উত্তর কোরিয়াকে বশে আনতে চীন ও রাশিয়ার উপর চাপ বাড়ছে৷ মার্কিন ও চীনা প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে যোগাযোগ রাখছেন৷ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানও নিজস্ব উদ্যোগ নিচ্ছে৷ আরও নিষেধাজ্ঞা চাপানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ইইউ৷
বিজ্ঞাপন
নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক চাপ ও হুমকির মুখে উত্তর কোরিয়া নতি স্বীকার করে কিনা, অপেক্ষা করে তা দেখার সময় নেই দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক মানুষের৷ যুদ্ধ আসন্ন, এমনটা মনে করছেন তারা৷ এদিকে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা রুখতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা মোতায়েনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন অনেক মানুষ৷ উল্লেখ্য, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থার আওতায় শেষ চারটি লঞ্চার বসানোর কাজ চলছে৷ বিক্ষোভকারীদের আশঙ্কা, এই পদক্ষেপকে চরম প্ররোচনা হিসেবে গণ্য করে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণের উপর হামলা চালাতে পারে৷
উত্তর কোরিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নতুন করে খুব বেশি কিছু যোগ করার অবকাশ নেই৷ মার্কিন প্রশাসন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের উপর সে দেশে পেট্রোলিয়াম সরবরাহ নিষিদ্ধ করার জন্য চাপ দিচ্ছে৷ উত্তর কোরিয়া থেকে বস্ত্র ও শ্রমিক আমদানিও বন্ধ করতে চায় ওয়াশিংটন৷ বিদেশে শীর্ষ নেতা কিম জং উন-এর সম্পত্তি আটক রাখা ও তাঁর বিদেশ ভ্রমণ নতুন নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবের খসড়ায় অন্তর্ভূক্ত করেছে মার্কিন প্রশাসন৷
চীন ও রাশিয়ার মতো দেশের উপর চাপ বাড়াতে মার্কিন প্রশাসন নিজস্ব পদক্ষেপেরও হুমকি দিয়েছে৷ যে সব দেশ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে মার্কিন ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিচ্ছে ওয়াশিংটন৷ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই লক্ষ্যে এক নির্বাহী আদেশ প্রস্তুত রেখেছেন বলে জানিয়েছেন মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী স্টিভ মেনুশিন৷ তবে এমন পদক্ষেপ অত্যন্ত অবাস্তব বলে মনে করছে অনেক মহল৷ বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পরিণতি অ্যামেরিকার পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হবে৷
উত্তর কোরিয়া পরিস্থিতিকে ঘিরে চীনের অস্বস্তি বেড়ে চলেছে৷ কোরীয় উপদ্বীপ ও জাপানে অ্যামেরিকার মদতে বেড়ে চলা সমরসজ্জার ফলে চীনের নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থের ক্ষতি হচ্ছে৷ বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা চীনের মাথাব্যথার কারণ৷ বুধবার চীনা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট টেলিফোনে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন৷ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সে বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কিছু করতে চান৷ দেখা যাক, তিনি সেটা করতে পারেন কিনা৷ কিন্তু উত্তর কোরিয়ার অবস্থা আমরা মেনে নেবো না৷'' উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হামলার প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, অবশ্যই সেটা প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে না৷
উত্তর কোরিয়াকে বশে আনতে চীন ও রাশিয়ার উপর চাপ বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান৷ রাশিয়ার ভ্লাদিভোস্তক শহরে এক আঞ্চলিক শীর্ষ সম্মেলনে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন উত্তর কোরিয়ার উপর আরও নিষেধাজ্ঞার পক্ষে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন আদায় করতে চাইছেন৷ সেই দুই দেশ অবশ্য ধাপে ধাপে সামরিক উত্তেজনা কমানোর ডাক দিচ্ছে৷
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও উত্তর কোরিয়ার উপর নিজস্ব নিষেধাজ্ঞা চাপানোর উদ্যোগ নিচ্ছে৷ ইইউ-র পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে এই মর্মে প্রস্তাব পেশ করবেন বলে জানিয়েছেন৷
উত্তর কোরিয়ায় কিম বংশের ‘রাজত্ব’
কিম পরিবার গত ৭০ বছর ধরে উত্তর কোরিয়া শাসন করছে৷ রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় কিম ইল-সুং, কিং জং-ইল ও কিম জং-উন প্রায় দেবতার সমান৷ কিন্তু কিংবদন্তির পিছনে মানুষগুলি কারা?
