বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছে ফিলিপাইন্সের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংক, আরসিবিসি৷ ৮.১০ কোটি ডলার হ্যাকিংয়ের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ব্যাংকটিকে ‘অসৎ আক্রমণ’ করায় এই মামলা বলে জানিয়েছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন ১৯ লাখ ডলারও দাবি করেছে আরসিবিসি৷
ফিলিপাইন্সের রাজধানী ম্যানিলার মাকাতি শহরের আঞ্চলিক আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে আরসিবিসি কর্তৃপক্ষ৷
ব্যাংক খাতের নানা কেলেঙ্কারি
রাজনীতি, অর্থ, পেশি শক্তি, অপকৌশল, দুর্নীতি – এ সব নানা কারণে বারবারই বিপদের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত৷ ব্যাংক খাতে নানা সময়ে সংঘটিত কেলেঙ্কারির খবর দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance / Klaus Ohlenschläger
রিজার্ভের অর্থ উধাও
২০১৬ সালে ