বাঙালির আর কিছু থাক বা না থাক, মুখ আছে৷ সেই মুখ খুললেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে প্রখর সব শব্দবান৷ সশব্দে তা আছড়ে পড়ে প্রতিপক্ষের ওপরে৷ তাতে যুক্তি থাকে খুব কম৷
বিজ্ঞাপন
থাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ, আর নিজেদের অলীক সব ধারণার প্রকাশ৷ আমার মতে মিলছে না, একেবারে বাক্যের তোপে উড়িয়ে দাও৷ সোজাসুজি যাও চরিত্রহননে৷ তাকে রাঙিয়ে দাও মাওবাদীর অতি লালে বা তৃণমূলের সবুজে অথবা বিজেপি-র গেরুয়ায়৷ সেলফোন-যুগের আগে পাড়ার আড্ডায় এই সব চলত৷ কিন্তু এখন প্রযুক্তি সুযোগের দিগন্ত খুলে দিয়েছে৷ আমজনতার সামনে অপ্রত্যাশিত সুযোগ৷ যখন খুশি ঢুকে যাও সামাজিক মাধ্যেম৷ বর্ষণ করো গালাগালি৷ তাতে কাজ না হলে লাঞ্ছনাকর যত শব্দ আছে তা দাগিয়ে দাও৷ আমার উল্টো মতে কথা বলছে বা যুক্তি দিয়ে আমায় আক্রমণ করছে, এত বড় সাহস! এটাকেই আরো বাড়িয়ে নিয়ে যায় রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের ট্রল বাহিনী৷ দিনকে রাত, রাতকে দিন করা তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে বিপক্ষকে শুইয়ে দেওয়ার জন্য লাগাতার ট্রলিং৷ গোয়েবলসের শিখিয়ে দেয়া পথে হেঁটে মিথ্যাকে দেশভর ছড়িয়ে দেয়া, যাতে তা সত্য মনে হয়৷
সাইবার বুলিং ও আত্মহত্যা
অনলাইনে হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের কারণে অনেকেই হতাশায় ভোগেন৷ এদের একটি অংশ হতাশা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷
জাপানের ২২ বছর বয়সি হানা কিমুরা একজন পেশাদার কুস্তিগীর ছিলেন৷ এছাড়া নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় রিয়েলিটি টিভি শো ‘টেরাস হাউস’-এ অভিনয় করেছেন তিনি৷ এ বছরের ২৩ মে আত্মহত্যা করেন কিমুরা৷ অনলাইনে টেরাস হাউসের দর্শকদের ক্রমাগত সমালোচনার প্রতিক্রিয়ায় আত্মহত্যা করার আগে বেশ কয়েকটি টুইট করেছিলেন তিনি৷ কিমুরার টুইটগুলোতে আত্মহত্যার আভাস ছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Pizzoli
সল্লি
দক্ষিণ কোরিয়ার ২৫ বছর বয়সি সল্লি একজন অভিনেত্রী, গায়িকা ও মডেল ছিলেন৷ মেয়েদের বিখ্যাত কে-পপ ব্যান্ড ‘এফ (এক্স)’-এর সাবেক সদস্য ছিলেন তিনি৷ তবে তার আরেক পরিচয় তিনি ‘নো-ব্রা’ আন্দোলনের একজন সমর্থক ছিলেন৷ অর্থাৎ, মেয়েদের বক্ষবন্ধনী না পরার পক্ষে ছিলেন সল্লি৷ এ কারণে তাকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে৷ এসবের কারণে হতাশায় ভুগে গতবছর অক্টোবরে আত্মহত্যা করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/Yonhap
খু হারা
দক্ষিণ কোরিয়ার কে-পপ ব্যান্ড ‘খারা’র সদস্য খু হারা গতবছর নভেম্বরে আত্মহত্যা করেন৷ তিনিও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছিলেন৷ তার সাবেক প্রেমিক বিনা অনুমতিতে ধারণ করা তাদের যৌন মিলনের ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিলে মামলা করেছিলেন খু হারা৷ এরপর ঐ ভিডিও প্রকাশিত হলে অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন তিনি৷ ভালো বন্ধু সল্লির মাসখানেক পর আত্মহত্যা করেন খু হারা৷
ছবি: picture-alliance/YONHAPNEWS AGENCY
অ্যামান্ডা টড
ক্যানাডার ১৫ বছর বয়সি টড সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ২০১২ সালে আত্মহত্যা করে৷ তার আগে ইউটিউবে সে একটি ভিডিও পোস্ট করে৷ অ্যামান্ডা জানায়, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ভিডিও চ্যাট করতে গিয়ে একজনে সঙ্গে তার পরিচয় হয়৷ একসময় সে তাকে তার খোলা বুক দেখাতে রাজি করায়৷ এরপর সেই ছবি বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ পরে তা সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশও করা হয়৷ এই ঘটনায় অ্যামান্ডাকে কয়েকবার স্কুল বদল করতে হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রুকাইয়া রূপা
পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার স্কুল শিক্ষার্থী রূপা (১৬) গত বছর আগস্টে আত্মহত্যা করে৷ পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রের উল্লেখ করে প্রথম আলো জানায়, তামিম খান (১৮) নামে একজন রূপাকে তার সঙ্গে প্রেম না করলে আপত্তিকর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ রূপার বাবার দাবি, তার মেয়ের ছবি ফটোশপ করে তামিম বিভিন্নজনের কাছে ছড়িয়েছে৷ তাই তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে৷
ছবি: Klicksafe/M. Kusch
অ্যামি ‘ডলি’ এভারেট
১৫ বছরের অস্ট্রেলীয় এই শিক্ষার্থী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে ২০১৮ সালে আত্মহত্যা করে৷ এরপর অস্ট্রেলিয়ায় সাইবার বুলিং নিয়ে আলোচনা শুরু হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Akubra Hats
১০ বছরের মারিয়ান
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার মেসা শহরের দশ বছর বয়সি মারিয়ান হার্নান্দেজ রোখাস সম্প্রতি আত্মহত্যা করেছে৷ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে সে এ কাজ করেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় দৈনিক ‘দ্য অ্যারিজোনা রিপাবলিক’ জানিয়েছে৷ মোবাইলে তাকে নানারকম বার্তা পাঠিয়ে হয়রানি করা হতো বলে জানিয়েছে রোখাসের বন্ধুরা৷
ছবি: picture-alliance/empics/P. Byrne
প্যারিস জ্যাকসন
মাইকেল জ্যাকসনের মেয়ে প্যারিস জ্যাকসন তার চেহারা নিয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছেন৷ সে কারণে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন বলে ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, ‘‘বাকস্বাধীনতার বিষয়টি ভালো৷ কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের জাতির জনকেরা যখন সংশোধনী (সংবিধানে) রচনা করছিলেন তখন সামাজিক মাধ্যমের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেননি৷’’
ছবি: Getty Images/N. Barnard
বিজয়লক্ষ্মী
তামিল অভিনেত্রী বিজয়লক্ষ্মী সম্প্রতি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন৷ তামিল নায়ক কাম রাজনীতিবিদ সীমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছিলেন তিনি৷ তার অভিযোগ, সীমান তাকে বিয়ের অঙ্গীকার করেছিলেন৷ আত্মহত্যার জন্য বিপি ট্যাবলেট খেয়েছেন জানিয়ে ২৬ জুলাই রাতে ফেসবুকে ভিডিও প্রকাশ করেন বিজয়লক্ষ্মী৷ তিনি অভিযোগ করেন, সীমানের দলের লোকেরা কয়েকমাস ধরে অনলাইনে তাকে হয়রানি করেছে৷ সেজন্য তিনি প্রচণ্ড চাপ অনুভব করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
গতবছর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ইউনিসেফের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে ৩২ শতাংশ সাইবার হয়রানির মুখে পড়ছে৷ এদিকে, গতবছর সেপ্টেম্বরে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশুক চাকমা জানান, ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে৷
ছবি: DW/A. Islam
10 ছবি1 | 10
