ভূমধ্যসাগরের সব উদ্বাস্তু ত্রাণ জাহাজকে ইটালিতে প্রবেশ করতে দেওয়া দীর্ঘমেয়াদে সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন ইইউ-তে ইটালির দূত মাউরিৎসিও মাসারি৷ গত কয়েক দিনে দশ হাজারেরও বেশি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী ইটালিতে পৌঁছেছে৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপীয় অভিবাসন ও স্বরাষ্ট্র বিষয়ক কমিশনার দিমিত্রিস আভ্রামোপুলোস-এর সঙ্গে বুধবার তাঁর আলাপ-আলোচনায় মাসারিকে বিষয়টি বিশেষভাবে উত্থাপন করার নির্দেশ দেয়া হয়৷ ইটালির সরকারি কর্মকর্তাদের বিবৃতি অনুযায়ী, রোম যে বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট নয়, এই ‘বিধিবদ্ধ কূটনৈতিক পদক্ষেপ’ তারই সংকেত৷
আভ্রামোপুলোস পরে টুইটারে জানান, তিনি বিষয়টি নিয়ে ইটালির রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং ‘‘ইটালিতে (উদ্বাস্তুদের) আগমনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার পর আমাদের (ইইউ-এর) সমর্থন’’ ব্যক্ত করেছেন৷
রাষ্ট্রদূত মাসারি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, উদ্বাস্তুদের দেখাশোনায় ইটালির উদ্যোগ বিপুল, ও দেশটির ‘আন্তর্জাতিক দায়িত্বের পরিধি’ ছাড়িয়ে গেছে৷ দৃশ্যত মাসারি আভ্রামোপুলোসকে বলেছেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে (ইটালির) কর্তৃপক্ষের পক্ষে উত্তরোত্তর অভিবাসী আসতে দেওয়া সমস্যার৷’’ এক ইটালীয় কূটনীতিক জার্মান ডিপিএ সংসাদ সংস্থাকে এ কথা জানিয়েছেন৷
জীবন বাজি রেখে ইউরোপের পথে
অভিবাসনের আশায় বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকেই ইউরোপে আসছেন৷ ইটালির ‘পাসো ডেলা মর্তে’ হয়ে ইউরোপের আরো উত্তরের দেশগুলোতে আসতে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন অনেকে৷ ফটোসাংবাদিক ফেডেরিকো স্কপা ছিলেন তেমন শরণার্থীদের সঙ্গে....
ছবি: DW/F.Scoppa
গহীন জঙ্গল, দুর্গম পথ
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সভয়ে এগিয়ে চলেছে আফগান কিশোরদের একটি দল৷ সব সময় ভয় – পুলিশ যদি দেখে ফেলে! এই ভয় নিয়ে, দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরেই পেরোতে হবে ‘ডেথ পাস টু ফ্রান্স’৷ যাত্রা শেষ হতে এখনো ১২ কিলোমিটার বাকি৷
ছবি: DW/F.Scoppa
পদে পদে বিপদ
ইটালির ভেনটিমিগলিয়া শহর আর ফ্রান্সের মেতোঁর মাঝখান দিয়ে এক সময় হাইওয়ের টানেলের ভেতর দিয়ে, কখনো রেলপথ ধরে, কখনো বা গিরিপথ ধরে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেতে হয়৷ যে কোনো মু্হূর্তেই ঘটে যেতে পারে সমূহ বিপদ৷
ছবি: DW/F.Scoppa
তীব্র গতি, দৃষ্টি ক্ষীণ
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের্ অনেকেই প্রাণ হাতে নিয়ে এই হাইওয়ে টানেল ধরে ধরে হেঁটে পৌঁছাতে চান ফ্রান্স৷ জীবনের ঝুঁকি তাদের প্রায় প্রতি পদক্ষেপে৷
ছবি: DW/F.Scoppa
প্রকৃতির আশ্রয়ে, প্রকৃতির ভরসায়
কীভাবে যেতে হবে তা না জেনে, সঙ্গে কোনো খাবার না নিয়েও ‘ডেথ পাস’ দিয়ে যাত্রা শুরু করেন অনেকে৷ প্রকৃতির উদারতাই তাদের একমাত্র ভরসা৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের রুখতে ফরাসি সরকার তৈরি করেছিল এই প্রাচীর৷ শান্তির পতাকাও ওড়ানো হয় তখন৷ ইটালি ও ফ্রান্স সীমান্তের এই এলাকটি অভিবাসন প্রত্যাশীদের খুব পরিচিত রুট৷
ছবি: DW/F.Scoppa
ওই দেখা যায়..
