সিরিয়া বা আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ; সাহারার দক্ষিণে খরা ও দুর্ভিক্ষ; উত্তর আফ্রিকায় চরম আশাহীনতা – সব মিলিয়ে ইউরোপ অভিমুখে অভূতপূর্ব উদ্বাস্তুর স্রোত৷ যার ফল কুড়োচ্ছে চরম দক্ষিণপন্থিরা, বলে গ্রেহাম লুকাসের অভিমত৷
বিজ্ঞাপন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হচ্ছে ও তার অব্যবহিত পরে ইউরোপ তথা জার্মানি এই ধরনের উদ্বাস্তু বা শরণার্থীর স্রোত দেখেছিল বটে৷ রিফিউজিদের প্রশ্নে ইউরোপ আজ দ্বিধাবিভক্ত: একদিকে জার্মানি বা সুইডেনের মতো দেশ, যারা উদ্বাস্তুদের নিচ্ছে; অপরদিকে হাঙ্গেরি বা পোল্যান্ডের মতো দেশ, যারা উদ্বাস্তুদের নিতে গররাজি – ব্রিটেনকেও যে দলে ফেলা যায়৷
কিন্তু গত কয়েক মাসে উদ্বাস্তু সংকট যত চরমে উঠেছে, ততই ইউরোপীয় রাজনীতির ধারা যেন ডানদিকে ঘুরেছে৷ জার্মানিতে দক্ষিণপন্থি মনোভাবের মানুষজন বলছেন, আঙ্গেলা ম্যার্কেল যদি তাঁর উদ্বাস্তুরা স্বাগতম নীতি না বদলান, তাহলে তাঁর চ্যান্সেলরশিপের এখানেই অন্ত ঘটতে পারে৷ আগামী প্রাদেশিক নির্বাচনগুলিতে ‘জার্মানির জন্য বিকল্প' নামধারী এএফডি দল, যারা অতিমাত্রায় উদ্বাস্তু ও বহিরাগত বিরোধী, তারা বিপুল ভোট সংগ্রহ করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে – বিশেষ করে থার্টি ফার্স্ট নাইটে কোলনে যা ঘটেছে, তার পরে৷ ফ্রান্সেও আগামী বছরের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনে চরম দক্ষিণপন্থিদের ভালো ফলাফল করার সম্ভাবনা বাড়ছে৷
ইউরোপে শরণার্থী সংকট চরমে
অস্ট্রিয়ার মোটরওয়েতে পরিত্যক্ত হিমায়ন যুক্ত ট্রাকটি থেকে এ যাবৎ ৭০টির বেশি লাশ পাওয়া গিয়েছে; লিবিয়ার উপকূলে আবার নৌকাডুবি হয়ে উদ্বাস্তুদের মৃত্যু৷ কিন্তু ইউরোপ এখনও বিভক্ত, দ্বিধাগ্রস্ত৷
ছবি: DW/E. Numanovic
অভিবাসীর মৃত্যু
হাঙ্গেরি থেকে ভিয়েনাগামী মোটরওয়েতে বৃহস্পতিবার ফেলে রাখা অবস্থায় যে রেফ্রিজারেটেড ট্রাকটি পাওয়া যায়, তা থেকে ৭০টির বেশি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, বলে ভিয়েনার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে৷
ছবি: Reuters/H.P. Bader
সলিলসমাধি
লিবিয়ার উপকূল থেকে ইটালি পৌঁছনোর প্রচেষ্টায় আরো একটি উদ্বাস্তু বোট ডুবে যায় বৃহস্পতিবার৷ বোটটি পশ্চিম লিবিয়ার জুওয়ারা বন্দর থেকে যাত্রা করছিল৷ লিবিয়ার উপকূলরক্ষীরা দু’শোর বেশি যাত্রীকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন, কিন্তু আরো দু’শতাধিক যাত্রী জাহাজের খোলে আটকা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ বোটটিতে প্রধানত সাব-সাহারান আফ্রিকা, পাকিস্তান, সিরিয়া, মরক্কো ও বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীরা ছিলেন৷
ছবি: Reuters/H. Amara
যাত্রী বোঝাই
লিবিয়ার উপকূলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্ধারকার্যের দায়িত্বে রয়েছে ইটালির উপকূলরক্ষী বাহিনী৷ তাদের বিবৃতি অনুযায়ী শুধুমাত্র বৃহস্পতিবারেই প্রায় ১,৪৩০ জন মানুষকে বিভিন্ন নৌ-অভিযানে উদ্ধার করা হয়৷ লিবিয়ার উপকূলরক্ষী বাহিনীর সামর্থ্য সীমিত, কেননা তাদের কাছে ছোট ছোট রবারের বোট, টাগবোট কিংবা মাছ ধরার নৌকা ছাড়া অন্য কোনো জলযান নেই৷
