কোলোন শহরে মহিলাদের ব্যাপক যৌন হয়রানির পর জার্মান রাজনীতিকরা বিদেশি অপরাধীদের বহিষ্কার করার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু জার্মান – এবং আন্তর্জাতিক – আইন কী বলে?
বিজ্ঞাপন
নববর্ষের রাত্রিতে কোলোনের মুখ্য রেলওয়ে স্টেশনের সামনের চত্বরে কারা দঙ্গল বেঁধে মহিলাদের যৌন হয়রানি করেছিল ও মোবাইল ফোন ইত্যাদি চুরি করেছিল, তা নির্ধারিত হতে এখনও অনেক বাকি৷ প্রত্যক্ষদর্শিরা আরব কিংবা উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত চেহারার মানুষদের কথা বলেছেন৷ অকুস্থলে যে সব পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের বিবরণ অনুযায়ী ঐ দঙ্গলে সিরিয়া থেকে আসা উদ্বাস্তুরাও ছিলেন৷ এ সবই তদন্তসাপেক্ষ৷
জার্মান রাজনীতিক মহল কিন্তু গোড়া থেকেই সোচ্চার৷ বাভারিয়ার খ্রিষ্টীয় সামাজিক ইউনিয়ন বা সিএসইউ দলের সাধারণ সম্পাদক আন্ড্রেয়াস শয়ার বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বা উদ্বাস্তুরা যদি আতিথেয়তার এরকম নির্লজ্জ অপব্যবহার করেন, তার একমাত্র ফলশ্রুতি হতে পারে এই যে, অবিলম্বে তাদের জার্মানিতে বসবাসের অধিকারের অবসান ঘটবে৷''
পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী ইউনিয়ন বা সিডিইউ দলের টোমাস ডেমেজিয়ের একই কথা বলেছেন৷ তিনি চান যে, বর্তমান আইনগত পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হোক, কেননা বর্তমান আইনে কোনো উদ্বাস্তু বা রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী তিন বছর বা তার বেশি মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, একমাত্র সেক্ষেত্রেই তার ‘রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস' প্রভাবিত হবে৷
ডেমেজিয়ের-এর আগেই কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী, সামাজিক গণতন্ত্রী এসপিডি দলের হাইকো মাস অনুরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বলেন যে, কোলোনের আক্রমণকারীরা যদি বাস্তবিক রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হয়, তবে তাদের বহিষ্কার করার কথা ভাবাই যেতে পারে৷ মাস বলেন, ‘‘এমনকি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্তির প্রক্রিয়া চলাকালীনই আবেদনকারীকে বহিষ্কার করা চলে, যদি তার এক বছর বা তার বেশি কারাদণ্ড হয়ে থাকে৷''
আইন কী বলে
ডেমেজিয়ের বলছেন তিন বছর, মাস বলছেন এক বছরের কারাদণ্ডের কথা৷ এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, আইনগত পরিস্থিতি জটিলতর৷ বস্তুত রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের বহিষ্কার করার জন্য এক বছরের কারাদণ্ডই যথেষ্ট৷ কিন্তু যারা উদ্বাস্তু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তিন বছরের কম কারাদণ্ডের ক্ষেত্রে তাদের বহিষ্কার করা সম্ভব নয়৷
জার্মানিতে এত শরণার্থী চায় না তারা
শরণার্থীরা তাদের গন্তব্য হিসেবে জার্মানিকে বেছে নিচ্ছে৷ জার্মানিও তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে৷ কিন্তু জার্মানিতে এত শরণার্থী চান না অনেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘বিশ্বাসঘাতক’ ম্যার্কেল
জার্মানির ইসলাম ও অভিবাসী বিরোধী গোষ্ঠী পেগিডার হাজার হাজার সমর্থক সোমবার জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে৷ শরণার্থীদের প্রতি নরম মনোভাবের কারণ তারা ম্যার্কেলের বিরুদ্ধে ‘উচ্চ পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতা’ ও ‘জার্মানির মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ’-এর অভিযোগ আনেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Settnik
শরণার্থীদের নিয়ে কটূক্তি
পেগিডার (প্যাট্রিয়টিক ইউরোপিয়ান অ্যাগেনস্ট দ্য ইসলামাইজেশন অফ দ্য অক্সিডেন্ট) প্রতিষ্ঠাতা লুটৎস বাখমান সম্প্রতি শরণার্থীদের ‘পশু’, ‘আবর্জনা’ ও ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ বলে আখ্যায়িত করেন৷ এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O.Berg
