শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টরস কমান্ডারস ফোরাম ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ ২৭টি সংগঠনের ডাকা হরতাল এবং শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের রাজপথ-রেলপথ অবরোধ৷
বিজ্ঞাপন
২৪ ঘণ্টার এই হরতাল শেষ হবে শনিবার সন্ধ্যা ৬টায়৷ আর ২২ ঘণ্টার অবরোধ শেষ হবে বিকেল ৪টায়৷ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে বিকেল ৪টায় শুরু হবে সমাবেশ৷ এর আগে সকাল ১০টায় মতিঝিলে অনুষ্ঠিত হবে হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে একটি ইসলামি সংগঠনের লংমার্চ পরবর্তী সমাবেশ৷ একই দিনে এক পক্ষের হরতাল, অবরোধ আর সমাবেশ এবং অপর পক্ষের লংমার্চ পরবর্তী সমাবেশ, ফলে দেশবাসী গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে নজর রাখছে এসব কর্মসূচিতে৷ সবার প্রত্যাশা শান্তিপূর্ণভাবে যেন শেষ হয় এসব কর্মসূচি৷ কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হলে আগামী রবিবার থেকে টানা হরতাল ঘোষণার আভাস আগে থেকেই দিয়ে রেখেছে হেফাজতে ইসলামী৷ তাই সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস থেকেই নগরবাসী যে আরো বড় দুর্ভোগে পড়তে যাচ্ছেন তা আগে থেকেই অনুমান করা যায়৷
সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, লংমার্চ, হরতাল-অবরোধ কোন কর্মসূচিই জনগণ চায় না৷ এই ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চায় দেশের মানুষ৷ তিনি আরও বলেন, সব কর্মসূচিই প্রত্যাহার করে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব৷ কিন্তু পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয়ার কারণে চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছেন জনগণ৷
হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী শুক্রবার সকালেও সরকারকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, লংমার্চ তাদের রাজনৈতিক কোন কর্মসূচি নয়৷ ইমানী দায়িত্ব থেকে তারা এই আন্দোলন করছেন৷ তাদের আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়৷ আর এ আন্দোলন থেকে জামায়াত-শিবিরের সুবিধা পাওয়ার কোন সুযোগও নেই৷
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেছেন, সরকার ও বিরোধী দল সমঝোতায় না এলে দেশের পরিস্থিতি দিনদিন আরো অন্ধকারময় হয়ে উঠবে৷ তিনি বলেন, ‘এখন যে পরিস্থিতি তা এক কথায় ভয়াবহ৷' বিশ্লেষকরা বলছেন, হেফাজতের এই লংমার্চে বিএনপির-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট সমর্থন দেয়ায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে৷ বছর তিনেক আগে গঠন করা অখ্যাত এই হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশ তাই এখন চলে এসেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে৷ সৃষ্টি করেছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার৷
‘নাস্তিক ব্লগার’ ইস্যুতে ইসলামি দলের তাণ্ডব
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে কথিত ‘ধর্মনিন্দার’ অভিযোগে তাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ বাংলাদেশের কয়েক এলাকায় তাণ্ডব চালিয়েছে বিভিন্ন ইসলামি দল৷ এতে প্রাণহানিসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: Reuters
বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্র
শুক্রবার (২২.০২.১৩) দুপুর বারোটার দিকে বায়তুল মোকাররম এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ ১২টি ইসলামি ও সমমনা দল আগেই ঘোষণা দিয়েছিল, তাদের ভাষায় যেসব ব্লগার ইন্টারনেটে ‘ধর্মনিন্দা’ করে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখছে, তাদের ফাঁসির দাবিতে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর আন্দোলন করা হবে৷ কিন্তু সেই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই তাণ্ডবে রূপ নেয়৷ এতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হন৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘পরিকল্পিত অ্যাকশন’
ঢাকা থেকে আমাদের প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানিয়েছেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবেই সহিংস অ্যাকশনে গেল জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীরা৷ ব্লগে ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত কটূক্তির কথা বলে তাদের ভাষায় ‘মুরতাদ-নাস্তিকদের’ ফাঁসির দাবিতে আগেই শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর কর্মসূচি দেয়৷ আর আজ (২২.০২.১৩) জুম্মার নামাজের আগেই তারা তাণ্ডব শুরু করে৷’
ছবি: Reuters
শাহবাগে হামলার চেষ্টা