ছবি: Reuters/Swedish Coast Guard
কাঁটাতারের বেড়া
পাকানো কাঁটাতার ফেলে রেখে আর বিপুল সংখ্যায় পুলিশ পাঠিয়ে বুদাপেস্ট সরকার উদ্বাস্তুর স্রোত সামাল দেবার চেষ্টা করছেন৷ সার্বিয়ার সঙ্গে ১৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে একটি চার মিটার উঁচু তারের বেড়া তৈরির কাজ আগামী সোমবার শেষ হবার কথা৷ তার আগে উদ্বাস্তুরা কাঁটাতার পেরিয়ে অভীপ্স পশ্চিম ইউরোপ অভিমুখে আরো এক ধাপ অগ্রসর হবার চেষ্টা করছেন৷
ছবি: Reuters/L. Balogh
সীমান্তের পর সীমান্ত
বিশেষ করে সিরীয় উদ্বাস্তুরা গ্রিস থেকে ম্যাসিডোনিয়া হয়ে পশ্চিম ইউরোপ যাবার চেষ্টা করছেন৷ শুধুমাত্র বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার অবধি ১,২৮৮ জন উদ্বাস্তু এ ভাবে ম্যাসিডোনিয়ায় আসেন বলে স্কোপিয়ে সরকার জানিয়েছেন৷ উদ্বাস্তুদের নথিভুক্ত করে তিন দিন সময় দেওয়া হচ্ছে, রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন পেশ করার কিংবা দেশ ছাড়ার জন্য৷
ছবি: Annette Groth
হাঁটাপথে
সার্বিয়া থেকে হাঙ্গেরি-তে ঢোকার আর কোনো পথ খোলা না থাকুক, রেলপথ তো রয়েছে! সেই পথেই পায়ে হেঁটে স্বপ্নের ইউরোপের দিকে চলেছেন উদ্বাস্তুরা৷
ছবি: Reuters/L. Balogh
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘‘ব্যর্থতা’’
বৃহস্পতিবার ভিয়েনায় পশ্চিম বলকান সংক্রান্ত সম্মেলনে নেতারা ট্রাকে উদ্বাস্তুদের লাশ পাবার ঘটনা শুনে স্তম্ভিত ও বিমূঢ় হয়ে যান৷ ‘‘আমাদের ইউরোপীয় মনোবৃত্তি, অর্থাৎ সংহতির মনোভাব নিয়ে শীঘ্র এই অভিবাসন প্রশ্নের সমাধান করতে হবে’’, বলেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল (বাম থেকে দ্বিতীয়)৷
ছবি: DW/E. Numanovic
7 ছবি1 | 7
মার্কিন মুলুকে
সেখানেও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে এগিয়ে, তিনি হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ তাঁর প্রচার অভিযান চলেছে মূলত বহিরাগত ও মুসলিম বিদ্বেষের উপর নির্ভর করে৷ এককালে যাকে ঝড়তি-পড়তি ক্যান্ডিডেটদের মধ্যে ধরা হচ্ছিল, এখন তিনি আগামী নভেম্বরে বাস্তবিক হোয়াইট হাউস জয় করবেন কিনা, তা ভবিষ্যদ্বাণী করার, অথবা না করার ক্ষমতা কারো নেই৷
মার্কিন মুলুকে ট্রাম্পের জয়যাত্রা ইউরোপের চরম দক্ষিণপন্থিদের উদ্বুদ্ধ করেছে ও করছে৷ যার ফলে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের ‘‘স্বাগতম'' সংস্কৃতি আজ ধুঁকছে৷ ইউরোপ তথা জার্মানির মানুষ চাইছে হয় নীতিবদল, নয়ত পালাবদলের পালা৷ অথচ সেই মানুষরাই ভুলে যাচ্ছে, যে সব কারণ থেকে এই উদ্বাস্তুর স্রোত ও তথাকথিত উদ্বাস্তু সংকটের সৃষ্টি, তার অনেকটাই ২০০১ সালে আফগানিস্তান অথবা ২০০৩ সালে ইরাক অভিযানের দরুণ৷ পশ্চিমের পক্ষে সেই দায়িত্ব ভুলে যাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না৷
বন্ধু, আপনি কি গ্রেহেম লুকাসের সঙ্গে একমত? জানান নীচের ঘরে৷
জার্মানিতে এত শরণার্থী চায় না তারা
