সিলেট-সুনামগঞ্জে যে বন্যা হয়ে গেল, সেটা ১২২ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে৷ বন্যা মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি কতটা ছিল? হাওরে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে কি পানি সরতে দেরি হয়েছে?
বিজ্ঞাপন
সঠিক সময়ে নৌকাই বা পাওয়া গেল না কেন? এসব নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সুনামগঞ্জের এমপি ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান৷
ডয়চে ভেলে : সিলেট-সুনামগঞ্জে সর্বশেষ যে বন্যা হল, এটার আভাস তো বিশেষজ্ঞরা আগেই দিয়েছিলেন৷ এতে সরকারের প্রস্তুতি কতটা ছিল?
আব্দুল মান্নান : কোন বিশেষজ্ঞ দিয়েছিলেন? কোন ব্যক্তির নাম বলতে পারবেন?
অধ্যাপক আইনুন নিশাত তো ডয়চে ভেলের কাছে বলেছেন, বন্যা তো হওয়ারই কথা ছিল, সেটা হয়ত এক সপ্তাহ পরে হওয়ার কথা ছিল, একটু আগে হয়েছে৷
যে ধান কেটে ভাত খায়, সেও জানে আষাঢ়ে পানি আসবে৷ আমরা বন্যার পূর্বাভাস পেয়েছিলাম৷ কিন্তু কোন বিশেষজ্ঞ কি পৃথিবীতে আছে, কত ফুট পানি হবে বলতে পারবে? এই বিজ্ঞান আমাদেরও নেই, নাসারও নেই, গুগলেরও নেই৷ পানি আসবে এই আভাস আমরা পেয়েছিলাম৷ সেটা আমরা ভারত থেকেও পাই, আমাদের নিজস্ব সংস্থা থেকেও পাই৷ কিন্তু হাইট কত উঠতে পারে, সেটা কেউ বলেও নাই, বলতে পারবেও না৷ এটা বিরল, ১২২ বছরের রেকর্ড ভেঙে গেছে৷
আপনারা কি সবার কাছে ত্রাণ পাঠাতে পেরেছেন? অনেকেই তো পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করছেন?
আমার সুনামগঞ্জ জেলা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত৷ পানি নামা শুরু হয়ে গেছে৷ লোক বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে৷ আরও দু'একদিন লাগবে৷ আমি ওই এলাকার ছেলে৷ আমি ওখানে বড় হয়েছি৷ আমার জন্ম ওই গ্রামে৷ মাটির ঘরে আমার জন্ম৷ আমি সবকিছু জানি৷ আমাদের ওখানে ভাতের অভাব ছিল না৷ অভাব ছিল, রান্না করে খাবে কোথায়? শোবে কোথায়? বসবে কোথায়? স্কুলে, মসজিদে, মাদ্রাসায়, বিভিন্ন ধনী লোকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে৷ কেউ নিরাশ্রয় বা ওপেন এলাকায় ছিল না৷ আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি৷ আমাদের সরকার যে, বিভিন্ন এলাকায় স্কুল কলেজ বানিয়েছে, সেটার একটা ভালো সুফল আমরা পেয়েছি৷ আমি মন্ত্রী বা এমপি যাই হই না কেন, আমার বাড়িতে একশ’ মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ তার মধ্যে ৭০-৮০ জন এখনও আছেন৷ খাবারের অভাব হয়নি৷ অভাব হয়েছিল, চাল-ডাল নিয়ে যাব কিভাবে? নৌকা ছিল না৷ কারণ দেশে নৌকার চল উঠে গেছে৷ সড়ক হয়ে গেছে বেশি৷ এজন্য প্রথম দু'এক দিন ডিফিকাল্ট গেছে৷
‘বন্যা-প্লাবন এলাকায় আর সড়ক নির্মাণ করা হবে না’
অনেকেই বলছেন, হাওরে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মানের ফলে পানি সরতে দেরি হচ্ছে৷ আপনি কি মনে করেন?
