‘উন্নয়নের চাপে’ বিপর্যস্ত পাহাড়ি রাজ্য উত্তরাখণ্ড
২৪ আগস্ট ২০২৫
বর্ষার ভরা মৌসমে একের পর এক বিপর্যয় পাহাড়ি রাজ্য উত্তরাখণ্ডে৷ ৫ আগস্ট ধরালীর পরে এবার দুর্যোগ চামোলি জেলায়, যেখানে ২০২১ সালে মহাবিপর্যয় হয়েছিল৷
শুক্রবার রাত থেকে প্রবল বৃষ্টির ফলে থারালির বিভিন্ন অংশের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে৷ কোটদ্বীপ, রাদিবাগ, আপার বাজার, কুলসারি, চেপডো, সাগওয়ারা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা প্রকৃতির রোষে পড়েছে৷
সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে, হড়পা বান বা আকষ্মিক বন্যায় থারালি সরকারি কার্যালয় এবং আশেপাশের বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে৷ কয়েকজনের নিখোঁজ হওয়ার খবরও রয়েছে৷ সাগওয়ারা গ্রামে এক তরুণী ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েছেন বলে প্রশাসনের আশঙ্কা৷ চোপডো বাজার এলাকার এক বাসিন্দার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না৷
টানা বৃষ্টিতে টুনরি এলাকায় বন্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে৷ বিপজ্জনক অবস্থায় পিণ্ডার নদী৷ থারালির সঙ্গে সংযোগের পথ কর্ণপ্রয়াগ-গোয়ালদাম জাতীয় সড়ক বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ থারালি থেকে সাগওয়ারা যাওয়ার রাস্তাটিও বন্ধ রাখা হয়েছে ধসের কারণে৷ বন্ধ রয়েছে ডুংরির দিকে যাওয়ার রাস্তা৷ চলতি পরিস্থিতিতে তিনটি ব্লকের সমস্ত স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে৷ একাধিক বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যোগানে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷
কারণ শুধু প্রাকৃতিক নয়
চলতি মাসের ৫ তারিখে ভয়াবহ বিপর্যয়ের ছবি দেখা গিয়েছিল উত্তরাখণ্ডের ধরালীতে৷ জলের তোড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল একটি গোটা গ্রাম৷
এই গ্রামের কিছুটা উপরে হিমবাহ-গলা জল দিয়ে তৈরি একটি হ্রদে ধসে পড়েছিল বিপুল পরিমাণ মাটি এবং পাথর৷ হ্রদের জলে পড়ার ফলে তৈরি হয় জলোচ্ছ্বাস৷ এই জল মাটি ও পাথর বয়ে নীচে নেমে আসে ঘণ্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার গতিতে৷ ক্ষীরগঙ্গা নদীখাত বয়ে আসা জলধারা উজাড় করে দেয় ধরালীকে৷
এই ঘটনাই ফিরিয়ে দিয়েছিল চার বছর আগের চামোলি বিপর্যয়ের স্মৃতি৷ ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার পরে মাটি কেঁপে ওঠে৷ এর কিছু পরেই ঋষিগঙ্গা ও ধৌলিগঙ্গা নদী দিয়ে বয়ে আসে জলকাদার স্রোত, সঙ্গে পাথরের খণ্ড৷ তারও আগে ২০১৩ সালে কেদারনাথে এমন বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে৷
চার বছর আগে চামোলির ঘটনায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়৷ নিখোঁজের সংখ্যা ছিল ১২১৷ এই বিপর্যয়ের জন্য মেঘভাঙা বৃষ্টি বা ক্লাউডবার্স্ট কারণ বলে মনে করা হয়েছিল৷ ১০ কিলোমিটার বাই ১০ কিলোমিটার একটি এলাকায় এক ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হলে তাকে ক্লাউডবার্স্ট হিসেবে অভিহিত করা হয়৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেবার চামোলিতে মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়নি৷ এ মাসে ধরালীতেও নয়৷ মাটি ও পাথর মিশ্রিত কাদাজল নদী দিয়ে নেমে সব নিশ্চিহ্ন করে দেয়৷ বিশেষজ্ঞরা আগেও জানিয়েছিলেন, প্রাকৃতিক কারণ নয়, বেহিসেবি পরিকাঠামো নির্মাণের ফলে এই পরিণতি৷ উত্তরাখণ্ডের দুর্গম প্রকৃতিতে মানুষের যথেচ্ছ কাজকর্ম বিপদ ডেকে এনেছে বলে মনে করেন ভূতত্ত্ববিদ থেকে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা৷