সমাজে অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়
সোমবার বিক্ষোভের সময় বাখমান বলেন, শরণার্থীর সংখ্যা দেড় কিংবা দুই মিলিয়নেই থেমে থাকবে না৷ এরপর আসবে তাদের স্ত্রী; আসবে এক, দুই কিংবা তিন সন্তান৷ ফলে এতগুলো লোকের জার্মান সমাজে অন্তর্ভুক্তির কাজ অসম্ভব হয়ে পড়বে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Settnik
জার্মান সরকারের অস্বীকার
জার্মানির জনপ্রিয় পত্রিকা ‘বিল্ড’ সরকারের গোপন ডকুমেন্টের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, চলতি বছর জার্মানিতে প্রায় দেড় মিলিয়ন শরণার্থী আসবে বলে মনে করছে সরকার৷ যদিও প্রকাশ্যে সরকার বলছে সংখ্যাটা এক মিলিয়ন হতে পারে৷ তবে জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র এ ধরনের কোনো গোপন ডকুমেন্টের কথা তিনি জানেন না বলে সাংবাদিকদের বলেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Thalia Engel
শরণার্থীর মৃত্যু
জার্মানির পূর্বাঞ্চলের এক শরণার্থীদের বাসস্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইরিত্রিয়া থেকে আসা ২৯ বছরের এক শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে৷ অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনও জানা যায়নি৷ এদিকে, জার্মান সরকারের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর শরণার্থী ও তাদের বাসস্থানের উপর হামলার সংখ্যা বেড়েছে৷ এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই এরকম ২০২টি ঘটনা ঘটেছে বলে সরকার জানিয়েছে, যেখানে গত বছর সংখ্যাটি ছিল ১৯৮৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিপদে ম্যার্কেল
শরণার্থীদের সঙ্গে এমন আচরণের কারণে নিজ দল সহ অন্যান্য দলের রাজনীতিবিদদের তোপের মুখে পড়েছেন ম্যার্কেল৷ তাঁরা জার্মানির শরণার্থী নীতি ও শরণার্থীদের আগমনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চ্যান্সেলরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
6 ছবি1 | 6
সংশ্লিষ্ট আইনটি পাওয়া যাবে ‘জার্মান রেসিডেন্সি অ্যাক্ট'-এর ৬০ নং ধারায়: ‘‘(উদ্বাস্তু হিসেবে স্বীকৃতি) প্রযোজ্য হবে না, যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণে সংশ্লিষ্ট বিদেশি/বহিরাগতকে ফেডারাল জার্মান প্রজাতন্ত্রের নিরাপত্তার পক্ষে একটি হুমকি বলে গণ্য করা হয়; অথবা সংশ্লিষ্ট বিদেশি যদি আপামর জনসাধারণের পক্ষে একটি ঝুঁকি হয়, কেননা তাকে কোনো অপরাধ বা গুরুতর আইনভঙ্গের দরুণ অন্তত তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে৷''
আইনের এই সূত্রটি পরিবর্তন করার কথা ভাবতে হবে, বলেছেন ডেমেজিয়ের৷ সমস্যা হলো এই যে, বহিষ্কার তো করা হবে; কিন্তু কোথায়? ‘জার্মান রেসিডেন্সি অ্যাক্ট' বলে, যেখানে বহিষ্কৃত ব্যক্তির গুরুতর হানি, মৃত্যুদণ্ড বা অপরাপর মানবাধিকার ভঙ্গের সম্ভাবনা আছে, তেমন সব দেশে কারুকে বহিষ্কার করা চলবে না৷ এখানেও একটা ফাঁক বা ফাঁকি আছে, বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা৷ বিদেশিকে তার স্বদেশে ফেরৎ না পাঠানো গেলে, অন্য কোনো দেশে পাঠানো যেতে পারে, যে দেশ তাকে নিতে প্রস্তুত – উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে যা প্রযোজ্য৷
বহিষ্কার বিরোধীরা একদিকে জার্মান সংবিধান, অন্যদিকে জেনেভা চুক্তির দোহাই দিচ্ছেন৷ তাদের আরো একটি যুক্তি হলো: এক বছর না তিন বছরের কারাদণ্ড, সেটা প্রশ্ন নয়৷ প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্ট পকেটমার বা নারী নির্যাতনকারী কি সেই কারাদণ্ড ভোগ করার পরেও ভবিষ্যতের জন্য একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে? নয়ত জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী উদ্বাস্তু হিসেবে তার যে সুরক্ষা পাওয়ার কথা, তা প্রত্যাহার করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না৷
