্মীদের কাছ থেকে নিজের ও মায়ের জন্য নিয়ে এসেছে দু'জোড়া রাবারের দস্তানা৷ জোগাড় করেছে পিচবোর্ডের বাক্স৷ তাতে একটি একটি করে তুলে আনছে প্লাস্টিকের আবর্জনা৷ মা-ছেলের এই কাজ হয়ত একথাই বলতে চাইছে যে, এত বড় বিপর্যয়ের পরও পরিবেশ নির্মল রাখার শিক্ষা কেন হলো না এখানকার মানুষজনদের৷
উল্লেখ্য, সরকার ও বিভিন্ন পুরসভা প্লাস্টিক ব্যাগ ইত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷ নিষিদ্ধ হয়েছে ২০ মাইক্রোনের নীচে প্লাস্টিক ব্যাগ উৎপাদন৷ কিন্তু প্রয়োজন বড় বালাই৷ প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার কমেনি৷ বেশিরভাগ প্লাস্টিক ব্যাগ হাই-ডেনসিটি পলিথিন৷ তামিলনাডুর চেন্নাই শহরে দৈনিক প্রায় সাড়ে তিন হাজার আবর্জনা জমে৷ তারমধ্যে ৩০-৪০ টন প্লাস্টিক ব্যাগ৷ ২০ লাখ লোকের পুণে শহরে দৈনিক জমে ৯০টন প্লাস্টিক আবর্জনা৷ সেই আবর্জনা ফেলার মত ধাপার মাঠের অভাব৷ উন্নয়নের সময় পরিবেশ সুরক্ষার কথা মাথায় রাখলে উত্তরাখন্ডের এই মানবিক ট্র্যাজিডি অনেক কম করা যেত মনে করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা৷ যেমন বৃক্ষনিধন নিবারণ করা, তীর্থযাত্রী ও পর্যটক সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত করা এবং নদী তীরের ১০০ মিটারের মধ্যে বাড়িঘর, হোটেল, ধর্মশালা, গেস্টহাউস ইত্যাদি নির্মাণ না করা৷
পাহাড়ে বৃষ্টিবাদলের অভিঘাত রোধ করা পুরোপুরি সম্ভব নয়৷ কিন্তু কতকগুলি নির্দেশিকা পালন জরুরি৷ যেমন, পাহাড়ে রাস্তা তৈরির সময় খেয়াল রাখতে হবে পাহাড়ের একদিকটা কাটলে পাহাড়ে ঢাল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পর্বতের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ভূমিধসের আশঙ্কা বাড়ে৷ এটাই হয়েছিল ১৯৯৬ সালে৷ জম্মু-কাশ্মীরের অমরনাথ তীর্থপথে বন্যা ও ধসে প্রাণ হারিয়েছিল ২৪৩ জন যাত্রী৷ তবু আমরা শিক্ষা নিইনি৷ আসলে মানুষের বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং সরকারের ভোট ব্যাংক বড় বালাই৷ নতজানু সেখানে পরিবেশ৷ তাই এমনি করে জীবনের মূল্যে তার খেসারত দিতে হবে৷