প্রাকৃতিক বিপর্যয় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তুহিন ঘোষ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘নদীগুলোর নিজস্ব প্লাবনভূমি থাকে৷ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই নদীর প্লাবনভূমিতে বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে৷ ফলে বাড়তি জল এলে সেটা নদী আর নিতে পারছে না৷ তার আশপাশের জনপদগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে৷ এই ঘটনা বারবার ঘটছে৷ সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ এরকম অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন ঘটতে থাকলে হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড মানচিত্র থেকে মুছে যাবে৷ অসংখ্য গ্রাম ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে৷এর আগের যে হড়পা বানে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, সে ক্ষেত্রে ক্লাউডবার্স্ট দায়ী নয়৷ যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলে ক্লাউডবার্স্ট হয়, তার চেয়ে অনেক কম পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে৷’’
উন্নয়নের ফাঁদে
পাহাড়ি এলাকায় বাসিন্দাদের স্বাচ্ছন্দ্য ও পর্যটনের চাহিদাকে মাথায় রেখে গত কয়েক বছরে নির্মাণের কাজ চলেছে দ্রুত গতিতে৷ নগরায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে৷ নদীখাতের মধ্যে থাবা দিয়েছে উন্নয়ন৷ গড়ে উঠেছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, অন্য প্রয়োজনে নদীর বুকে গভীর গর্ত খোঁড়া হয়েছে৷ এসবের জন্য গাছ কাটা পড়েছে৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে মাটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে৷ মাটির উপরে পরিকাঠামোর চাপ বেড়েছে৷ এই ভার বহনের ক্ষমতা হারিয়েছে ভূপৃষ্ঠ৷ ফলে ধসের প্রবণতা বেড়েছে৷ দুর্বল ভুস্তর আলগা হয়ে বিপদ ডেকে আনছে৷
স্প্রিঙ্গার নেচার প্রকাশিত পত্রিকা ‘জিওটেকনিক্যাল অ্যান্ড জিওলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং'–এ লেখা হয়েছে, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রীকে জুড়ে ৮৯০ কিমি দীর্ঘ যে ‘চারধাম হাইওয়ে’ তৈরি করা হচ্ছে, সেই এলাকা বরাবর গত কয়েক বছরে ৮১১টি ধস হয়েছে৷
পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির এই প্রকল্প বিপদ ডেকে আনছে৷ উত্তরাখণ্ডে চারধাম হাইওয়ে তৈরির কাজ চলছে, এ জন্য হরসিল, উত্তরকাশী, বারকোট, ধারাসু, শ্রীনগর, ঘানসালি, রুদ্রপ্রয়াগ, দেবপ্রয়াগ, শোনপ্রয়াগ, লাংসি, পাখি, জোশীমঠ, চামোলি, গুপ্তকাশী সহ অনেক জায়গায় বিপদের মেঘ ঘনিয়ে আছে৷
নদী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘হিমালয় একটি নবীন পর্বত৷ এর গঠনের প্রক্রিয়া এখনো চলছে৷ ফলে এই পর্বতমালায় অনেক ফাটল ও চ্যুতি আছে৷ অর্থাৎ, হিমালয় যে টেকটনিক প্লেটের উপরে অবস্থিত, সেটা স্থিতিশীল নয়৷ এমন এলাকায় চারধাম সড়কের জন্য সম্প্রসারণের কাজ চলছে৷ হৃষীকেশ থেকে রেললাইন চারধাম নিয়ে যেতে ১৪৭টা জায়গায় সুড়ঙ্গ করা হচ্ছে৷ সুড়ঙ্গ করতে গেলে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে৷ এর ফলে আরও দুর্বল হচ্ছে পাহাড়ের স্থিতি৷ একের পর এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হয়েছে৷ ৫০ হাজারের বেশি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে৷ এর ফলে মাটির ধারণক্ষমতা কমেছে৷’’