৩০০ মিটার দূরেই ‘ডেথ পাস’-এর শীর্ষ বিন্দু৷ সেদিকেই তাকিয়ে আছে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ন তিন অভিবাসন প্রত্যাশী৷ এখানে অনেকেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে৷ পুলিশ ধরলেই ফিরিয়ে দেয় ইটালিতে৷
ছবি: DW/F.Scoppa
7 ছবি1 | 7
‘‘আমরা যা কিছু করি, আমাদের সকলেরই মানুষের জীবন বাঁচানোর একটা মানবিক দায়িত্ব আছে,’’ আভ্রামোপুলোস বুধবার বলেন৷ ‘‘স্বভাবতই আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকটি ইইউ দেশকে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বলতে পারি না,’’ তিনি যোগ করেন৷
ইটালির উপর মাত্রাধিক চাপ
পরিস্থিতি না বদলালে, ইটালি অন্যান্য দেশের পতাকাবাহী জাহাজ বা কোনো ইউরোপীয় অভিযানের অংশ নয় এমন সব জাহাজকে ইটালির বন্দরে নোঙর ফেলতে দিতে অস্বীকার করতে বাধ্য হতে পারে বলে ইটালির কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে৷
এর ফলে বিভিন্ন এনজিও-র কাজ ব্যাহত হবে এবং অ-ইটালীয় বাণিজ্যিক জাহাজগুলিকে ভূমধ্যসাগরে উদ্বাস্তু ত্রাণ অভিযান পরিচালনা থেকে বিরত করবে, কেননা তারা উদ্ধারকৃত উদ্বাস্তুদের ইটালির বন্দরে নিয়ে আসতে পারবে না৷ অপরদিকে বহিঃসমুদ্রে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করা বাণিজ্যপোতসহ যাবতীয় সমুদ্রগামী যানের আন্তর্জাতিক আইনগত দায়িত্ব ও কর্তব্য৷
ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর মোট ৭৬,৮৭৩ জন অভিবাসী ইটালির উপকূলে পৌঁছেছেন, যা কিনা ২০১৬ সালের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি৷ এছাড়া বিগত কয়েক দিনে যে ১০,০০০ অভিবাসীকে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে৷ তাদেরও ঐ পরিসংখ্যানে ধরা হয়নি৷
এনজিও চাপের মুখে
সীমানাবিহীন চিকিৎসক বা এমএসএফ-এর অ্যাকোয়ারিয়াস নামধারী জাহাজটি গত বুধবার ১,০৩২ জন উদ্বাস্তুকে উদ্ধার করে৷ এমএসএফ-এর একটি টুইটে বলা হয়েছে, লিবিয়া থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের এক-চতুর্থাংশ নারী ও শিশু৷
‘ইউগেন্ড রেটার’ ও ‘সি ওয়াচ’-এর মতো সাগরে উদ্বাস্তু ত্রাণের জার্মান চ্যারিটিগুলিও ইটালির বন্দরে নোঙর না ফেলতে পারলে তাদের কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হবে৷
অপরদিকে ইইউ-এর সীমান্ত সংস্থা ফ্রন্টেক্স-এর কার্যনির্বাহী পরিচালক ফাব্রিচে লেগেরি বুধবার বলেছেন যে, লিবিয়া থেকে বিপুল সংখ্যক নৌকা আসাটা ‘খুবই উদ্বেগজনক’৷ আগে কখনো এত কম সময়ের মধ্যে এত বেশি বোট আসতে দেখা যায়নি বলে লেগেরি জানান৷
অভ্যন্তরীণ রাজনীতি
ইটালির ক্ষমতাসীন মধ্য-বাম সরকার অভিবাসনের প্রসঙ্গটি নিয়ে চাপে পড়েছে৷ জুনের সূচনায় পৌর নির্বাচনে ইটালির মধ্যমপন্থি-দক্ষিণপন্থি বিরোধীদলগুলি ভালো ফল করেছে, প্রধানত অভিবাসনের প্রশ্নে কড়া অবস্থান নিয়ে৷ রক্ষণশীল নর্দার্ন লিগের প্রধান মাতেও সালভিনি এমনকি ‘অনুপ্রবেশ রোখো’, এই স্লোগানও দিয়েছেন৷ পপুলিস্ট দল ফাইভ স্টার মুভমেন্টও নতুন অভিবাসীদের আগমন রোখার দাবি জানিয়েছে৷
ইইউ রাষ্ট্রদূত মাসারির সর্ব শেষ আলাপ-আলোচনা সম্পর্কে ইটালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনির ‘ফর্ৎসা ইতালিয়া’ দল বলেছে সরকারের এই উদ্যোগ তাদেরই তাগিদে৷
এসি/এসিবি (ডিপিএ, রয়টার্স)
ইটালির যে গ্রামের প্রাণ ফিরিয়েছেন শরণার্থীরা
দক্ষিণ ইটালির এসপ্রোমন্টে পর্বতমালার পাদদেশের এক গ্রাম ক্রমশ যেন নির্জীব হয়ে যাচ্ছিল৷ তবে এখন শরণার্থীদের পদচারণায় অনেকটাই সজীবতা ফিরেছে সেখানে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
