পরিবহণের ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ইথানলের গুরুত্ব বেড়ে চলেছে৷ তবে খাদ্যের বদলে জ্বালানি হিসেবে উদ্ভিদের ব্যবহার নিয়েও রয়েছে বিতর্ক৷ ব্যবহার বেশি না হলেও জার্মানি, অ্যামেরিকা ও ব্রাজিলের মতো দেশে চলছে নানা উদ্যোগ৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে ইথানল-ভিত্তিক ‘ই-টেন' পেট্রোল চালু করার সময় ভাবা হয়েছিল, যে এর মাধ্যমে ইইউ-র কার্বন নির্গমন সংক্রান্ত ঊর্ধ্বসীমা মেনে চলা যাবে৷ গাড়ি নির্মাতা, পেট্রোলিয়াম কোম্পানি বা অটোমোবাইল সংগঠন –কেউ কিন্তু ক্রেতাদের এ বিষয়ে আগেভাগে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি৷
‘ই-টেন' পেট্রোলের মধ্যে ১০ শতাংশ কৃষিজাত উপকরণ থাকে৷ জার্মানির মানুষ কিন্তু প্রথমে এই পেট্রোলের উপর ভরসা করতে পারেননি৷ তাঁদের মনে হয়েছিল, এর ফলে ইঞ্জিনের ক্ষতি হতে পারে৷ বর্তমানে পেট্রোল বিক্রির প্রায় ১৫ শতাংশ ‘ই-টেন'-এর ভাগে পড়ে৷
তবে বৃদ্ধি সেখানেই থমকে থাকার একটি কারণ রয়েছে৷ কৃষিজাত উপকরণ পেট্রোল ট্যাংকে না খাবারের প্লেটে যাওয়া উচিত, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে৷ জার্মানিতে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রেপসিড দিয়ে অরগ্যানিক পেট্রোলিয়াম তৈরি করা হয়৷
সেইসঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণকারীরাও আবার সমালোচনা শুরু করেছেন৷ তাঁদের মতে, বায়ো-ইথানল জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকারক৷ ‘ই-টেন' চালু করার ঠিক পরেই ডাব্লিউডাব্লিউএফ সংস্থার কৃষি বিশেষজ্ঞ মাটিয়াস মাইসনার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, বাড়তি গাছ মানেই আরও কৃষিজমি এই কাজে লাগানো হবে৷ কৃষি বিশেষজ্ঞ মাটিয়াস মাইসনার বলেন, ‘‘এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে – যখন জঙ্গল সরিয়ে, কাঠ কেটে আখ, গম বা ভুট্টার চাষের জন্য কৃষিজমি তৈরি করা হয়, তখনই কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইড সৃষ্টি হয়৷ এইভাবে জমির ব্যবহার বদলে যে কার্বন নির্গমন ঘটে, সেটাই আসল সমস্যা৷''
ইউরোপের জলবায়ু নায়করা
জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল নিয়ে অনেকেই চিন্তিত৷ তাঁদেরই কেউ কেউ এ থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছেন৷ ইউরোপের এমন কয়েকজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিন৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
মোরি আর মিলা
জার্মানির বিদ্যুৎ কোম্পানি আরডাব্লিউই একটি কয়লা খনির পরিধি বাড়ানোর জন্য প্রাচীন একটি বনের গাছপালা কাটতে চায়৷ কিন্তু মোরি আর মিলা এবং তাঁদের সহযোগীরা তা হতে দিতে চান না৷ তাই ঐ বনের কয়েকটি গাছে বাসা বানিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন তাঁরা৷ এমনকি মাঝেমধ্যে কয়লা খনিতে থাকা ‘এক্সকাভেটর’-এ ঢুকে তাঁরা তালা লাগিয়ে দেন, যেন কেউ সেটা চালাতে না পারে৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
প্লাস্টিক বোতল দিয়ে নৌকা
আমস্টারডামের স্মিট শহরের খালগুলোতে পড়ে থাকা প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করেন৷ পরে সেগুলো দিয়ে নৌকা তৈরি করেন, যেগুলো ঐ খালেই চলে৷
ছবি: DW/R. Krause
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার
গাস ফান ডেয়ার ফেন আমস্টারডামের পুরনো একটি শিপ ইয়ার্ড এলাকা পরিষ্কার করে সেখানে একটি অফিস ভবন তৈরি করেছেন, যেটা চলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও রিসাইকেল করা জিনিস-পত্র দিয়ে৷ এমনকি নিজেদের মলমূত্র থেকে সার তৈরি করে সেই সার দিয়ে সবজি চাষ করেন গাস ফেন ও তাঁর সহকর্মীরা৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
বৈশ্বিক উষ্ণতা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে রাখাতে সম্মত হয়ে ১৯৫টি দেশ ২০০৯ সালে একটি চুক্তি সই করেছিল৷ বেলজিয়ামও সেই অঙ্গীকার করেছিল৷ কিন্তু সরকার সেটা পূরণে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়ায় সরকারের উপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন ইগনাসে শোপস ও তাঁর সহকর্মীরা৷
ছবি: DW/R. Krause
সৌরশক্তি দিয়ে নৌকা
জার্মানির টোবিয়াস পাসুটলকা নৌকা চালাতে ও মাছ ধরতে খুব পছন্দ করেন৷ তিনি তাঁর মাছ ধরার পুরনো নৌকাকে সৌরশক্তি দিয়ে চালানোর উপযোগী করেছেন৷ সূর্য কম থাকা দিনগুলোতেও সেটা চলে৷ মাছ ধরার পাশাপাশি তিনি তাঁর নৌকায় পর্যটক সহ বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষার্থীদের বার্লিন ঘুরিয়ে দেখান৷
ছবি: DW/R. Krause
দৈহিক শক্তি দিয়ে রিকশা চালানো
বার্লিনে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে কয়েক বছর ধরে রিকশার আবির্ভাব হয়েছে৷ তবে সেগুলো চলে বৈদ্যুতিক শক্তিতে৷ কিন্তু গিডো বোর্গার্স ব্যতিক্রম৷ তিনি কোনো জ্বালানি ব্যবহার না করে শারীরিক শক্তি দিয়েই রিকশা চালিয়ে নিয়ে যান৷ প্লাস্টিক ব্যাগ ছাড়া দোকান!
ছবি: DW/A. S. Brändlin
ব্যাগহীন দোকান
বাজারে জিনিস-পত্র কিনে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরেই বাসায় ফেরেন বেশিরভাগ জার্মান৷ কিন্তু মিলেনা গ্লিমবোভস্কির প্রশ্ন, এত প্লাস্টিকের কী দরকার? তাই নিজের দোকানে তিনি কোনো প্লাস্টিকের ব্যাগই রাখেননি৷ এভাবে তিনি ক্রেতাদের জলবায়ু সম্মত উপায়ে কেনাকাটায় উৎসাহিত করেন৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
7 ছবি1 | 7
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে৷ ২০১৭ সাল পর্যন্ত শস্য দিয়ে তৈরি জ্বালানির ঊর্ধ্বসীমা ৭ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হয়েছে৷ ভবিষ্যতে ইলেকট্রিক গাড়ি সহ নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে কার্বন নির্গমন কমানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে৷
অন্যান্য দেশে আরও ভালো সমাধানসূত্র উঠে আসছে৷ যেমন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইথানল-প্রস্তুতকারক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বছর ধরে তথাকথিত ‘বায়োফুয়েল প্ল্যান' চালু আছে৷ সেখানে পেট্রোলের মধ্যে ইথানলের অংশ ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে৷
উৎপাদিত ভুট্টার প্রায় অর্ধেকই সরাসরি গাড়ির ট্যাংকে চলে যায়৷ পেট্রোলের ক্ষেত্রে এমন টেকসই উপাদানের মাত্রা প্রায় ১৫ শতাংশ৷ আইওয়া রাজ্য পুরোপুরি অরগ্যানিক জ্বালানির পথে এগোচ্ছে৷ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে হাজার-হাজার চাকরি জড়িয়ে রয়েছে৷
ব্রাজিলে আখের রস দিয়ে তৃষ্ণা মেটানোর পাশাপাশি গাড়ির ট্যাংকও ভরা হয়৷ দক্ষিণ অ্যামেরিকার এই দেশটি অরগ্যানিক ইথানলের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক ও ব্যবহারকারী৷ ২০০৮ সাল থেকে ব্রাজিলে পেট্রোলের তুলনায় বেশি ইথানল বিক্রি হচ্ছে৷ বেশিরভাগ নতুন গাড়িতে বিশেষ ইঞ্জিন বসানো থাকে, যা বিশুদ্ধ ইথানল ও সাধারণ পেট্রোলেও চলে৷ তবে প্রশ্ন হলো, এর জন্য রেন ফরেস্টের কত অংশ বলি দিতে হয়েছে৷