আমাদের দেশ একটা উন্নয়নের পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে৷ আমরা সবার কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি৷ অনেক জায়গায় সড়ক নির্মাণ করছি, সেটা অস্বীকার করব না৷ হাজার হাজার কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করেছি৷ সেটা হয়ত বন্যার পানি চলাচলে কিছুটা বাধার সৃষ্টি করেছে৷ আইনুন নিশাতসহ বিশেষজ্ঞরা চটজলদি এটা বলতে পারবেন না, স্টাডি করে বলতে হবে৷ আমাদের সরকার ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বন্যা-প্লাবন এলাকায় আর সড়ক নির্মাণ করা হবে না৷ নিষেধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ যেসব সড়ক আছে, সেগুলোতে আমরা কেটে কেটে অনেকগুলো কালভার্ট বানাবো৷ যেখানে একটা দুইটা কালভার্ট আছে, সেখানে ২০টা কালভার্ট করব৷ যাতে পানি চলাচল আরেকটু ফ্রি হতে পারে৷ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বর্ষাকালে কাজে নামতে পারব না, নভেম্বর মাসেই শুরু করে দেব৷
প্রধানমন্ত্রী উড়াল সড়কের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তার অগ্রগতি কতদূর?
সড়ক না করে আমরা উড়াল সড়ক করব৷ প্লাবন ভুমিতে আর কোন সড়ক নির্মাণ করব না৷ অন্য জায়গায় করব৷ এতে টাকা বেশি লাগবে, কিন্তু আখেরে আমাদের লাভ অনেক বেশি হবে৷
হাওরে তো নৌকার অভাব হওয়ার কথা না, কিন্তু বন্যার মধ্যে আমরা দেখলাম নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না, আবার পাওয়া গেলেও ভাড়া কয়েকগুণ বেশি৷ কেন এমনটা হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
এখন নৌকা নেই৷ ছোটবেলায় আমি যেখানে ৫০০ নৌকা দেখেছি, সেখানে পাঁচটা নৌকাও নেই৷ কারণ গাড়ি যায় সারা বছর, নৌকার চল উঠে গেছে৷ নৌকা কিছু পাবেন যদি আপনি দিরাই, শাল্লা যান৷ কিন্তু এবারের বন্যা ওখানে এফেক্ট করেনি৷ এবারে বন্যা এফেক্ট করেছে পাহাড়ের কাছে যারা৷ অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের আমি সম্মান রেখেই বলছি, তারা বইয়ের বিশেষজ্ঞ৷ মাঠের বিশেষজ্ঞ অনেকেই নন৷
বাংলাদেশের বন্যায় প্রকৃতি ও অপরিকল্পিত অবকাঠামোর দায়
বন্যা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়৷ প্রতিবছর দেশের প্রায় ২৬,০০০ বর্গ কিমি বা ১৮ শতাংশ ভূখন্ড প্লাবিত হয়৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ের বন্যায় অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে নতুন কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
সাত বছরে একবার
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি শতাব্দীতে বঙ্গীয় বদ্বীপ প্রায় অর্ধডজন বন্যার মুখে পড়েছে, যেগুলো ব্যাপকতায় ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যার প্রায় সমান৷ ১৮৭০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত মাঝারি আকারের বন্যা গড়ে প্রতি দুই বছরে একবার এবং ভয়াবহ বন্যা গড়ে ছয়-সাত বছরে একবার সংঘটিত হয়েছে৷ ১৯২৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি সাত বছরে একবার ব্যাপক বন্যা আর ৩৩-৫০ বছরে একবার মহাপ্রলয়ংকরী বন্যা হয়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Asad
ভয়াবহ যত বন্যা
১৯৬৮ সালে সিলেট অঞ্চলের বন্যায় সাত লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হন৷ ১৯৮৭ সালে সারা দেশের ৪০ শতাংশের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়৷ ১৫ থেকে ২০ দিন স্থায়ী হলেও ১৯৮৮ সালের বন্যা গত শতকের অন্যতম ভয়াবহ, যাতে ৬০ শতাংশ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাপক প্রাণহানি হয়৷ এছাড়া ১৯৯৮ সালে দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দুই মাসের বেশি বন্যা কবলিত থাকে, যা ১৯৮৮ সালের বন্যার সঙ্গে তুলনীয়৷ ২০০০, ২০০৭ ও ২০১৭ সালেও ভয়াবহ বন্যায় পড়ে বাংলাদেশ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রাকৃতিক, নাকি মানবসৃষ্ট?
