একের পর এক উপাচার্যের ইস্তফা পশ্চিমবঙ্গে। সার্চ কমিটি গঠন করে উপাচার্যদের নিয়োগ করা হবে।
ছবি: Payel Samanta/DW
বিজ্ঞাপন
সাবেক রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে রাজ্য সরকারের নানা বিষয়ে বিরোধ লেগেই ছিল। সংঘাতের আবর্তে এসে গিয়েছিল উচ্চশিক্ষাও। পদাধিকারবলে রাজ্যপাল রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য। কিন্তু তাকে এড়িয়ে রাজ্য সরকার উপাচার্য নিয়োগ করেছে বলে অভিযোগ তুলেছিলেন ধনখড়।
রাজভবনে নতুন রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সি ভি আনন্দ বোস। তার সঙ্গে সোম ও মঙ্গলবার বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্য ও রাজভবনের মধ্যে যে বিরোধের পরিস্থিতি চলছিল, তার সমাধানসূত্র বার করা হয়েছে। ২৪ জন উপাচার্য পদত্যাগ করবেন, নিয়োগ হবে নতুন ভাবে।
মঙ্গলবারের বৈঠকে ছটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাজ্যপাল তথা আচার্যের কাছে ইস্তফা দিয়েছেন। কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধন চক্রবর্তী, সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরাধা মুখোপাধ্যায়, বারাসত রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মহুয়া দাস, সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীপক কর, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমাই সাহা এবং কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানস সান্যাল পদত্যাগ করেন। তিনমাসের মেয়াদবৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এই উপাচার্যদের।
ইস্তফা দিতে চান আলিয়ার নিগৃহীত উপাচার্য
উপাচার্য নিগ্রহের ঘটনার পর আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আবার খবরের শিরোনামে। উপাচার্য মহম্মদ আলি ইস্তফা দিতে চেয়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের অন্যতম পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখন রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের নাম ছিল মহামেডান কলেজ অফ ক্যালকাটা। প্রথমে কলেজের ভবন ছিল শিয়ালদহের কাছে। তারপর ওয়েলেসলি স্কোয়ারে ক্যাম্পাস হয়। এখন পার্ক সার্কাস, তালতলা ও নিউ টাউনে আলিয়ার ক্যাম্পাস আছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কী পড়ানো হয়
আলিয়াতে এখন পড়ানো হয় ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট, নার্সিং, বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের বিভিন্ন বিষয়। কলা বিভাগের বিষয়ের মধ্যে উর্দু, ইসলামিক থিওলজি, ইসলামিক স্টাডিজও আছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
উপাচার্য নিগ্রহ
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন মহম্মদ আলি। আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। সেখান থেকে আলিয়ার উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়েছেন। দিন কয়েক আগে গিয়াসুদ্দিন নামে এক ছাত্রনেতা ও তার দলবল উপাচার্যের ঘরে ঢুকে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে, চড় মারার হুমকি দেয়। তার উপর মানসিক নির্যাতন করে গিয়াসুদ্দিনরা। এই গিয়াসুদ্দিন একসময় তৃণমূল ছাত্রশাখার নেতা ছিল। আগেও সে দুইজন উপাচার্যকে নিগ্রহ করেছিল বলে অভিযোগ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
দায়িত্ব ছাড়তে চান
মহম্মদ আলি এখন আলিয়ার দায়িত্ব ছাড়তে চান। তিনি বলেছেন, নৈতিক দায় নিয়ে তিনি এই পদ ছেড়ে আবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে চান। মহম্মদ আলি জানিয়েছেন, তিনি সত্যিই ভয় পেয়ে গেছিলেন। পুলিশকে ডাকলেও তারা আসেনি। তার মনে হচ্ছিল, গিয়াসুদ্দিনরা কিছু করে দেবে
ছবি: Subrata Goswami/DW
তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছিলেন, তাদের সঙ্গে গিয়াসুদ্দিনের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু গোটা ঘটনায় বেশ কিছু তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রীর নাম সামনে এসেছে। কিছু ভিডিও ক্লিপে (যার সত্যতা ডিডাব্লিউ যাচাই করতে পারেনি) রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, গোলাম রাব্বানিদের নাম এসেছে। ছবিতে তৃণমূলের নেতা অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে গিয়াসুদ্দিনকে দেখা যাচ্ছে।
ছবি: Subrata Goswam/DW
কে এই গিয়াসুদ্দিন?
গিয়াসুদ্দিন ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিল। ২০১৪ সালে গিয়াসুদ্দিনকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি হয়। ২০১৭ সালে আলিয়া ক্যাম্পাসের হস্টেল থেকে টাকা আদায় করা ও ক্যান্টিনের টাকা নয়ছয় করা নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ, পরপর দুই জন উপাচার্য আবু তালেব খান ও মহম্মদ আলিকেও হেনস্থা করে গিয়াসুদ্দিন। তারপর সে আলিয়া থেকে বহিষ্কৃত হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
গিয়াসুদ্দিন গ্রেপ্তার
পুলিশ গিয়াসুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাকে আদালত সাতদিনের জন্য পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
মুখ্যমন্ত্রীর দাবি
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ''আলিয়াতে পুলিশ পদক্ষেপ নিয়েছে। যা করার করেছে। আলিয়াতে যারা পড়াশুনো করে, সবাই খুব ভালো। তবে তাদের ক্ষোভ থাকতে পারে। যে কটু কথা বলেছিল, তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আমাদের এখানে কিছু হলে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিরোধীদের বক্তব্য
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ''একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূল কী করতে পারে, এটা তার প্রমাণ। আনিস খানকে নিয়ে ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে। তার থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে এই ঘটনা।'' রাজ্যের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, ''এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটাই এখন পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি। উপাচার্যকে ঘেরাও করা, বিক্ষোভ দেখানো রাজ্যে প্রায়ই হয়। কিন্তু আলিয়াতে যা হয়েছে তা নজিরবিহীন।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাজ্যপালের কাছে গেলেন না মুখ্যসচিব
আলিয়া-কাণ্ড নিয়ে জানতে রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। সেকথা তিনি টুইট করেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু মুখ্যসচিব রাজ্যপালের কাছে যাননি।
ছবি: Prabakhar/DW
আনিসের মৃত্যু
কিছুদিন আগে ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যু হয়েছে। তার পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের পোশাক পরিহিত চারজন বাড়ির ছাদ থেকে আনিসকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। তাতেই তিনি মারা গেছেন। আনিস এই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিক্ষোভ চলছে
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ছাত্রবিক্ষোভ চলছে। উপাচার্যের সমর্থনে ও গিয়াসুদ্দিনের বিরোধিতা করে ছাত্রছাত্রীরা এখন আলিয়ায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ছাত্রের দাবি
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইরফান শরিফও বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ''গিয়াসুদ্দিনরা আগেও সাধারণ ছাত্রদের আক্রমণ করেছিল। গিয়াসুদ্দিনের মাথার পিছনে অদৃশ্য হাত আছে। সেগুলিকে খুঁজে বের করতে হবে। গিয়াসুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে আনিস-কাণ্ডের মতোই সব ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে।''
ছবি: Subrata Goswami/DW
ছাত্রনেতার বক্তব্য
পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ মাসাদুর রহমান ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''গিয়াসুদ্দিন বড় বড় নেতা-মন্ত্রীদের ছত্রছায়ায় আছে, তা ভাইরাল ক্লিপিংস থেকেই স্পষ্ট।'' মাসাদুর বলেন, গিয়াসুদ্দিনের মতো গুণ্ডাকে ছাত্রনেতা বলা উচিত নয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
14 ছবি1 | 14
এই প্রক্রিয়ায় পদত্যাগ ও সাময়িক নিয়োগের সমালোচনা করেছে সেভ এডুকেশন কমিটি। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক অধ্যাপক তরুণ নস্কর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘'যেভাবে একসঙ্গে উপাচার্যদের ইস্তফা দিতে হচ্ছে, সেটা এই পদের পক্ষে সম্মানজনক নয়। শিক্ষামন্ত্রীর থেকেও মর্যাদা বেশি উপাচার্য পদের।‘'
যদিও রফাসূত্রে রাজ্য-রাজভবনের মধ্যে বিরোধ মিটে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে। উপাচার্যদের নিয়োগ ঘিরে একসময় ধনখড় তীব্র উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। টুইটে ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের তালিকা তুলে ধরে সাবেক রাজ্যপাল বলেছিলেন, এদের নিয়োগ বৈধ নয়। যেহেতু আচার্য হিসেবে তিনি এই নিয়োগে সম্মতি দেননি।
সেই সময় নবান্ন পাল্টা যুক্তি দেয়, নিয়োগ সংক্রান্ত নথি পাঠানো হলেও রাজ্যপাল প্রতিক্রিয়া দেননি। রাজ্য নয়া বিলও পাশ করায় বিধানসভায়। সেই বিল অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীকে পদাধিকারবলে আচার্যের ক্ষমতা দেয়া হয়। এই বিলে সম্মতি দেয়নি রাজভবন।
পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়োগ খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট। বাকি ২৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। সেই বিরোধ মিটছে বলেই মনে হচ্ছে। নয়া উপাচার্যদের নিয়োগ করার জন্য সার্চ কমিটি গঠন করার ব্যাপারে রাজ্যপাল সম্মতি দিয়েছেন বলে শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন।
''আনুগত্য দেখে উপাচার্য নিয়োগ করলে ঠিক হবে না''
This browser does not support the audio element.
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘'উপাচার্য হিসেবে যারা দায়িত্ব পাবেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। দেখতে হবে কোনো অচলাবস্থায় পড়ুয়াদের ক্ষতি না হয়।‘'
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে যখন বিরোধ মিটতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে, সেই সময় পদ ছেড়ে দিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী। তিনি আচার্য তথা রাজ্যপালকে ইমেল করে ইস্তফার ইচ্ছে জানিয়েছেন। অতীতে একাধিক বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়ে পদ ছাড়ার কথা বলেছিলেন তিনি।
স্থায়ী উপাচার্যের শূন্যপদে স্বচ্ছ নিয়োগ প্রত্যাশা করছে শিক্ষা মহল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘'অনেক যোগ্য, অভিজ্ঞতাসম্মন্ন মানুষ আছেন। আনুগত্য দেখে উপাচার্য নিয়োগ করলে ঠিক হবে না।‘'