সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া তর্জনগর্জন কমিয়ে সুর নরম করা সত্ত্বেও সে দেশের সঙ্গে বাকি বিশ্বের যুদ্ধের আশঙ্কা কমেনি বলে সতর্ক করে দিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন৷ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও সে বিষয়ে একমত৷
বিজ্ঞাপন
উত্তর কোরিয়া সংকট সম্পর্কে আলোচনা করতে ক্যানাডার ভ্যাংকুভার শহরে ২০টি দেশের এক বৈঠক আয়োজন করা হয়েছিল৷ ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধে জাতিসংঘের কমান্ডে যেসব দেশ সক্রিয় ছিল, তাদের এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভারত ও সুইডেনের প্রতিনিধিরাও এই আলোচনায় যোগ দিয়েছেন৷ আমন্ত্রণ সত্ত্বেও চীন ও রাশিয়া কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি৷ এই বৈঠকের নিন্দা করে এই দুই দেশ বলেছে, এর ফলে হিতে বিপরীত হবে৷
টিলারসন উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে ট্রাম্প প্রশাসনের মনোভাব স্পষ্ট করে দিয়েছেন৷ তাঁর মতে,পিয়ং ইয়ং পরমাণু ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতির পথে চলেছে৷ আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা করছে না সে দেশ৷ এই অবস্থায় তারা নিজেরাই কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে৷ টিলারসন বলেন, উত্তর কোরিয়াকে বুঝতে হবে যে, বর্তমান সংকটের সামরিক সমাধান তাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না৷ তবে তাঁর মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সংকটের কূটনৈতিক সমাধানসূত্রে আগ্রহী৷
ট্রাম্প প্রশাসন উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক করে দিতে সে দেশের পরমাণু স্থাপনার উপর আগাম হামলা চালাতে পারে, সংবাদ মাধ্যমের একাংশে এমন প্রতিবেদন সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি টিলারসন৷ ট্রাম্প গোপনে সরাসরি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন-এর সঙ্গে কথা বলেছেন কিনা, সে বিষয়েও নীরব ছিলেন তিনি৷
আয়োজক দেশ ক্যানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড বলেন, অংশগ্রহণকারী দেশগুলি উত্তর কোরিয়ার উপরজাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা কড়া হাতে কার্যকর করার বিষয়ে একমত৷ সে দেশ যাতে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেতে না পারে, সে দিকেও কড়া নজর রাখতে চায় তারা৷ সেই সঙ্গে মারণাস্ত্র কর্মসূচির জন্য অর্থের জোগান বন্ধ করার পথ খুঁজছে এই সব দেশ৷
জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো বাকি বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বর্তমানে উত্তর কোরিয়া সুর নরম করে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে মুগ্ধ হলে চলবে না৷ তাঁর মতে, উত্তর কোরিয়ার উপর চাপ কমানোর সময় আসেনি৷ দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীও একই সুরে বক্তব্য রাখেন৷
ইনস্টাগ্রামের ছবিতে উত্তর কোরিয়া
প্রায়ই সংবাদপত্রের শিরোনামে থাকলেও উত্তর কোরিয়া দেশটি বিচ্ছিন্ন ও প্রায় অজানা৷ ব্রিটিশ ইনস্টাগ্রামার পিয়ের ডেপন্ট নিয়মিতভাবে উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে সেখানকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ছবি তোলার চেষ্টা করেন৷
ছবি: DW/P.Depont
অজানার আকর্ষণ
উত্তর কোরিয়া গোপনে থাকতেই পছন্দ করে, বলা হয়ে থাকে৷ দেশটি কিন্তু বিদেশি পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে৷ উত্তর কোরিয়ায় পর্যটক হওয়ার অর্থ, বিশেষ ‘গাইড’-রা প্রতিপদে সঙ্গে থাকবে ও নজর রাখবে৷ এ সব সত্ত্বেও পিয়ের ডেপন্ট সাত বার উত্তর কোরিয়া যাত্রা করেছেন ও সেখানকার সাধারণ মানুষদের ছবি তুলেছেন৷
ছবি: DW/P. Depont
পুঁজিবাদের ভূত?