বন্যার যেসব কারণের কথা বলা হয় তার মধ্যে রয়েছে: ভারি বৃষ্টিপাত, হিমালয়ের তুষার গলা, পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট/দখল বা ভূমিধ্বস, প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি, প্রকৃতির উপর মানবীয় হস্তক্ষেপ, সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন, ভূমিকম্পসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
'উন্নয়ন': নতুন সংকট
সাম্প্রতিক সময়ে বন্যার জন্য অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণকেও দায়ী করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা৷ বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র চলতি মাসের সংবাদ সম্মেলন অনুযায়ী, মেঘনা অববাহিকায় ১৬টি আন্তঃদেশীয় নদী আছে৷ ভারত ইচ্ছেমতো সেখানে বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দিচ্ছে৷ উন্নয়নের নামে সিলেটের হাওর অঞ্চল ভরাট, রাস্তা, বাঁধ তৈরি করে পানির প্রবাহে বাধা দেয়াকেও চলতি বন্যার কারণ হিসেবে অভিহিত করেছে তারা৷
ছবি: picture-allaince/NurPhoto/R. Asad
ব্যবস্থাপনায় গলদ
বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্প মূলত বাঁধ, পোল্ডারের মতো অবকাঠামো নির্ভর৷ কাঠামোগত পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা, সেই সঙ্গে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথের মতো অন্যান্য স্থাপনাসমূহ পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে৷ এর প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে দেশে বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নির্গমন প্রকল্পসমূহে প্রচুর বিনিয়োগ সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে ফলাফল সন্তোষজনক নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
প্রতিরোধ পরিকল্পনা
১৯৮৯ সালে বন্যা প্রতিরোধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার৷ কাঠামোগত প্রতিরোধ কার্যক্রম এবং বন্যা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ১১টি নির্দেশনামূলক নীতি প্রণয়ন করা হয়৷ এর অংশ হিসেবে বর্তমানে প্রতিবছর এক লাখ ৩০ হাজার হেক্টর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের কৌশল অনুসরণ করছে সরকার৷ মুনাফা ও নিরাপত্তার দিক থেকে উপকারিতা থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে এর পরিবেশগত প্রভাব যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের৷
ছবি: Mahmud Hossain Opu/AP/picture alliance
যা প্রয়োজন...
কাঠামোগত পদক্ষেপের বাইরে বিকল্প কৌশল হিসেবে অ-কাঠামোগত পদক্ষেপগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ এর মধ্যে আছে নদ-নদীর উপচে পড়া পানি হ্রাসের জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন এবং বিল্ডিং কোডের যথাযথ প্রয়োগসহ শস্যের বহুমুখীকরণ৷ আর সবশেষ প্লাবনভূমিগুলোকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করা এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভূমি ব্যবহার জোন তৈরি করা৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Asad
7 ছবি1 | 7
অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের কারণে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাচ্ছে, ফলে নদীগুলো দিয়ে পানি দ্রুত সরতে পারছে না৷ অনেকদিন ধরেই তো পাথর উত্তোলন নিয়ে কথা বার্তা হচ্ছে৷ কিন্তু কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না?