গাছের অবশিষ্ট অংশ বা অ্যালজি দিয়ে তৈরি ইথানলের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সে তুলনায় অনেক কম৷ তবে দ্বিতীয় প্রজন্মের তথাকথিত এই সব অরগ্যানিক জ্বালানি এখনো বড় আকারে উৎপাদনের সময় আসেনি৷
সৌরতে এগিয়ে, বায়ুতে পিছিয়ে বাংলাদেশ
নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উৎস বায়ু৷ কিন্তু ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চল থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনও এই উৎসের ব্যবহার ততটা করতে পারেনি৷
ছবি: imago/Fotoarena
বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বিপিডিবি-র তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১০,৪১৬ মেগাওয়াট৷ এর মধ্যে ১৬ জুলাই রাতে রেকর্ড ৭,৪০৩ মেগাওয়াট পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল৷
ছবি: Fotolia/Thorsten Schier
নবায়নযোগ্য জ্বালানি
বিদ্যুৎ বিভাগের হিসেবে, বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র আড়াই শতাংশ আসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিভিন্ন উৎস থেকে৷ তবে ২০১৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যাটা ৫-এ উন্নীত করতে চায় সরকার৷
ছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images
সৌরশক্তি
গত কয়েক বছরে সৌরশক্তি উৎপাদনে বেশ এগিয়েছে বাংলাদেশ৷ বর্তমানে মাসে প্রায় ৮০ হাজার ‘সোলার হোম সিস্টেম’ বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে৷ সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৬৫ মেগাওয়াট৷
ছবি: BGEF
বায়ুশক্তি
সমুদ্র অঞ্চল বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বেশ উপযুক্ত৷ বাংলাদেশে প্রায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রয়েছে৷ কিন্তু তারপরও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে সরকার এখন পর্যন্ত তেমন একটা নজর দেয়নি৷
ছবি: Jafar Alam/Coxs Bazar
মাত্র ২ মেগাওয়াট
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মাত্র দুটো বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে৷ একটি ফেনীর সোনাগাজীতে৷ অন্যটি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়৷ এই দুটোর উৎপাদন ক্ষমতা ২ মেগাওয়াট৷
ছবি: Morten Stricker/AFP/Getty Images
৬০ মেগাওয়াটের জন্য চুক্তি
গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক ও বাংলাদেশের একটি যৌথ কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ৷ এর আওতায় কক্সবাজারের কুরুশকুলে বঙ্গোপসাগরের তীরে ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে৷ আগামী মে মাস থেকে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা৷
ছবি: cc-by-Shovon
‘উইন্ড ম্যাপ’
বায়ু থেকে আরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে ২০১২ সালে সরকার ভারতীয় এক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই করে৷ এর আওতায় কোম্পানিটি ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, কুয়াকাটা ও পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় বাতাসের গতি মেপে দেখছে৷