শরণার্থীরা তাদের গন্তব্য হিসেবে জার্মানিকে বেছে নিচ্ছে৷ জার্মানিও তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে৷ কিন্তু জার্মানিতে এত শরণার্থী চান না অনেকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘বিশ্বাসঘাতক’ ম্যার্কেল
জার্মানির ইসলাম ও অভিবাসী বিরোধী গোষ্ঠী পেগিডার হাজার হাজার সমর্থক সোমবার জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে৷ শরণার্থীদের প্রতি নরম মনোভাবের কারণ তারা ম্যার্কেলের বিরুদ্ধে ‘উচ্চ পর্যায়ের বিশ্বাসঘাতকতা’ ও ‘জার্মানির মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ’-এর অভিযোগ আনেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Settnik
শরণার্থীদের নিয়ে কটূক্তি
পেগিডার (প্যাট্রিয়টিক ইউরোপিয়ান অ্যাগেনস্ট দ্য ইসলামাইজেশন অফ দ্য অক্সিডেন্ট) প্রতিষ্ঠাতা লুটৎস বাখমান সম্প্রতি শরণার্থীদের ‘পশু’, ‘আবর্জনা’ ও ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ বলে আখ্যায়িত করেন৷ এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছে সরকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O.Berg
সমাজে অন্তর্ভুক্তি সম্ভব নয়
সোমবার বিক্ষোভের সময় বাখমান বলেন, শরণার্থীর সংখ্যা দেড় কিংবা দুই মিলিয়নেই থেমে থাকবে না৷ এরপর আসবে তাদের স্ত্রী; আসবে এক, দুই কিংবা তিন সন্তান৷ ফলে এতগুলো লোকের জার্মান সমাজে অন্তর্ভুক্তির কাজ অসম্ভব হয়ে পড়বে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Settnik
জার্মান সরকারের অস্বীকার
জার্মানির জনপ্রিয় পত্রিকা ‘বিল্ড’ সরকারের গোপন ডকুমেন্টের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, চলতি বছর জার্মানিতে প্রায় দেড় মিলিয়ন শরণার্থী আসবে বলে মনে করছে সরকার৷ যদিও প্রকাশ্যে সরকার বলছে সংখ্যাটা এক মিলিয়ন হতে পারে৷ তবে জার্মান সরকারের এক মুখপাত্র এ ধরনের কোনো গোপন ডকুমেন্টের কথা তিনি জানেন না বলে সাংবাদিকদের বলেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Thalia Engel
শরণার্থীর মৃত্যু
জার্মানির পূর্বাঞ্চলের এক শরণার্থীদের বাসস্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইরিত্রিয়া থেকে আসা ২৯ বছরের এক শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে৷ অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখনও জানা যায়নি৷ এদিকে, জার্মান সরকারের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর শরণার্থী ও তাদের বাসস্থানের উপর হামলার সংখ্যা বেড়েছে৷ এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই এরকম ২০২টি ঘটনা ঘটেছে বলে সরকার জানিয়েছে, যেখানে গত বছর সংখ্যাটি ছিল ১৯৮৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিপদে ম্যার্কেল
শরণার্থীদের সঙ্গে এমন আচরণের কারণে নিজ দল সহ অন্যান্য দলের রাজনীতিবিদদের তোপের মুখে পড়েছেন ম্যার্কেল৷ তাঁরা জার্মানির শরণার্থী নীতি ও শরণার্থীদের আগমনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চ্যান্সেলরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