নির্মাণে আমাদের পাথর লাগবে না? এতে তো নদীর গভীরতা বাড়ে৷ এতে ক্ষতি কি হল? পাথর তুললে নদীর তলদেশ কিভাবে উঁচু হল? এতে তো নদীর গভীরতা বাড়বে৷ বাংলাদেশের নির্মাণ কাজে যত পাথর ব্যবহৃত হয় এর অধিকাংশ তো সুনামগঞ্জ থেকে আসে৷ আমরা তো নদীকে গভীর করতে চাচ্ছি৷ সেটা বালু কেটেই হোক, পাথর কেটেই হোক আর মাটি কেটেই হোক৷ এর কারণে তো আপনি আমাকে স্বাগত জানাবেন৷ এই ধরনের মন্তব্য অবৈজ্ঞানিক বলে আমি মনে করি৷ আমি বিজ্ঞানী নই, কমন সেন্স থেকে বলছি৷ আপনিও কমন সেন্স থেকে কথাটা বোঝার চেষ্টা করবেন৷ নদীতে যদি একটানা বালু আর পাথর জমে তাহলে নদীর বুক উঁচু হয়ে যাবে না? আমরা তো ভালো করছি৷ নদী থেকে পাথর, বালু ও মাটিও তুলছি৷ এতে নদীও গভীর হচ্ছে৷ এতে কার বাধা দেওয়ার আছে? ওখানে বাস করে যারা তাদের কাছে যান, সত্যি তথ্য পাবেন৷ ওদের বড় বড় ডিগ্রী নেই, কিন্তু কমন সেন্স আছে, অভিজ্ঞতা আছে৷ বই পড়ে মডেল বানিয়ে এগুলো করা যায় না৷ এবার যেটা হয়েছে বিরল ঘটনা৷ এটা ইউরোপেও হয়, আমেরিকাতেও মাঝে মধ্যে হয়ে যায়৷ এগুলো প্রাকৃতিক লীলাখেলা৷ এভাবেই নেওয়া ভালো৷ আমাদের দায়িত্ব হল মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো৷ আমরা দাঁড়িয়েছি৷ প্রথমদিন সবকিছু তছনছ হয়ে গিয়েছিল৷ মোবাইল নেটওয়ার্ক, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল৷ সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়েছিল৷ তাহলে আমরা কিভাবে মানুষের কাছে যাব? আমি তো দুই দিন টেলিফোনেই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না৷ সবগুলো মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল৷ এটা দোষারোপের বিষয় না৷
কয়েক মাসের মধ্যে সিলেট-সুনামগঞ্জে তিন দফা বন্যা হয়ে গেল৷ প্রচুর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ সরকার তাদের পুনর্বাসনে কি ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে?
মানুষের প্রাণের ক্ষতি হয়নি৷ মৃত্যু নেই৷ সব মিলিয়ে মাত্র দুই জনের মৃত্যু হয়েছে৷ আল্লাহ মাফ করুক৷ ক্ষতি হয়েছে নাম্বার ওয়ান গ্রামীণ সড়কের৷ আর ক্ষতি হয়েছে গরীব মানুষের কুড়ে ঘরের৷ মাটি এবং বাঁশের ঘর ভেঙে পড়েছে৷ জোয়ারে ঠেলে নিয়ে গেছে৷ বিল্ডিংয়ের ক্ষতি হয়নি৷ সড়কের ক্ষতি হওয়ার কারণ বন্যার তোড়ে বাঁধ ভেঙে গেছে৷ রেল লাইনের ক্ষতি হয়েছে৷ রেলের লাইন উপরে রয়ে গেছে, নিচে মাটি সরে গেছে৷ কিছু গরু-বাছুরের ক্ষতি হয়েছে৷ আসামে একশ'র বেশি মানুষ মারা গেছে৷ অল ইন্ডিয়া রেডিও'র খবর আমি শুনেছি৷ আমাদের মৃত্যু তো দুই জনের৷ এটা কোন কৃতিত্বের বিষয় না৷ কপাল ভালো যদি বলতে চান, সেটা বলতে পারেন৷ আপনি বৈজ্ঞানিক হলে বলবেন আমাদের ব্যবস্থাপনা ভালো ছিল৷ অথবা আমাদের মানুষের উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অনেক ভালো৷ নানাভাবে এটার ব্যাখা দেওয়া যায়৷
স্থানীয় প্রশাসনের বন্যা মোকাবেলায় কোন গাফিলতি ছিল?
গাফিলতির কোন প্রশ্নই নেই৷ তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন৷ ডিসি, ইউএনও, ইঞ্জিনিয়ার সকলে মিলে৷ কোন ডিপার্টমেন্টকে আমি বেশি ক্রেডিট দিচ্ছি না৷ সকলে মিলেই চেষ্টা করেছে৷ যারা সুনামগঞ্জের বাইরে ঢাকায় ছিল, তারা বাড়িতে যেতে পারেনি৷ তাদের কি দোষ? আমি এলাকার এমপি, একটা নিউজ পেপার হেডলাইন করল কোন এমপি-মন্ত্রী এলাকায় নেই৷ ভাই আমি তো মাসে তিনবার এলাকায় যাই৷ কাউকে বলে যাই না৷ আমি কিভাবে যাব? প্লেন যায় না, সড়কে যাওয়া যায় না, এমনকি আমি হেঁটেও যেতে পারব না৷ আমি কি সাঁতরিয়ে যাব? আমি ব্যক্তিগতভাবে করোনায় আক্রান্ত৷ এইসব বলা যায়, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন৷ দুই দিকেই দেখা উচিৎ৷
বাংলাদেশ তো সব সময় দুর্যোগপ্রবণ দেশ৷ আগে থেকেই সবকিছুর একটা প্রস্তুতি রাখতে হয়৷ এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় ভবিষ্যতে আপনারা কি ধরনের প্রস্তুতির কথা ভাবছেন?