শরণার্থী এবং স্থানীয়দের সুবিধা
দক্ষিণ ইটালির এসপ্রোমন্টের ছোট্ট সেন্ট’আলেসিও গ্রামের বাসিন্দারা গত তিন বছর ধরে পরিবার এবং অভিবাসীদের স্বাগত জানাচ্ছেন৷ এক প্রকল্পের আওতায় এটা করা হচ্ছে, যা শুধু মানবিক সহায়তাও নয় অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সুযোগ সুবিধাও দিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
প্রায় মরুতে পরিনত হওয়া গ্রাম
শরণার্থীরা আসার আগের বছরগুলোতে সেন্ট’আলেসিও’র বাসিন্দার সংখ্যা ক্রমশ কমছিল৷ সেখানে ছিল মাত্র ৩৩০ জন বাসিন্দা, যাদের অধিকাংশই বৃদ্ধ৷ গ্রামের রাস্তাঘাটগুলো হয়ে যাচ্ছিল মরুভূমির মতো, ঘরবাড়ির জানালাও থাকতো অধিকাংশ সময় বন্ধ৷ আসলে ভালো কাজের আশায় গ্রামটির অধিকাংশ বাসিন্দা পাড়ি দেন টুরিন, মিলান এমনকি অস্ট্রেলিয়া অবধি৷ ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
অভিবাসীদের জন্য ইটালীয় রান্নার প্রশিক্ষণ
গ্রামের পরিস্থিতি বদলের জন্য স্থানীয় কাউন্সিল অভিবাসীদের জায়গা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷ রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী এবং শরণার্থীদের নেটওয়ার্ক এসপিআরএআর’এর সহায়তায় ৩৫ অভিবাসীকে গ্রামের আটটি খালি ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া হয়৷ ছবিতে অভিবাসীরা রান্নার ক্লাসে অংশ নিচ্ছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
‘একটু নড়াচড়া ভালো’
গ্রামের একমাত্র বারে স্থানীয় এবং অভিবাসীরা একত্রে সময় কাটান৷ বারটির মালিক ক্যালেস্টিনা বোরেলো, যার ছেলে ভালো কাজের আশায় গ্রাম ছেড়ে বেলজিয়ামে চলে গেছেন কয়েকবছর আগে৷ ক্যালেস্টিনা জানান, গ্রামটি ক্রমশ জনশূণ্য হয়ে যাচ্ছিল, তবে এখন যে অল্পবিস্তর ‘নড়াচড়া’ সৃষ্টি হয়েছে তা অবশ্যই ভালো৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
অভিবাসীদের দেয়া হচ্ছে সব সুযোগ
গ্রামটিতে বর্তমানে ইরাকি কুর্দিদের এক পরিবার, ঘানা, নাইজেরিয়া, মালি, সেনেগাল এবং গাম্বিয়ার কয়েকজন অল্পবয়সি অভিবাসী বসবাস করছেন৷ তাদের সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে৷ বিশেষ করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে কাজের সুযোগ, ভাষা শেখার ব্যবস্থা, আইনি সহায়তা, এমনকি প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসাও দেয়া হচ্ছে৷ সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেও স্থানীয়দের সঙ্গে অভিবাসীদের যুক্ত করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
আশাবাদী মেয়র
গ্রামের মেয়র স্টেফেনো কালাবোরো মনে করেন, অভিবাসীদের আশ্রয় দেয়ার প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সুবিধাও নিশ্চিত হচ্ছে৷ এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১৬ জনের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে, যারা পার্টটাইম বা ফুলটাইম কাজ করছেন৷ ষোল জনের মধ্যে সাতজন স্থানীয় বাসিন্দা৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Solaro
খেলার মাঠে সখ্যতা বাড়ানো
স্থানীয় এবং অভিবাসীদের মধ্যে সখ্য বাড়ানোর এক উপায় এই ফুটবল খেলার মাঠ৷ পাশাপাশি গ্রামের অধিবাসীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার বার, সুপারমার্কেট, চিকিৎসকের চেম্বার, যেগুলো কিনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সবই এখন চালু রাখা যাবে৷