ডেপন্ট প্রথম উত্তর কোরিয়ায় যান ২০১৩ সালে৷ সেযাবৎ কর্তৃত্ববাদী দেশটিতে পরিবর্তন এসেছে, বলে তিনি লক্ষ্য করেছেন৷ বিগত দু’তিন বছরের মধ্যে ‘‘পিয়ংইয়াংয়ে নিজের সম্পদ প্রদর্শন করাটা গ্রহণযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷’’ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও পিয়ংইয়াংয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাড়ছে ও প্রচুর বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে৷
ছবি: Pierre Depont
আলাপ করা সহজ নয়
ডেপন্ট দেখেছেন, পিয়ংইয়াংয়ের রাস্তায় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলা সহজ নয়৷ প্রথমত, গাইডদের একজন সবসময় কান খাড়া করে শোনে৷ দ্বিতীয়ত, স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের ফটো তুলতে দিতে বিশেষ পছন্দ করেন না৷ রাস্তাঘাটে মহিলারা ক্রমেই আরো ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে উঠছেন বটে, তবে সেটা প্রধানত বড় শহরগুলোয়৷
ছবি: DW/P. Depont
শহর বনাম গ্রাম
পিয়ংইয়াংয়ের মেট্রো স্টেশনটি দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়: মনে হবে যেন কারুকার্য করা শ্বেতপাথরের দেওয়ালের ওপর সুবিশাল ঝাড়বাতি ঝুলছে৷ ডেপন্টের কাছে উত্তর কোরিয়া ‘‘ফটো তোলার একটা আশ্চর্য জায়গা,’’ কেননা এখানে রাস্তাঘাটে কোনো বিজ্ঞাপন নেই৷ অপরদিকে শহরে স্বাচ্ছল্যের নানা চিহ্ন চোখে পড়লেও, গ্রামাঞ্চলে এখনও চরম দারিদ্র্য বিরাজ করছে৷
ছবি: Pierre Depont
টুরিস্টরা যা দেখতে পান না...
...তা হলো উত্তর কোরিয়ার গ্রামাঞ্চলের মানুষদের বাস্তবিক পরিস্থিতি৷ সামরিক খাতে বিপুল বিনিয়োগ করলেও, দেশটি কৃষিপ্রধানই রয়ে গিয়েছে৷ ‘‘প্রত্যেকটি ছোট ক্ষেতে চাষ করা হয়, প্রতি বর্গমিটার জমি ব্যবহার করা হয়,’’ বলেছেন ডেপন্ট৷
ছবি: Pierre Depont
মেকি প্রাচুর্য?
টুরিস্টদের শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় বৈকি, তবে বড় বড় কৃষি সমবায়ের গাইডেড টুরে৷ ডেপন্ট দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হামহুং-এর কাছে একটি কৃষি সমবায়ে যাওয়ার সুযোগ পান; সেখানকার ছোট্ট বাজারটিতে সুন্দর করে পণ্য সাজানো ছিল ও অনটনের কোনো চিহ্নই ছিল না – খুব সম্ভবত ‘‘শুধু লোক-দেখানো,’’ বলে ডেপন্ট মন্তব্য করেছেন৷
ছবি: DW/P.Depont
হালফ্যাশনের স্কুল, তবে সবার জন্য নয়
উত্তর কোরিয়ায় টুরিস্ট হিসেবে সেখানকার একটি এলিট স্কুল বা মডার্ন স্কুল না দেখে ছাড় নেই৷ সংডোওয়ান ইন্টারন্যাশনাল সামার ক্যাম্পটি পূর্ণ সংস্কারের পর আবার খোলা হয় ২০১৪ সালে৷ সেখানে ছেলেমেয়েরা সর্বাধুনিক আর্কেড গেম্স নিয়ে খেলছে আর তাদের ব্যবহারের জন্য গোটা বিশেক কম্পিউটার রাখা আছে দেখে ডেপন্টের মনে হয়, দৃশ্যটা ‘‘কিছুটা অবাস্তব৷’’
ছবি: DW/P.Depont
সর্বত্র মিলিটারি
দেশটির সত্তা ও সমাজের প্রাণকেন্দ্র হল মিলিটারি৷ দেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মিলিটারিতে কাজ করে৷ দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতার তুলনায় সামরিক খাতে পিয়ংইয়াংয়ের ব্যয় বিশ্বের বৃহত্তম মিলিটারি বাজেটগুলির মধ্যে পড়ে৷ উত্তর কোরিয়ার কচিকাঁচারা মিলিটারি প্রতীকে অভ্যস্ত – এমনকি খেলার জায়গাতেও৷
ছবি: Pierre Depont
কর্তাভজা
মিলিটারি, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং কিম জং-উন ও তাঁর পূর্বপুরুষদের ঘিরে ‘ব্যক্তি উপাসনা’ – এই হলো উত্তর কোরিয়ার কাহিনি৷ মহান নেতাদের কিংবদন্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে ও তাঁদের সুবিশাল মূর্তিগুলোর পরিচর্যায় যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, তা দেখে ডেপন্ট চমৎকৃত৷