‘উপাচার্যদের রাজনীতিবিদের মতো আচরণ অত্যন্ত নিন্দনীয়'
২১ জানুয়ারি ২০২২
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে উপাচার্যদের রাজনীতিবিদের মতো আচরণ ‘অত্যন্ত নিন্দনীয়' বলে মনে করেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান৷ ডয়চে ভেলে খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায় টকশোতে এই মন্তব্য করেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
টক শোর অপর অতিথি বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশীদ শিক্ষকদের শিক্ষক হিসেবেই দেখতে চান৷ এই প্রসঙ্গে তার আশির দশকের ছাত্রাবস্থায় শিক্ষকদের অভিভাবকসুলভ আচরণের কথা উল্লেখ করেন রশীদ৷ তবে, বর্তমানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মাস্তান তৈরির কারখানা হয়ে যাচ্ছে এবং মুক্ত চিন্তার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন বিএনপি দলীয় এই সংসদ সদস্য৷
প্রসঙ্গত, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশন করেছেন৷ এই পরিস্থিতিতে উপাচার্যের সরে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন মো. হারুনুর রশীদ৷ উপাচার্যদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক সচিব শহীদও৷
টক শোতে উঠে এসেছে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ বাহিনী ব়্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিও৷ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে ব়্যাবকে বাদ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের চিঠি দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে, বৈদেশিক মুদ্রার আমদানিতে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান৷ তবে আমেরিকার নিন্দা করতেও ছাড়েননি তিনি৷
বাংলাদেশ এই প্রস্তাবের কূটনৈতিক মোকাবেলা করবে বলেও জানান সাবেক সচিব৷ যদিও বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনসহ একাধিক অভিযোগে সরব হন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য মো. হারুনুর রশীদ৷ শহীদ খান বলেন, ‘‘প্রতিটি ক্রসফায়ারের তদন্ত হওয়া প্রয়োজন৷''
অ্যামেরিকার চাপের ফলে খানিকটা হলেও নরম হয়েছে আওয়ামী লীগ, বিরোধীদের রাজনৈতিক সমাবেশে অলিখিত যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা অনেকটা হলেও কমেছে৷ গত দুই মাসে ৩০-৩২টি সভা করেছে বিএনপি, এমনটাও মনে করেন এই রাজনীতিবিদ৷
ভিন্নমতকে চাপা দিতে ব়্যাবকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তীব্র কটাক্ষ করেন রশীদ৷ খালেদা জিয়ার বয়স ৭৭, তবু তাকে দেশের বাইরে চিকিৎসায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন তিনি৷ শহীদ খান বলেন, ‘‘৪০১ ধারায় বাইরে গিয়ে চিকিৎসায় অনুমোদন রয়েছে৷''
শাবিপ্রবি: প্রাধ্যক্ষ অপসারণের দাবি থেকে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন
শুরুটা প্রাধ্যক্ষ অপসারণের দাবিতে, পুলিশি হামলায় যা পরিণত হয় উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে৷ এক দফা দাবিতে অনড় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে সপ্তাহ পেরিয়ে৷ ঘটনাপ্রবাহ ছবিঘরে...
ছবি: bdnews24.com
যেখান থেকে শুরু
সূত্রপাত ১৩ জানুয়ারি, বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিরোধের জেরে৷ অসদাচরণের অভিযোগে তার অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভে নামেন ছাত্রীরা৷ রাত ১১টার দিকে তারা অবস্থান নেন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে৷ উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ দেন সমাধানের আশ্বাস৷ রাত আড়াইটায় ছাত্রীরা ফিরেন হলে৷
ছবি: bdnews24.com
তিন দফা দাবি
করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে পরদিন জাফরিন আহমেদকে ছুটিতে পাঠান উপাচার্য৷ অন্য একজনকে করেন ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ৷ কিন্তু পুরো কমিটির পদত্যাগ, হলের অব্যবস্থাপনা দূর, ছাত্রীবান্ধব ও দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ; তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ছাত্রীরা৷ তাদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উপচার্যের ঘণ্টাব্যাপী আলাপেও আসেনি সমাধান৷ শতাধিক আবাসিক ছাত্রী উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও করে শুরু করেন বিক্ষোভ৷
ছবি: bdnews24.com
‘ছাত্রলীগের’ হামলা
তৃতীয় দিনে আন্দোলনরত ছাত্রীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে শাবি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে৷ ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় প্রক্টরের উপস্থিতিতেই এই ঘটনা ঘটে বলে ছাত্রীরা জানান৷ তাদের একজন বলেন, ‘‘আন্দোলনে সংহতি জানাতে আসা ১০-১২ জন ছাত্রকে তারা বেধড়ক মারধর করে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আলমগীর কবির এ সময় সেখানে ছিলেন৷’’ প্রক্টর ও ছাত্রলীগের এক সদস্য একে ‘হাতাহাতি’ হিসেবে অভিহিত করেন৷
ছবি: bdnews24.com
পুলিশের হামলা