ছবি: picture alliance / dpa
তরুণ নেতা
উত্তর কোরিয়ার প্রথম ও ‘চিরন্তন’ প্রেসিডেন্ট কিম ইল-সুং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে ক্ষমতায় আসেন ১৯৪৮ সালে৷ উত্তর কোরিয়ার সরকারি বর্ষপঞ্জির শুরু কিম ইল-সুং-এর জন্মবর্ষ ১৯১২ সাল থেকে৷ ছবিতে কিম ১৯৫৩ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন, যে চু্ক্তির মাধ্যমে কোরিয়া যুদ্ধের বাস্তব সমাপ্তি ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বীরগাথা
কোরিয়া যুদ্ধের পর দশকের পর দশক ধরে পিয়ংইয়ং-এর প্রচারণা যন্ত্র কিম ইল-সুং-কে ঘিরে এক কিংবদন্তির মায়াজাল সৃষ্টি করেছে৷ কিমের ছোটবেলা আর ত্রিশের দশকে জাপানিদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের ভিত্তিতে তাঁকে এক অদ্বিতীয় সামরিক ও রাজনৈতিক প্রতিভা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে৷ ১৯৮০ সালের পার্টি কংগ্রেসে কিম ঘোষণা করেন যে, তাঁর পুত্র কিম জং-ইল তাঁর উত্তরাধিকারী হবেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আমৃত্যু শাসক
১৯৯২ সালে কিম ইল-সুং তাঁর স্মৃতিকথা লিখতে ও প্রকাশ করতে শুরু করেন৷ নাম দিয়েছিলেন ‘এক শতাব্দীর স্মৃতি’৷ স্মৃতিকথায় কিম দাবি করেছেন যে, তিনি ছয় বছর বয়সে একটি জাপানি বিরোধী প্রতিবাদসভায় যোগদান করেন ও আট বছর বয়স থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট হন৷ ১৯৯৪ সালে কিমের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিকথা অসমাপ্তই থেকে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/JIJI Press
‘দ্য কিম ইজ ডেড, লং লিভ দ্য কিম’
পিতার মৃত্যুর পর কিম জং-ইল ক্ষমতা গ্রহণ করেন৷ ইতিপূর্বে তিনি বহু বছর ধরে ক্ষমতাশীল ওপরমহলের সদস্য ছিলেন৷ তাঁর ১৬ বছরের শাসনে দরিদ্র দেশটি দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে৷ কিন্তু কিম ও তাঁর পরলোকগত পিতাকে নিয়ে ব্যক্তিপূজার ঐতিহ্য অব্যাহত থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/KCNA via Korean News Service
উঠতি তারকা
রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে একটি সামরিক শিবিরে কিম জং-ইল-এর জন্ম হয়েছিল বলে উত্তর কোরিয়ার বাইরে ইতিহাসবিদদের ধারণা৷ কিন্তু কিমের সরকারি জীবনী অনুযায়ী, তাঁর জন্ম কোরিয়ার পবিত্র পাইচু পর্বতে, ১৯৪২ সালের ১৫ই এপ্রিল তারিখে, অর্থাৎ তাঁর বাবার জন্মদিনের ঠিক ৩০ বছর পরে৷ কিমের জন্মের সময় নাকি আকাশে একটি নতুন তারা ও একটি যমজ রামধনু দেখা দেয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
পারিবারিক জটিলতা
কিম জং-ইল তিনজন পৃথক মহিলার সঙ্গে মোট তিন পুত্র ও দুই কন্যার জনক হন৷ ১৯৮১ সালের এই ছবিটিতে কিমকে তাঁর পুত্র কিম জং-নাম-এর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, যিনি ২০১৭ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উত্তরাধিকারী
২০০৯ সালে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম খবর দেয় যে, কিম জং-ইল তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কিম জং-উনকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেছেন৷ ২০১০ সালে একটি সামরিক কুচকাওয়াজে দু’জনকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল৷ পরের বছর কিম জং-ইল পরলোকগমন করেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/V. Yu
পিতাপুত্র
পিয়ংইয়ং-এর কাহিনী অনুযায়ী, ২০১১ সালে কিম জং-ইল-এর মৃত্যুর সময় একাধিক রহস্যজনক ঘটনা ঘটে৷ পবিত্র পাইচু পর্বতের উপর একটি হ্রদে জমা বরফ বরফঝড় চলাকালীন হঠাৎ বিকট আওয়াজ করে ফেটে যায়৷ অপরদিকে পাহাড়ের গায়ে এক অগ্নিময়ী বার্তা ফুটে ওঠে৷ কিম জং-ইল-এর মৃত্যুর পর পিয়ংইয়ং-এ তাঁর বাবার মূর্তির পাশে কিম-এর একটি ২২ মিটার উঁচু মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রহস্যময় অতীত
ক্ষমতা গ্রহণের আগে কিম জং-উন পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরেই ছিলেন৷ তাঁর সঠিক বয়স নিয়েও বিতর্ক আছে৷ তবে তিনি ১৯৮২ ও ১৯৮৪ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে ধরে নেওয়া হয়৷ তাঁর শিক্ষা সুইজারল্যান্ডে বলে কথিত আছে৷ ২০১৩ সালে তিনি সাবেক মার্কিন বাস্কেটবল তারকা ডেনিস রডম্যান-এর সঙ্গে পিয়ংইয়ং-এ মিলিত হয়ে দুনিয়াকে চমকে দেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কিমাশ্চর্য
আগের কিমদের মতো কিম জং-উনকে নিয়েও নানা ‘কিম’-বদন্তি, অর্থাৎ কিংদন্তি রয়েছে৷ ২০১৫ সালে উত্তর কোরিয়ার শিক্ষকদের জন্য একটি নতুন ম্যানুয়ালে নাকি দাবি করা হয় যে, কিম তিন বছর বয়সেই গাড়ি চালাতে পারতেন৷ ২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার খবর: পাইচু পর্বতের উপর কিম-এর জন্য একটি স্মৃতিসৌধ সৃষ্টি করা হবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/Kctv
পারমাণবিক উচ্চাশা
পিতা ও পিতামহের চাইতে অনেক কম বয়সে ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও কিম শক্ত হাতে ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছেন৷ ২০১৭ সালে বিদেশে আততায়ীর হাতে তাঁর সৎভাই কিম জং-নাম-এর মৃত্যুর পর নির্মম একনায়ক হিসেবে পশ্চিমে কিম জং-উন-এর ভাবমূর্তি আরো দৃঢ় হয়েছে৷ এছাড়া কিম তাঁর দেশের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার অভূতপূর্ব ভাবে বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন৷