জার্মানিতে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের আগমন শুধু সরকারি ব্যবস্থাপনাকেই বিপদের মুখে ফেলেনি, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তার ছাপ ফেলেছে: চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল-এর জনপ্রিয়তা আজ কমতির দিকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Gebert
উদ্বাস্তু শিবিরে দাঙ্গা
হামবুর্গ শহরের ভিলহেল্মসবুর্গ এলাকায় শরণার্থীদের প্রাথমিক আশ্রয়কেন্দ্রটি ভরে যাওয়ায় আগন্তুকদের তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়৷ মঙ্গলবার (৬ই অক্টোবর) সেখানে আফগানিস্তান ও আলবেনিয়া থেকে আগত উদ্বাস্তুদের মধ্যে ব্যাপক দাঙ্গা বাঁধে৷ লোয়ার স্যাক্সনি-র ব্রাউনশোয়াইগ-এও অনুরূপভাবে আলজিরীয় ও সিরীয় উদ্বাস্তুদের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধে একটি চুরির অভিযোগকে কেন্দ্র করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Charisius
ইসলাম বিরোধীরা আবার মাথা চাড়া দিয়েছে
ড্রেসডেনে ইসলাম বিরোধী পেগিডা গোষ্ঠীর বিক্ষোভ সমাবেশে গত সোমবার প্রায় ন’হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন৷ বিক্ষোভকারীরা মূলত চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল-কেই বর্তমান উদ্বাস্তু সংকটের জন্য দায়ী করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Settnik
ম্যার্কেল লাগাম টানলেন
চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল দৃশ্যত তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টোমাস ডেমেজিয়ের-এর গুরুত্ব কিছুটা খর্ব করে চ্যান্সেলরের দপ্তরের প্রধান পেটার আল্টমায়ার-কে শরণার্থী সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
উদ্বাস্তুর লাশ
টুরিঙ্গিয়া রাজ্যের সালফেল্ড-এ অবস্থিত একটি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী আবাসে সোমবার একটি অগ্নিকাণ্ডের পর ২৯ বছর বয়সি এক ইরিট্রিয়ান উদ্বাস্তুর লাশ পাওয়া যায়৷ কিভাবে এই শরণার্থী প্রাণ হারিয়েছেন, তা এখনও অজ্ঞাত৷ তবে আবাসটিতে ইচ্ছাকৃতভাবে অগ্নিসংযোগের কোনো হদিশ পুলিশ এখনও পায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যে কোনো পন্থায়
টুরিঙ্গিয়ায় এর আগেও উদ্বাস্তু আবাস হিসেবে চিহ্নিত বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে শরণার্থীদের আসা বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ যেমন বিশহাগেন-এর এই বাড়িটির ছাদ পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছে৷ গত সোমবার এখানে প্রথম উদ্বাস্তুদের আসার কথা ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Gränzdörfer
ঘরে বাইরে
শরণার্থী সংকট এখন জার্মানির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও টান ধরাচ্ছে৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেলের সিডিইউ দলের জোড়োয়া দল বাভারিয়ার সিএসইউ৷ তাদের প্রধান হর্স্ট জেহোফার সেপ্টেম্বর মাসের শেষে একটি দলীয় সম্মেলনে বক্তা হিসেব আমন্ত্রণ জানান হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অর্বান-কে, যিনি সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে উদ্বাস্তুর স্রোত আটকানোর চেষ্টা করেছেন৷
ছবি: Reuters/M. Dalder
হাওয়া যদি বদলায়
বাভারিয়ার অর্থমন্ত্রী মার্কুস জ্যোডার ইতিপূর্বেও বলেছেন: ‘‘আমরা (অর্থাৎ জার্মানি) বিশ্বকে বাঁচাতে পারি না৷’’ এমনকি তিনি অস্ট্রিয়া সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কথাও চিন্তা করেছেন৷ তবে জ্যোডার যখন সম্প্রতি রাজনৈতিক আশ্রয় প্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকার সীমিত করার কথা বলেন, তখন জেহোফার স্বয়ং সাথে সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন৷