তার মতে,জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কম সময়ে অল্প জায়গায় তীব্র বর্ষণ হচ্ছে৷ এর ফলে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার জন্য যে কৃত্রিম ফাটল তৈরি হচ্ছে, সেখানে জল ঢুকে যাচ্ছে৷ সেই জলের উপরে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে উপর থেকে পাথর, মাটি নীচে নেমে আসছে৷ তিনি বলেন, ‘‘পর্যটনকে এত বেশি তুলে ধরা হচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য হয়তো ভালো, কিন্তু এর ফলে অসংখ্য গাড়ি পাহাড়ে যাচ্ছে৷ পাহাড়ের ঢালে অজস্র হোটেল গড়ে উঠেছে৷ এতে আরো অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে হিমালয়৷’’
তুহিন ঘোষ বলেন, ‘‘পাহাড় অঞ্চলগুলি খুবই সংবেদনশীল অঞ্চল৷ পাহাড়ের সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে গেলে ভাবনা-চিন্তা করে তথাকথিত উন্নয়ন করা উচিত৷ পাহাড়ে চার লেনের রাস্তা কি আদৌ প্রয়োজন আছে? গত সাত-আট বছরের যতগুলো ধস নেমেছে, তার বেশিরভাগটাই এই চার লেনের রাস্তার ১০০-১৫০ মিটারের আশেপাশে৷ পাহাড় এই উন্নয়ন নিতে পারছে না৷’’
সমস্যা শুধু পাহাড়ে নয়, সমতলের শহর ও নগরেও
সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ও সার্কুলার ইকোনমি রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টর জেনারেল, অধ্যাপক সাধনকুমার ঘোষ বলেন, ‘‘প্রশাসন যদি ঠিকঠাক না থাকে, তাহলে হড়পা বানের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি আমাদের হতে হবে৷ মুম্বই, কলকাতায় বৃষ্টির সময় প্রচুর জল জমে৷ এইসব সমস্যা মোকাবিলার জন্য বিল্ডিং কন্সট্রাকশনের রুলস এবং রেগুলেশন ঠিক করতে হবে৷ রিসার্চ করে সাস্টেনেবল রুলস ফর বিল্ডিং কন্সট্রাকশন আনতে হবে৷ এক্ষেত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব খুবই৷ বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য না করে তুললে তা প্রাকৃতিক নিকাশি নষ্ট করে৷ পাহাড়ি অঞ্চলে ফসিল ফুয়েল ছেড়ে সোলার, উইন্ড এই শক্তিগুলোকে কাজে লাগানো উচিত৷ ব্যাটারিচালিত গাড়ি ব্যবহার করতে হবে ডিজেলের গাড়ির বদলে৷’’
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ কী? পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান অশোককান্তি সান্যাল বলেন, ‘‘ব্যাপক হারে অরণ্য নিধন করে বসতি গড়ে তোলা এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে৷ যার ফলে উত্তরাখন্ড সহ সারা ভারত জুড়ে বিপর্যয় নেমে আসছে৷ শুধু সরকারের উপর নির্ভর করলে হবে না৷ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে৷ কমিউনিটি গড়ে তুলে সচেতনতার কাজ করতে হবে৷ চিপকো আন্দোলন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন তারই উদাহরণ৷ অচিরেই আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান সংকটে পড়বে৷ পার্বত্য অঞ্চল মূলত জঙ্গলের উপর নির্ভর করেই টিকে থাকে৷ জঙ্গল হ্রাস পেলে পার্বত্য অঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷’’
তুহিন ঘোষ বলেন, ‘‘বিশদ ম্যাপিং দরকার৷ প্রয়োজনে বেশ কিছু জিনিস আমাদের ধ্বংস করে দিতে হবে৷ এটা একেবারেই মানুষের দ্বারা সৃষ্ট৷ তাই মানুষকে সচেতন হয়ে প্রকৃতি রক্ষা করার কাজ করতে হবে৷’’
তিনি মনে করেন, রাজনীতির দিয়েই এই সব উন্নয়ন হয়েছে৷ ফলে রাজনীতি দিয়েই এই উন্নয়ন আটকাতে হবে৷ নইলে গ্রিন বেঞ্চ-সহ আদালতের সহায়তা নিতে হবে৷ ‘‘প্রাথমিকভাবে উন্নয়ন দেখে আমাদের আনন্দ হতে পারে, কিন্তু এই উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে, যা পরিবেশে ক্ষতি করছে৷ পাহাড় উন্নয়ন কতটা নিতে পারছে এটা আমাদের ভাবতে হবে,’’ বলেন এই বিশেষজ্ঞ৷