উদ্বাস্তুদের সুরক্ষা
১ অক্টোবর ২০১৪দু'জন রক্ষী ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছেন৷ তাদের একজনের পা মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকা এক পুরুষের গলায় - পুরুষটির হাত দু'টি তার পিছনে বাঁধা৷ ভীতিজনক দৃশ্য, যা মার্কিন গুয়ান্টানামো বন্দিশিবির কিংবা ইরাকের আবু ঘ্রেইব কারাগারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়৷ ছবিটা কিন্তু ইরাকে নয়, জার্মানিতে তোলা, নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের বুয়রবাখ শহরের একটি উদ্বাস্তু শিবিরে, যেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
পুলিশ ছবিটা খুঁজে পেয়েছে সংশ্লিষ্ট দু'জন রক্ষীর একজনের মোবাইল টেলিফোনে, কিন্তু তার আগেই একটি অনুরূপ চমকে দেওয়ার মতো ভিডিও থেকে তদন্তের সূত্রপাত ঘটে৷ নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের অপরাপর উদ্বাস্তু শিবির থেকেও শিবিরবাসীদের উপর শিবির রক্ষীদের শারীরিক নির্যাতন ও নিপীড়নের হদিশ পাওয়া গিয়েছে - এবং সে সব জায়গাতেও তদন্ত চলেছে৷
বেসরকারি নিরাপত্তা সেবা
জার্মানিতে এই ‘অ্যাসাইলাম হোম'-গুলি হলো শরণার্থীদের প্রথম আবাস, এ'দেশে বসবাসের পথে প্রথম পদক্ষেপ৷ উদ্বাস্তুদের মধ্যে অনেকেই বহু দুঃখ-দুর্দশা পার হয়ে এসেছেন৷ তারা সহিংসতা ও অত্যাচারের হাত থেকে পলায়ন করেছেন৷ যে সব মানুষরা এ'দেশে আশ্রয়, সুরক্ষা, নিরাপত্তার খোঁজে এসেছেন, তাদের যে এ'ধরনের নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছে, সেটা একটা কেলেঙ্কারি৷
ব্যাখ্যা হিসেবে সংশ্লিষ্ট রাজ্য ও পৌর প্রশাসনগুলি বারংবার বলছে যে, উদ্বাস্তুদের চাপ ক্রমাগত বেড়ে চলার ফলে তাদের সামর্থ্যে কুলোচ্ছে না৷ সেই কারণেই উদ্বাস্তুদের আবাসনের ব্যবস্থা বহুদিন আগে থেকেই বেসরকারি সংস্থাগুলির হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে - এবং সেটা ব্যয় তথা আমলাতন্ত্র কমানোর উদ্দেশ্যেও৷
বেসরকারি সংস্থাগুলি যে কোনো পৌর কিংবা রাজ্য প্রশাসনের হয়ে ব্যবস্থাপনা করবে, তা'তে দোষের কিছু নেই - বিশেষ করে এমন একটা সময়ে, যখন জার্মানিতে শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে৷ আসল সমস্যা হলো এই যে, বহু পৌর ও রাজ্য প্রশাসন পরিষেবার মানের পরিবর্তে ব্যয়সংকোচকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে৷
বুয়রবাখ'এর ঘটনায় তার ফলশ্রুতি হয়েছে গুরুতর: সেখানে উদ্বাস্তু আবাসন চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় ইউরোপিয়ান হোম কোয়ার বা ইএইচসি নামধারী একটি বেসরকারি সংস্থাকে; তারা আবার নিয়োগ করে এসকেআই নামধারী এক সাব-কন্ট্র্যাক্টর সংস্থাকে; বুয়রবাখ অ্যাসাইলাম হোম'এ যে সব রক্ষী উদ্বাস্তুদের উপর অত্যাচার করেছেন, তারা এই এসকেআই সংস্থার কর্মী৷ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে, এই রক্ষীদের পুলিশের খাতায় নাম আছে: তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই মারধর, মাদক কিংবা অস্ত্রের বেআইনি মালিকানা, এমনকি জুয়াচুরির অভিযোগে তদন্ত চলেছে৷ একটি অ্যাসাইলাম হোম'এ এদের চাকরি পাবারই কথা নয়৷
একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সেবা যে প্রধানত অর্থোপার্জনের জন্য ব্যবসা করবে, তা'তে আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ সেই ব্যবসায় কম পারিশ্রমিক কিংবা কাজের অপ্রীতিকর পরিবেশ ও শর্তাবলীও নতুন কিছু নয়৷ ব্যবস্থাপক হিসেবে উদ্বাস্তুদের প্রতি ভদ্র আচরণ নিশ্চিত করতে হলে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং আন্তঃ-সাংস্কৃতিক মনোবৃত্তির কর্মী দরকার - অর্থাৎ এমন কর্মী নয়, যাদের পুলিশের খাতায় নাম লেখানো আছে৷
কাজেই যাবতীয় কর্মী ও তাদের কাজের উপর শুধু বেসরকারি সংস্থাটিকেই নয়, বরং ঐ সংস্থাকে যে প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেছে, তাকেও নজর রাখতে হবে৷ বেসরকারি পরিষেবা নিয়োগের অর্থ এ' হতে পারে না যে, যাদের সুরক্ষার প্রয়োজন, রাষ্ট্র তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব থেকে রেহাই পাবে৷
এখন থেকে সব কিছু ঠিকঠাক হবে?
ইউরোপিয়ান হোমকেয়ার এবং আর্নসব্যার্গ'এর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আপাতত জনসংযোগ নিয়ে ব্যস্ত৷ সংশ্লিষ্ট বেসরকারি নিরাপত্তা সেবার চুক্তি বাতিল করা হয়েছে৷ ভবিষ্যতে যাতে এ'ধরনের ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করার জন্য নতুন মান নির্দিষ্ট করা হয়েছে, বলে জানিয়েছে ইউরোপিয়ান হোম কেয়ার: আগামীতে সব খোঁজখবর করার পরে পুলিশ সার্টিফিকেট দেখে অ্যাসাইলাম হোম'এর কর্মী নিয়োগ করা হবে, যা'কে সর্বনিম্ন দাবি বা স্বতঃসিদ্ধ পন্থা বলা চলতে পারে, যদিও তা যথারীতি অপ্রীতিকর ঘটনাগুলি ঘটার পর ঘটছে৷ যে সব মানুষ জার্মানিতে সুরক্ষা খুঁজছেন, তাদের এই নিশ্চয়তা থাকা চাই যে, তারা সত্যিই এখানে সুরক্ষা পাবেন৷ পৌর প্রশাসনের সে বাজেট থাক আর নাই থাক, শুধু বাজেটের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান খোঁজা উচিত নয়৷ জার্মানির মতো একটি সমৃদ্ধ দেশের পক্ষে সেটা গ্রহণযোগ্য নয়৷