উত্তর প্রদেশে ভোটের আগে হঠাৎ সামাজিক মাধ্যমে একটা কাহিনি ছড়িয়ে গেল৷ অখিলেশ যাদব তর্কাতর্কির সময় বাবা মুলায়ম সিং যাদবকে চড় মেরেছেন৷ মুহূর্তে কাহিনি ভাইরাল৷ দলের সমর্থকরা পর্যন্ত অখিলেশের ওপর চটে লাল৷ এত বড় সাহস বাবা মুলায়মকে চড়? শিক্ষা দিতে হবে অখিলেশকে৷ ছেলে অখিলেশ প্রতিবাদ করেননি, একবারের জন্যও বলেননি, এ সব মিথ্যা কথা৷ হয়ত ভেবেছিলেন, অলীক কাহিনির কী জবাব দেবেন৷ ভোট চুকে যাওয়ার অনেক পরে দলের কর্মীদের এক সভায় চড়ের উদাহরণ তুলে অমিত শাহ বলেছিলেন, এতে বিজেপির সুবিধা হয়েছিল, তবে এরকম মিথ্যা রটানো উচিত নয়৷
একটা ব্যক্তিগত উদাহরণ দেয়া যাক৷ পশ্চিমবঙ্গের ওপর আমফানের তাণ্ডব সবে শেষ হয়েছে৷ উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মানুষের কাছে খাবার জল পর্যন্ত নেই৷ চারপাশে হাহাকার৷ মাথার ছাদ গেছে৷ সঞ্চয় শেষ৷ নোনা জলে ভরে গেছে মাঠ৷ আমার সহকর্মী সম্যন্তক তার বন্ধুদের সঙ্গে ত্রাণ নিয়ে দৌড়াচ্ছে কখনো সুন্দরবন, কখনো বসিরহাট৷ একটার পর একটা ছবি পাঠাচ্ছে৷ মর্মস্পর্শী৷ এক বৃদ্ধা তার শেষ সম্বল একটা ছাগলকে পাশে নিয়ে রাস্তায় বসে আছেন৷ একটু পানীয় জল পাওয়ার আশায় হাত বাড়িয়ে আছেন মানুষ৷ আর সামাজিক মাধ্যম জুড়ে চলছে এক অমানবিক কলরব৷ কোনো নেতা একদিন সামান্য ত্রাণ নিয়ে বের হলেন, ব্যস তার ছবিতে গগন ফাটে৷ বকিরা শুধু অভিযোগের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন৷ প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে পড়ছেন৷ স্যমন্তকের ছবির পাশাপাশি এই চিরকালীন সুবিধাবাদী বাঙালির ছবি মেলানো যাচ্ছিল না৷
সামাজিক মাধ্যমে নিয়মিত লেখা আমার ধাতে নেই৷ কী মনে হলো, লিখে ফেললাম, সময় তো শেষ হয়ে যাচ্ছে না৷ রাজনীতি করার সময়৷ দেখনদারির সময়৷ অন্তত এই সময়ে যারা পারেন, তারা দুর্গত মানুষদের সাহায্যের জন্য টাকা দিন৷ আর দয়া করে কোনো জায়গায় ত্রাণ দিয়ে ফলাও করে ছবি দেবেন না৷ অসহায় মানুষের পাশাপাশি সেই ছবিগুলো দেখতে ভালো লাগছে না৷ আর দয়া করে ওই মানুষগুলোকে নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করুন৷ তারা একটু সামলে উঠুন৷ তারপর যত পারেন রাজনীতি করবেন সকলে৷ ব্যস, আক্রমণ শুরু হলো৷ আমি কোন দলের হয়ে কথা বলছি, সেই প্রশ্ন উঠে গেল৷ সবিনয়ে বলেছিলাম, আমি আমার কথা বলেছি, অন্যরা তাদের কথা বলতে পারেন৷ তার জন্য ব্যক্তিগত আক্রমণের দরকার নেই৷ ভবি ভুলবার নয়৷ নেকড়ে তখন শিকার পেয়ে গেছে৷
আমি উপেক্ষা করেছি ওই সব আক্রমণ৷ কারণ, ক্লেদের মধ্যে ঢোকা অর্থহীন৷ তবে সাকিবের স্ত্রী যেমন ছবি মুছে দিয়েছেন, আমি তেমনভাবে নিজের মত মুছে দেইনি৷ একবার প্রতিবাদ করে নিজের মতে স্থির থেকে উপেক্ষা করেছি ওই ব্যক্তিগত আক্রমণ৷ কারণ, উপেক্ষাও তো প্রতিবাদের হাতিয়ার৷ অর্থহীন প্রলাপকে গুরুত্ব না দেয়া৷ এই আক্রমণ তো আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে৷ বিদ্যাসাগর যখন বিধবাবিবাহ দিচ্ছেন, তখন এক বিখ্যাত ব্যক্তি বলেছিলেন, শুনিতেছি কলিকাতায় এক পণ্ডিত না কি বিধবাবিবাহ দিতেছে৷ সে যদি পণ্ডিত হয় তো মূর্খ কে? রবীন্দ্রনাথকেও তো শুনতে হয়েছে, তিনি ইংরেজ কবিদের কবিতা চুরি করে নোবেল পেয়েছেন৷ যারা রবীন্দ্রনাথকে ছাড়ে না, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, জগদীশচন্দ্রদের তুলোধুনো করে, তারা কি আমার মতো সাধারণ মানুষকে ছাড়বে? সেই ‘অলীক কুনাট্যের’ মঞ্চ এখন সামাজিক মাধ্যম৷ বিষ উগড়ে যাও৷ সেই বিষ মন্থন করে কোনোদিন কেউ অমৃত পাবে না৷
এ সবই হতাশা, আক্রোশ, স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, দলবাজির প্রকাশ৷ তার প্রতিবাদ হোক৷ না হলে চরম উপেক্ষা করা হোক৷ তাদের কথা না শুনলে, আমল না দিলেই তো আক্রমণকারীদের মনসা পূর্ণ হবে না৷