ছাত্রীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন৷ তাদের সঙ্গে একাত্ব হন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও৷ ১৬ তারিখ আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন তারা৷ তাকে মুক্ত করতে বিকালে উপস্থিত হয় পুলিশ৷ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তারা লাঠিপেটা, কাঁদুনে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে৷ শিক্ষার্থী, কর্মকর্তাসহ আহত হন অর্ধশত৷
ছবি: bdnews24.com
পুলিশের মামলা
পরদিন পুলিশই অজ্ঞাত পরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীকে আসামি করে মামলা করে৷ অভিযোগ শিক্ষার্থীরা গুলি বর্ষণ ও পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট করেছে৷ তবে ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ৩১টি শটগানের গুলি এবং ২১টি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বলেও মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ
রোববার সন্ধ্যায় জরুরি সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ৷ পরদিন বারোটার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশনা দেয় তারা৷ এরমধ্যে প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজা পদত্যাগ করেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান উপাচার্য৷ কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি, পুলিশি হামলার ঘটনার এবার উপাচার্যকেই যেতে হবে৷ ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী৷
ছবি: bdnews24.com
প্রশাসনিক ভবনে তালা
শিক্ষার্থীদের দুপুর বারোটার আগে হল ত্যাগের নির্দেশ দিলেও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রাখে কর্তৃপক্ষ৷ শিক্ষার্থীরা সেই নির্দেশ অমান্য করে উল্টো উপাচার্য কার্যালয়, দুটি প্রশাসনিক ভবন ও চারটি একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন৷ এক সমাবেশ থেকে ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে শাবিপ্রবিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন তারা৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেকদের সহমর্মিতা
কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং ও ক্যান্টিন বন্ধ করায় নির্দেশ অমান্য করে ক্যাম্পাসে থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীরা খাবার নিয়ে পড়েন বিপাকে৷ সমাধান হিসেবে হাজারো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরের পাশে নিজেরাই রান্না ও খাবার আয়োজন শুরু করেন৷ আন্দোলনে একাত্মতার পাশাপাশি এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাষ্ট্রপতির কাছে পত্র
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ১৮ তারিখ রাষ্ট্রপতি ও আচার্য আব্দুল হামিদের কাছে চিঠি পাঠান শিক্ষার্থীরা৷ সেখানে তারা লিখেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডেকে এনে শিক্ষার্থীদের উপর এমন নৃশংস হামলা চালিয়ে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলায় শাবিপ্রবি উপাচার্য যেভাবে মূল কুশীলবের ভূমিকা পালন করেছেন তা সরাসরি সংবিধান বিরোধী এবং আপনার কর্তৃক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের উপর অর্পিত দায়িত্বের বরখেলাপ৷’’
ছবি: bdnews24.com
আমরণ অনশন
উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ ও পুলিশের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ১৯ তারিখ থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা৷ উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিকাল ৩টায় শুরু করা এই কর্মসূচিতে অংশ নেন নয়জন ছাত্রী ও ১৫ ছাত্র৷ অনশনকারীদের ঘিরে রাখেন অন্য ছাত্র-ছাত্রীরাও৷ এর আগে উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য বেলা ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তারা৷
ছবি: bdnews24.com
অসুস্থ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
সময় যত গড়াচ্ছে তত স্তিমিত হচ্ছেন অনশনরত শিক্ষার্থীরা৷ আমরণ অনশন করা ১১ জন শিক্ষার্থী শুক্রবার পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন৷ এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘‘অনেকেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে; আমরা পর্যাপ্ত মেডিকেল সাপোর্ট পাচ্ছি না৷ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকেও আমাদের কোনো মেডিকেল সাপোর্ট দিচ্ছে না৷’’ আলোচনার জন্য কোষাধ্যক্ষের নেতৃত্বে একটি দল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করলেও উপাচার্যের কোনো সাড়া মিলছে না৷
ছবি: bdnews24.com
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ কে
বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স, মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমইসি ডিগ্রিধারী৷ তার কোনো ডক্টরেট ডিগ্রি নেই৷ অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত টানা পাঁচ মেয়াদ ঢাবির সমাজ বিজ্ঞানের ডিন ছিলেন৷ সরকারপন্থি নীল দলের রাজনীতিতে যুক্ত এই শিক্ষক নেতা ২০১৭ সাল থেকে শাবিপ্রবির ভিসি৷