আমাদের প্রস্তুতি ছিল৷ যথেষ্ট পরিমাণ চাল গুদামে আছে৷ ডিসিদের ক্ষমতা আছে চাল বন্টন করার৷ তারা সেটা করেছে৷ মোমবাতি, দেশলাইসহ জরুরি দ্রব্যাদি ইউএনওদের কাছেই থাকে৷ আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে পানি বিশুদ্ধ করার ট্যাবলেট, স্যালাইন সবই ছিল৷ আমি তো যেতে পারছি না৷ দুই তিন মাইল কি সাঁতরিয়ে যাওয়া যাবে? নৌকা লাগবে৷ কিন্তু নৌকা তো ছিল না৷ আমি তো প্রথমেই বলেছি, উন্নয়নের মাসুল আমরা দিয়েছি৷ ভাটি দেশ থেকে নৌকা উঠে গেছে প্রায়৷ নৌকা না থাকায় ক্ষতিটা বেশি হয়েছে৷
বন্যায় বিপর্যস্ত সুনামগঞ্জ
সুনামগঞ্জে শতাব্দীর ভয়াবহ বন্যার কারণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। অতিবৃষ্টি এবং ভারতের চেরাপুঞ্জির পার্শ্ববর্তী অঞ্চল হওয়ার কারণে সুনামগঞ্জসহ আশেপাশের অঞ্চলগুলোর বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ত্রাণের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষা
সুনামগঞ্জ সদরের সরকারী জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের নৌবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পের সামনে সারাদিনই ভিড় করতে দেখা যায় বন্যাদুর্গত মানুষদের। নবীনগর থেকে ৪ দিন আগে আসা শেফালী হালদার জানান, বন্যার কারণে তাঁরা ঘর-বাড়ি ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে লোকমুখে এমন কথা শুনে আসলেও এখানকার কর্মকর্তারা বলছেন এখানে কোনো ত্রাণ দেওয়া হয় না।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
‘অবলা প্রাণী কিছু কইতে পারছে না’
সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের তাহের আলী বলেন, ‘‘আমরার সবার বাড়িত অই গবাদিপশু আছে। বন্যাত আমরা তেমন খাইতে পারছি না, পানি খায়া থাকোন লাগসে। কিন্তু গবাদি পশু তো অবলা প্রাণী, কিছু কইতে পারছে না, অগো খাইতেও দিতে পারছি না, তাইনেরে নিয়া বিরাট বিপদও আছলাম।’’
ছবি: Mortaza Rashed/DW
শুধু বাসার ছাদ দেখা গেছে
সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার বালিঝুড়ি গ্রামের রেণোদা বিশ্বাস জানান, বন্যা শুরু হলে রাতেই ঘরে পানি ঢুকে যায়। ভয়ে পরিবার নিয়ে কোনোমতে বাড়ি ছেড়ে নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে যান তাঁরা। একদিন পর নৌকায় করে বাড়ি দেখতে এসে দেখতে পান, শুধু বাড়ির ছাদ দেখা যাচ্ছে, বাকি অংশ পানির নীচে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামের সেলিম মিয়া জানান, বন্যার শুরুর পরপরই বিদ্যুৎ ও মোবাইলের নেটওয়ার্ক চলে যাওয়ায় যেসকল আত্মীয়স্বজন শহরে কিংবা পাশের গ্রামেই থাকেন, তাদের কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এই দুর্যোগে কে কেমন আছে এ নিয়ে সবাই খুবই চিন্তিত ছিল।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
বসতবাড়ি ভেঙে গেছে
সুনামগঞ্জের শনির হাওরের সাব্বির আহমেদ ও মো. আকাশ জানান, বন্যার স্রোতে তাদের টিনের বাসা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। সেটি নতুনভাবে বানানো ছাড়া উপায় নেই আর। তাদের গ্রামের অনেকের বাসাবাড়ির চিহ্নটুকুও নেই।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ফসলের জমিতে ১০ ফুট পানি
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের সগির আলী জানান, তাঁর বসতবাড়ির সামনে যতদূর দেখা যায়, ফসলি জমি ছিল। অন্যান্য বছর জাদুকাটা নদী ও পার্শ্ববর্তী হাওরের পানি বাড়লেও এবছরের বন্যায় ফসলি জমি তলিয়ে গেছে কমপক্ষে ১০ ফুট পানির নীচে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
আবার ফেরত যাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রে
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বারোংকা গ্রামের হযরত আলী জানান, একটি ট্রলার ভাড়া করে আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে বাড়িতে ফেরত গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেন সেখানে এখনো কোমর সমান পানি। অনেকের বাড়ির পানি নামলেও তার বাসারটা এখনো না নামায় আবার আশ্রয়কেন্দ্রে ফেরত যাচ্ছেন তারা।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ায় সড়কে আশ্রয়
সিলেট-সুনামগঞ্জ সংযোগ সড়কের মদনপুর নামক স্থানে দেখা যায়, সেখানে কিছুদূর পরপর রাস্তায় পলিথিন দিয়ে অস্থায়ী তাঁবু বানিয়ে অবস্থান করছেন শতশত পরিবার। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এরা সবাই বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে এসেছেন এবং এখানে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ত্রাণ পর্যাপ্ত না
ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নেওয়া একটি বেসরকারি দাতব্য সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ‘‘আমরা সুনামগঞ্জে বন্যার শুরু থেকেই ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার ত্রাণ দিচ্ছি, কিন্তু তবু দিয়ে শেষ করতে পারছি না। আসলে এত মানুষের চাহিদা মেটানো খুবই কঠিন, কোনো উদ্যোগই যথেষ্ট না।’’
ছবি: Mortaza Rashed/DW
‘সাত-আট দিনে শুধু আজকে ত্রাণ পেলাম’
বন্যায় সুনামগঞ্জ জেলার অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা তাহিরপুরের নয়ানগর গ্রামের পরীবানু জানান, সকালে একটা দল এসে কিছু শুকনো খাবার দিয়ে গেছে, আর এখন রান্না করা খাবার পেলেন তারা। শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় তাদের এদিকে এর আগে ত্রাণ দিতে কেউ আসেননি।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
দূরদুরান্ত থেকে নৌকায় ত্রাণ নিতে আসছেন
সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ত্রাণবাহী ট্রলার অথবা স্পিডবোট নদীর মাঝামাঝি থাকাতেই লোকমুখে শুনে অনেকেই দূর থেকে নৌকা নিয়ে ত্রাণবাহী নৌকার কাছে চলে আসছেন। তবে বৈষম্য হতে পারে এই ভেবে কাউকেই এভাবে ত্রাণ দেওয়া হয়নি।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, শিবগঞ্জ, শনির হাওর এলাকাগুলোর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঘুরে দেখা যায় সেখানকার বন্যা উপদ্রুত মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ছোট একটি ঘরে ১০-১৫ জন বসবাস করছে। খাবারের সংকটের পাশাপাশি বিদ্যুৎ না থাকায় খাবার পানিরও সংকট তৈরি হয় সেখানে।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
‘চকির উপ্রে চকি দিয়া থাকসি’
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার নয়ানগর গ্রামের রুবিয়া আক্তার বলেন, ‘‘আমরার পরিবারে ৬ জন মানুষ। আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে যাইতাম পারছি না। ঘরই চকির উপরে চকি দিয়া কোনরকম বাইচা আছিলাম। বন্যার স্রোতে বাড়ির সামনে পিছে ভাইঙ্গা লইয়া গেসে।’’
ছবি: Mortaza Rashed/DW
আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গার সংকট
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামের জ্যোৎস্না বেগম জানান, বন্যার পানি বিপদজনকভাবে বাড়তে থাকায় স্বামী-সন্তানসহ কাছের এক আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু আগে থেকে আশ্রয়কেন্দ্রটি মানুষের জায়গা হচ্ছিল না। তাই তারা আবার নিজ বসতবাড়িতে ফেরত এসেছেন।
ছবি: Mortaza Rashed/DW
ভ্রাম্যমাণ রান্নাঘর
বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা দূরবর্তী হওয়ায় নদীপথে একদিনে ফেরত আসা যায় না। তাই যেসব বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে, তারা ট্রলারেই রান্নার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। তারা টাটকা রান্না করা খাবার বন্যা উপদ্রুত এলাকার পরিবারগুলোর মাঝে বন্টন করে দিচ্ছেন।