উপাচার্য সমাচারের রাজনৈতিক দুষ্টচক্র
২৮ জানুয়ারি ২০২২গণমাধ্যম যদি হয় সমাজের আয়না তাহলে গণমাধ্যমের বিষয়বস্তুর মধ্যেই সমাজের চিত্র ফুটে ওঠে৷ মহামারীর আগে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর আধেয় বা বিষয়বস্তু ছিল তিনটি ‘সি’ নির্ভর – ‘ক্রাইম’ (অপরাধ), ‘সিনেমা’ আর ‘ক্রিকেট’৷ মহামারিকালে গণমাধ্যমের বিষয়বস্তুতে আরেক ‘সি’- কোভিড যোগ হয়েছে৷ এই চার ‘সি’র বাইরে অতিমারির আগে ও অতিমারিকালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের আধেয়ের মধ্যে আরেকটি অতি সাধারণ বিষয় আছে, সেটি হলো উপাচার্য সমাচার৷ এই সমাচারের আদি সার হলো বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্য ও শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ৷
করোনাকালে সারা বিশ্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের স্ক্রিনের মূল খবর ছিল কিভাবে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হবে, কবে খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কবে আবার মুক্ত বাতাসে শুরু হবে শিক্ষার্থীদের অবাধ বিচরণ৷ কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এ সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া সংবাদগুলো হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের অনিয়ম, দুর্নীতি আর তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভ৷ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) গত কয়েক বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ জন উপাচার্যের দুর্নীতির তদন্ত করেছে৷ এখনও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে৷ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক মাসে বাংলাদেশের কোনো না কোনো গণমাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনিয়ম আর এ সম্পর্কিত তদন্তসহ ইত্যকার খবর, সম্পাদকীয় ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে৷ প্রায় সময়ই তারা নানা নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছেন, সম্মান হারাচ্ছেন৷ ফলশ্রুতিতে শিক্ষক এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে৷ সবশেষ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহগুলো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিদের মর্যাদায় বিরাট এক প্রশ্ন এঁকে দিয়েছে৷
এ পরিস্থিতি যেমন একদিনে তৈরি হয়নি তেমনি একক কোনো কারণে এটি ঘটছে না৷ মোটাদাগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের রাজনীতি ও তদবিরের অপসংস্কৃতি, দক্ষ ও একাডেমিক ব্যক্তিদের মূল্যায়নের কোনো সুযোগ না থাকা, দলান্ধ উপাচার্য নিয়োগের প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া এবং নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যদের জবাবদিহিতার অভাব পরিস্থিতিকে আজকের পর্যায়ে নিয়ে আসছে৷
ইউজিসির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে৷ দুই ভাবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ হয়৷ ৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়োগ হওয়ার কথা৷ বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷ দুটো পদ্ধতিই এতটা রাজনৈতিক যে, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগ একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ভিন্ন আর কিছুই না এবং এখানে কোন একাডেমিক বা পণ্ডিত লোক খোঁজার চেয়ে দলীয় আজ্ঞাবহ পালের গোদা নিয়োগ করা হয়৷
৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী সিনেট থেকে মনোনীত ব্যক্তির মধ্যে উপাচার্য হিসেবে আচার্য কর্তৃক নিয়োগের কথা বলা আছে৷ কিন্তু সিনেট নির্বাচন এখানে কালেভদ্রে হয়৷ নব্বইয়ের দশক থেকে এই চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নির্বাচনের অভিজ্ঞতা হলো শিক্ষকদের মধ্যে নোংরা রাজনীতির যথেচ্ছ ব্যবহার৷ সিনেট নির্বাচনে জেতার জন্য অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অপরাজনীতির অনেক কৌশলই আমরা প্রয়োগ করতে দেখেছি৷ ২০১৭ সালে ঢাবি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতি ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল, এমনকি প্যানেল বিরোধ আদালতেও গড়িয়েছিল৷ তাছাড়া নির্বাচন উপলক্ষে নানা সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশে পরবর্তীতে অনেক ধরনের জটিলতা তৈরি করে৷ আবার উপাচার্য প্যানেল তালিকায় ফলাফলের ধারাক্রম বজায় না রাখার ঘটনাও ঘটেছে৷ প্যানেলে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও অধ্যাপক আহমদ শরীফকে উপাচার্য করেনি এরশাদ সরকার৷ তবে ভাল উপাচার্য নিয়োগের ইতিহাসও আছে৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে (ম্যাক) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, অধ্যাপক খান সরওয়ার মুরশিদকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের, অধ্যাপক ইন্নাস আলীকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং শিক্ষাবিদ এনামুল হককে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেছিলেন৷