শুক্রবার (২২.০২.১৩) পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে ইসলামি দলের সদস্যরা শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোতে চাইলে সংঘর্ষ পল্টন হয়ে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ ককটেল, গুলি আর টিয়ার গ্যাসের সেলে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷ প্রায় একই সময়ে ঢাকার কাঁটাবনে শাহবাগ বিরোধীরা রাস্তায় নামে৷ তারাও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে৷ সেখানেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
ঢাকার বাইরে তাণ্ডব, প্রাণহানি
ঢাকার বাইরে চট্টগামের প্রেসক্লাবে হামলা হয়েছে৷ তাদের হামলায় পুলিশ এবং সাংবদিকসহ ২০ জন আহত হয়েছেন৷ বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, চাঁদপুরে গণজাগরণ মঞ্চে হামলা চালায় তারা৷ হামলা চালায় সিলেট শহীদ মিনারে৷ সেখানে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷ শুক্রবার বিকেল অবধি পাওয়া খবর অনুযায়ী, গাইবন্ধায় ২ জন এবং ঝিনাইদহে জাগরণ মঞ্চ বিরোধীদের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন৷
ছবি: Reuters
শাহবাগে জনতা
দেশব্যাপী ইসলামি দলগুলোর এই তাণ্ডবের পর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আবারো ভিড় বাড়তে শুরু করেছে৷ ব্লগারদের ডাকে গত পাঁচ ফেব্রুয়ারি থেকে এই চত্বরে অবস্থান করছেন অগুনতি মানুষ৷ তাদের মূল দাবি হচ্ছে, ‘‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ, তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বয়কট৷’’
ছবি: Reuters
তাণ্ডবের পর নতুন কর্মসূচি
শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরান এইচ সরকার শুক্রবার সন্ধ্যায় জাগরণ মঞ্চ থেকে দাবি করেন, ‘‘আজকের (২২.০২.১৩) হামলায় উস্কানি দিয়েছে জামায়াত শিবিরের পত্রিকা আমার দেশ৷ আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর সম্পাদক মাহামুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে হবে৷ তা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেয়া হবে৷’’ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে এই তথ্য৷
ছবি: Reuters
ইন্টারনেটে সতর্ক দৃষ্টি
‘ধর্মীয় ভাবমূর্তিতে আঘাত হানছে’ এরকম ইন্টারনেট ওয়েবসাইট খুঁজে খুঁজে বন্ধ করে দিচ্ছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ৷ ইতোমধ্যে কমপক্ষে দুটি ওয়েবসাইট বন্ধ এবং দশটি ব্লগ পোস্ট মুছে দেওয়া হয়েছে৷ বার্তাসংস্থা এএফপিকে এই তথ্য জানিয়েছেন টেলিকমিউনিকেশন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি'র ভাইস-চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন আহমেদ৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
রোববার হরতাল
শুক্রবার ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক তাণ্ডব চালানোর পর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে ‘জামায়াত নিয়ন্ত্রিত’ ১২টি ইসলামি দল৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, জামায়াত চক্র হেফাজতের আন্দোলনের মধ্যে ঢুকে নাশকতা ঘটাতে পারে৷ তাই তাদেরই সতর্ক থাকতে হবে, যাতে জামায়াত-শিবির চক্র তাদের মধ্যে ঢুকে কিছু করতে না পারে৷ তিনি বলেছেন, লংমার্চ যদি কোনো পর্যায়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বা আইন বহির্ভূত কোনো কাজে তারা সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে তাহলে যথাসময়ে যথাস্থানে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ তিনি জানান, হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড সরকার যত্ন সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে৷
অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন, লংমার্চে সরকারের লোকজনই গোলযোগ সৃষ্টি করবে, সে কারণেই তারা নাশকতার সংশয়ের কথা বলছেন৷ তিনি বলেন, লংমার্চে কোনো ধরনের সমস্যা হলে এর দায় সরকারকেই নিতে হবে৷ এর জন্য জনগণের কাছে সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে৷
সাধারণ মানুষ বলছেন, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে দেশ৷ এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে এক বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আইনি জটিলতার কারণে এখনই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়৷ গণজাগরণ মঞ্চ জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করছে৷ এই মঞ্চের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা আরো কঠোর আন্দোলনের পথ বেছে নেবে৷ তাই সময় যত গড়াচ্ছে ততোই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷ দেশে কী হতে যাচ্ছে? সামনের দিনগুলো কী অন্ধকারাচ্ছন্ন? এসব প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে এখন মানুষের মনে৷