‘‘উরি সন্ত্রাসী হামলায় ১৮ জন জওয়ানের জীবনদান বিফলে যাবে না৷ পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে'' – এ কথাই বলেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী৷ আর মোদীর এ কথার দিন দুয়েকের মধ্যেই দু'জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করল ভারত৷
বিজ্ঞাপন
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে – এমন আশঙ্কা করছিলেন অনেকেই, বিশেষ করে উরির সেনা ছাউনিতে সন্ত্রাসী হামলা ও ১৮ জন জওয়ানের মৃত্যুর পর থেকে৷ তারপর এলো আরো একটা খবর৷ আবারো নাকি জঙ্গি হামলা হতে পারে ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে৷
বিশ্বস্ত সূত্রে এমন একটা খবর পাওয়ার পর বুধবার গোটা উপত্যকা জুড়ে তল্লাশি শুরু করে ভারতীয় সেনা৷ পাকিস্তান থেকে জঙ্গিরা ভারতে ঢুকে পড়েছে – তাই তাদের খুঁজে তো বের করতেই হবে! কিন্তু এই খুঁজতে খুঁজতেই একটা সময় নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে ভারতীয় সেনা, রাতভর চলে ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক'৷ এতে নিহত হয় পাকিস্তানের দু'জন জওয়ান, আহত প্রায় নয় জন৷ এছাড়াও উদ্ধার করা হয় প্রচুর অস্ত্র৷
পাকিস্তান দুই সেনা নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও, দেশের মাটিতে ভারতীয় সেনাদের ঢুকে পড়ার কথা অস্বীকার করেছে৷ বরং তাদের দাবি, ভারত গোলাগুলি শুরু করার পর পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও মোক্ষম জবাব দেওয়া হয়েছে৷
ভারত অবশ্য এ আক্রমণকে অকস্মাৎ বলেনি৷ বৃহস্পতিবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন (ডিজিএমও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল রণবীর সিং জানান, সন্ত্রাসীদের অঙ্কুশ বিনাশ করার জন্যই পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ঢুকে জঙ্গি ঘাঁটিগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তাঁর কথায়, ‘‘১১ই সেপ্টেম্বর পুঞ্চ এবং তারপর ১৮ই সেপ্টেম্বর উরি – বার বার এভাবে নিয়ন্ত্রণরেখা পার করে ভারতের মাটিতে হামলা চালানো অত্যন্ত ন্যক্কারজনক, আমাদের জন্য লজ্জাকর৷ জঙ্গিদের আর কোনোভাবেই ভারতে ঢুকে হামলা চালানোর বিষয়টি মেনে নেয়া যায় না৷ ভারত এমনটা আর কখনোই সহ্য করবে না৷''
ওদিকে সেনাবাহিনীর এই ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক'-এর খবর পাওয়ার পর থেকে ভারতের বিভিন্ন শহরে শুরু হয়েছে আন্দোৎসব৷
ইস্পাত মন্ত্রী বীরেন্দ্র সিং-এর মতো অনেকের মতে, শহিদ ভগত সিং-এর জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর এর চেয়ে যথাযথ উপায় আর হতে পারতো না৷
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।
ছবি: Reuters
19 ছবি1 | 19
ভারতের সংবদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, উরি অথবা পুঞ্চে হামলার পর জঙ্গিদের কাছ থেকে যে সমস্ত জিনিস-পত্র উদ্ধার করা হয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত যে, ওরা পাকিস্তান থেকেই এসেছিল৷ শুধু তাই নয়, পাক অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় এসব জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ডিজিএমও লেফটেন্যান্ট জেনারেল রণবীর সিং৷
হামলা-পালটা হামলা, সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ইসলামাবাদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত, তারপর আবারো হামলা-পালটা হামলা৷ প্রশ্ন হলো, তাহলে কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আবারো আসন্ন? গোটা বিশ্বই অপেক্ষা করছে এর উত্তরের জন্য৷ কিন্তু সামরিক সক্ষমতার হিসেবে ভারত এগিয়ে থাকলেও, পাকিস্তানের হাতেও আছে পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র! তাই ‘দাঁতের বদলে দাঁত নয়, পুরো চোয়ালটাই খুলে আনতে হবে' – হিন্দুত্ববাদীরা এমন দাবি জানালেও, একটা ভুল পদক্ষেপে বিপদ ঘনাতে পারে অচিরেই৷ তাই পাকিস্তানের ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটি সর্বদলীয় বৈঠকের ডাক দিয়েছেন মোদী, তাও আবার জরুরি ভিত্তিতে৷
বন্ধুরা, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কি আসন্ন? জানান আপনার মতামত, লিখুন নীচের ঘরে৷