অন্যদিকে বাকি ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, আচার্য কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে চার বছরের জন্য নিযুক্ত হয়ে থাকেন৷ এসব উপাচার্যদের বাছাই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷ তবে উপাচার্যদের যোগ্যতার শর্তগুলো কি হবে সে বিষয়ে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ বা আইনে কিছুই বলা নেই৷ একমাত্র সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিশেষায়িত কোন একাডেমিশিয়ান বা অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সম্মানিত অধ্যাপককে আচার্য চার বছরের জন্য নির্ধারিত শর্তে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করবেন৷
সারাবিশ্বে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটি অত্যন্ত সম্মানের, মর্যাদাসম্পন্ন৷ এই পদটির প্রতীকী মূল্যের ব্যাপ্তি অনেক বিশাল৷ সাধারণত উপাচার্য হয়ে থাকেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেন৷ তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন৷ পৃথিবীর আর কোন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে সরকারি পছন্দের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের বিধান নেই৷ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক পছন্দসই দলান্ধ লোক খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের সবচেয়ে ভাল একাডেমিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার যোগ্যতা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কি আছে? এ প্রক্রিয়া শুধু হাস্যকরই নয়, দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষালয়গুলোর প্রতি চরম অবহেলা আর অবজ্ঞার পরিচয়৷ মন্ত্রণালয় সব সময় খুঁজে বের করে সরকারের আজ্ঞাবহ লোককে৷ সিনেট হোক কিংবা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই হোক, উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াটি এখন নির্ভর করছে তদবিরের জোর আর ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্যের ওপর৷ ফলে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের আবেদনপত্রে গবেষণাকর্মের স্তুপের চেয়ে তদবিরে কতটা জুতার সুখতলি ক্ষয়েছেন সেটা এখানে মূখ্য বিচার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়৷ সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে সম্ভাব্য উপাচার্যের ভিশন ও মিশন যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা সেখানে তদবির ও দলান্ধ দক্ষতা সরকার এবং মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রশাসনিক নেতৃত্বদানের সক্ষমতা হিসেবে বিবেচিত হয়৷ মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী মনে করেন একজন উপাচার্যকে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অনেক কাজ করতে হয়, তাই শুধু শিক্ষাবিদ সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেন না—তার ভেতর নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ থাকতে হয়৷ সে জন্য নেতৃত্ব দিতে পারেন, সে রকম উপাচার্য নিয়োগ দিতে হয়৷ পণ্ডিত ও তাত্ত্বিক বা একাডেমিশিয়ান না হয়ে উপাচার্য হওয়ার স্বপ্ন বাংলাদেশেই সম্ভব৷ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে উপাচার্যের সন্ধান কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সে উদাহরণ আমরা দেখেছি গত বছর শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে৷ মন্ত্রণালয় বা সরকার যখন যুৎসই আজ্ঞাবহ দলান্ধ উপাচার্যের সন্ধান না পায় তখন কোনো আমলাকে এ পদে বসিয়ে দিতে কার্পণ্য করে না৷ দলীয় অনুগত উপাচার্য নিয়োগ দেয়ার ফল কত খারাপ হতে পারে সেটি ২০১০ সালে বুয়েটে অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে নিয়োগের পর বুয়েট সংশ্লিষ্ট সবাই দেখেছে৷
দলীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব উপাচার্যের কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা শিক্ষার্থীরা সবসময় উপলক্ষই থেকে যান, তাদের লক্ষ্য হয় দলীয় প্রভুদের খুশি রাখা এবং যে কোনো মূল্যে দলীয় সিদ্ধান্ত পালন করা৷ বাংলাদেশের কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলতে পারবেন না তিনি যোগদানের আগে ওই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই পদের দায়িত্ব সম্পর্কে হোমওয়ার্ক করতে পেরেছেন৷ কোন উপাচার্যকে আজ পর্যন্ত বলতে শুনিনি তার চার বছর মেয়াদের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা আছে৷ এই দায়বদ্ধতা ছাড়া জবাবদিহিতার আসার প্রশ্ন আসেই না৷ উপাচার্যরা জানেন তাদের দায়বদ্ধতা সরকারের কাছে, মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে৷ সেজন্য তারা সরকার ও মন্ত্রণালয়কেই খুশি রাখতে সচেষ্ট থাকেন৷ এ কারণে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি খুবই গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এখানকার উপাচার্যদের এতই ক্ষমতা যে তারা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিক্রিও করে দিতে পারেন৷ এক ধরনের স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে তারা বিশ্ববিদ্যালয় চালান৷ ফলে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে যে ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর অনিয়মের অভিযোগ উঠে তার প্রতি যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার বা মন্ত্রণালয় কর্ণপাত না করছেন ততক্ষণ পর্যন্ত এসব কিছু গণমাধ্যমের খবরের উপজীব্য আর সামাজিক মাধ্যমের আলোচনার খোরাকই থেকে যায়৷ উপরন্তু প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যন্তরীণ শিক্ষক রাজনীতি এতটা অপরাজনীতির সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনিয়মের বিরুদ্ধে শিক্ষক সমিতিগুলোও নিশ্চুপ থাকে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য এখন বশংবদ দালাল বানানোর প্রতিযোগিতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের স্বায়ত্তশাসন যতটা বিকিয়ে দেয়া যায় সে চেষ্টা করা৷ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে থেকে শুরু করে শিক্ষকদের আবাসনসহ নানা সুবিধা এখন রাজনীতি নির্ভর হয়ে গেছে৷ একজন প্রভাষক নিয়োগ পাওয়ার পর আবাসিক শিক্ষক হওয়া, তার বাসা বরাদ্দ, কখনও কখনও পদোন্নতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির সাথে তিনি কতটা জড়িত বা লেজুড়ভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতিতে তিনি কতটা সময় দিচ্ছেন তার উপরই নির্ভর করে৷ আবার প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির কারণে যে কোন উপাচার্য দায়িত্ব নেয়ার পরই পক্ষে বিপক্ষে দুটি গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে৷
একটি দেশ আগামীতে কতটা এগিয়ে যাবে সেটি নির্ভর করে তার শিক্ষা পদ্ধতি কাঠামো কতটা শক্তিশালী ও সুদূরপ্রসারী তার ওপর৷ এক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি সবচেয়ে মজবুত হওয়া জরুরি৷ স্বাধীনতার ৫০ বছরে একটি দেশ ৫০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করেছে, কিন্তু একটি স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন উপাচার্য নিয়োগ পদ্ধতি ঠিক করতে পারেনি৷ এটি দুঃখজনক এবং হতাশার৷ তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন পদ্ধতিতে উপাচার্য নিয়োগের নীতিমালা প্রণয়ন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে৷ ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেছিল৷ কিন্তু পরবর্তীতে সরকার এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি৷ বাংলাদেশে এখন যে প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ হয় তাতে আত্মসম্মানবোধ আছে এমন কোন যোগ্য শিক্ষক এ পদে নিজেকে ভাবতে পারেন না৷
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবশ্যই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে উপাচার্য নিয়োগ করা উচিত৷ একজনের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস থেকে ছয় মাস আগে নতুন উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে৷ বিজ্ঞাপনের শর্ত পূরণ করলে যোগ্য প্রার্থীরা দেশি-বিদেশি অধ্যাপকের সমন্বয়ে গঠিত একটি সার্চ কমিটির সামনে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তার ভিশন ও মিশন উপস্থাপন করবেন৷ তার মেয়াদের চার বছরের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করবেন৷ এই সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে আচার্য একজনকে নিয়োগ দিবেন৷ কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য/উপদেষ্টা যাতে উপাচার্য পদের জন্য যোগ্য না হোন সেটি শর্তের মধ্যে প্রয়োগ করা দরকার৷ কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে এখন শিক্ষক হওয়ার চেয়ে রাজনৈতিক দলের উপ-কমিটির সদস্য হওয়ার লোভ অনেক বেশি৷ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাতে হলে শিক্ষক রাজনীতির সংস্কৃতি পরিবর্তন আনতেই হবে, বদলাতে হবে উপাচার্য নিয়োগ পদ্ধতি৷
আহমদ ছফা'র ‘গাভী বিত্তান্তে’র বয়স ২৭ বছর হতে চললো৷ কী অসাধারণ! এ উপন্যাসের প্লট এখনও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি৷ এখনও বাংলাদেশে সরকার খুঁজে বেড়ায় মিঞা মোহাম্মদ আবু জুনায়েদের মতো উপাচার্য৷ নুরুন্নাহার বানুরা যতই ভাবুক ‘সতীর ভাগ্যে পতির জয়’, জুনায়েদরা জানেন, শর্তহীন আনুগত্য আর তদবিরই মূলমন্ত্র৷ পরিণতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তরণীর মতো গাভীর সংখ্যা বাড়ছেই৷ কিন্তু উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়াটি এমন এক রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের মধ্যে আবদ্ধ যেখানে মূল খেলোয়াড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই৷ তাদেরকেই ভাবতে হবে তারা এই দুষ্টচক্র থেকে বের হতে চান কীনা?