দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সরকার গড়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কোনো দলই সরকার গড়তে রাজি নয়৷ দ্বিতীয় বৃহত্তম দল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিকে কংগ্রেস বাইরে থেকে সমর্থন দিতে চাওয়ায় কেজরিওয়াল এখন উভয় সংকটে৷
বিজ্ঞাপন
কেন্দ্রশাসিত দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনি ফলাফল প্রকাশের দশ দিন পরেও সরকার গঠনের সম্ভাবনা অনিশ্চিত৷ কারণ প্রধান তিনটি দল বিজেপি, আম আদমি পার্টি এবং কংগ্রেস কেউই সরকার গড়ার মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি৷ ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় কোনো দলই সরকার গঠনের মতো অবস্থায় না থাকায় দিল্লির উপ-রাজ্যপাল নাজিব জং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো তাঁর রিপোর্টে বিধানসভা জিইয়ে রেখে রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ করেছেন৷ দিল্লি বিধানসভার মেয়াদ শেষ হয় ১৭ ডিসেম্বর৷ তবুও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবিষয়ে তাড়াহুড়ো করার পক্ষপাতি নন৷ আম আদমি পার্টি কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়বে কিনা তা দেখার পরই রাষ্ট্রপতি শাসন জারির প্রশ্ন আসবে৷ যদিও ভেতরে ভেতরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সরকারি তোড়জোর শুরু হয়ে গেছে৷
দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৩১টি আসন, আম আদমি পার্টি ২৮টি এবং কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ৮টি আসন৷ এর প্রেক্ষিতে বিজেপি প্রথমেই তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়ে বলেছে তারা বিরোধী আসনে বসার পক্ষপাতি৷ দ্বিতীয় বৃহত্তম দল আম আদমি পার্টি পড়েছে এখন উভয় সংকটে৷ বিশেষ করে কংগ্রেস যখন নিজে থেকেই আম আদমি পার্টিকে বাইরে থেকে সমর্থন করতে চেয়েছে৷ আর কংগ্রেসের সমর্থন আম আদমি পার্টিকে ঠেলে দিয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জের দিকে৷ কংগ্রেসের যুক্তি, ভোটারদের ঘাড়ে নতুন নির্বাচনের বোঝা চাপাতে চায় না তারা৷ এতে জনগণের অর্থের অপচয় হবে৷ প্রসঙ্গত, রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ছয় মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন করাতে হবে এবং সরকার গঠন করতে হবে৷
দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জয়
দুর্নীতিবিরোধী দল ‘আম আদমি পার্টি’ দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে চমক দেখিয়েছে৷ ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হারিয়ে শুধু দিল্লির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেনি, ভারতের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিকল্পে স্বস্তি খোঁজা
আত্মপ্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টিতে জিতেছে আম আদমি পার্টি৷ অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নতুন একটি দলের এমন সাফল্যকে দেখছেন ‘সাধারণ মানুষের জয়’ হিসেবে৷ তাদের এ জয় কংগ্রেস তো বটেই, এমনকি এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন পাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ৷আম আদমি পার্টি লোকসভা নির্বাচনের জন্য ভোটারদের সামনে বিকল্প পছন্দ হিসেবে উঠে এসেছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/Narinder Nanu
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ
আম আদমি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তাঁর দল ৩২টি আসন পাওয়া ডানপন্থী দল বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে রাজ্য সরকারে অংশীদার হবে না৷ ঘুস কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল আম আদমি পার্টি৷ অরবিন্দ কেজরিওয়াল ছিলেন সেই আন্দোলনের পুরোভাগে৷ দিল্লির নির্বাচনে এ বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: Reuters
কংগ্রেসের ভরাডুবি
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই ভারতীয় রাজনীতিতে বড় দল কংগ্রেস৷ এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে সেই দল হেরে গেছে নবাগত আম আদমি পার্টির কাছে৷ ভোটাররা যে দিল্লিতে অন্তত কংগ্রেসের শাসনে ক্ষুব্ধ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই৷ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দিক্ষিতের নেতৃত্বে টানা ১৫ বছর রাজ্য সরকার পরিচালনা করেছে কংগ্রেস৷ এবার শীলা দিক্ষিত নিজেই হেরেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে৷ মাত্র ৮টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস৷
ছবি: Reuters
নতুন পথের বাঁকে
ভারতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন শুরু করেছিলেন আন্না হাজারে৷ ৭৪ বছর বয়সি এই সমাজকর্মী সংসদে ‘জন লোকপাল বিল’ পাস করানোর দাবিতে শুরু করেছিলেন অনশন৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন তখনকার সেই দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে৷ পরে আম আদমি পার্টি গড়েন৷ ‘আম আদমি’, অর্থাৎ সাধারণ জনগণের সমর্থন নিয়ে কেজরিওয়াল এবার এক নতুন পথের বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছেন ভারতের রাজনীতিকে৷
ছবি: Reuters
‘গণতন্ত্রবিরোধী’ দাবি!
কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা দুর্নীতিকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করলেও এর সমাধানের উপায় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অদূরদর্শীতার পরিচয় দিয়েছেন৷ কংগ্রেস সমর্থকরা বলছেন, আম আদমি পার্টি এবং এর বাইরের সমাজকর্মীরা প্রকারান্তরে অনির্বাচিতদের কর্তৃত্বের কথা বলছেন, অথচ গণতন্ত্র নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই জনগণের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রায়
গত এক বছরে বেশ কয়েকটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দিল্লিতে৷ ধর্ষণ রোধ করে দিল্লির নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার৷ এ ব্যর্থতার জন্য দিল্লির ভোটাররা রাজ্য সরকারকেই দায়ী মনে করে৷ বিশ্লেষকদের মতে, নারীর নিরাপত্তা বিধানে রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার কারণে জনমনে জন্ম নেয়া হতাশারও প্রতিফলন ঘটেছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে৷
ছবি: Reuters
নতুন চ্যালেঞ্জার
দিল্লির মতো রাজস্থান, ছত্তিশগড় আর মধ্য প্রদেশের নির্বাচনেও বিজেপির কাছে হেরেছে কংগ্রেস৷ আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সেলে এমন পরাজয় কংগ্রেসের জন্য নিশ্চয়ই খুব বড় ভাবনার বিষয়৷ আম আদমি পার্টি বিধানসভা নির্বাচনে শুধু দিল্লিতেই অংশ নিয়েছে৷ তবে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনেও অংশ নেয়ার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে দলটি৷ বিজেপির জন্যও এটা কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ!
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করা উচিত হবে কিনা সেটা নিয়ে কেজরিওয়াল পড়েছে দোটানায়৷ কারণ প্রাক-নির্বাচনি প্রচারে কংগ্রেস বা বিজেপি থেকে দূরে থাকার কথা জোর গলায় বলেছিলেন কেজরিওয়াল৷ এখন কংগ্রেসের হাত ধরলে সেটা হবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল৷ অথচ আন্না হাজারের দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলন থেকে জন্ম নেয়া এবং প্রথমবার নির্বাচনে নেমে এক বছরের এক নবীন পার্টির কাছে সরকার গঠনের সুযোগও হাতছাড়া হতে দিতে চাইছে না কেজরিওয়াল৷ সেক্ষেত্রে তিনি বিজেপি ও কংগ্রেসের কাছে পার্টির ১৮ দফা শর্ত মেনে নেবে বলে মুচলেকা দেবার দাবি তুলে চিঠি পাঠান৷ বিজেপি তা খারিজ করে দিলেও কংগ্রেস তাতে রাজি হয়৷ কারণ কংগ্রেসের মতে, ১৮ দফা শর্তের মধ্যে ১৬টি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তেই কার্যকর করা যায়, তারজন্য বিধানসভার অনুমোদন দরকার হয় না৷ অন্য দুটি যেমন, দুর্নীতি-বিরোধী লোকপাল বিল এবং দিল্লিকে পূর্ণ রাজ্যে উন্নীত করার বিষয়টি সংসদের বিবেচ্য৷
এমতাবস্থায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কেজরিওয়াল তাঁর দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ নির্বাচনি ক্ষেত্রের মানুষদের এবিষয়ে কী মত তা জানার কথা বলেন এবং তার ভিত্তিতে নেয়া হবে সরকার গড়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনীতি হলো অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার এক আর্ট৷ কেজরিওয়াল কীভাবে সেটা করেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়৷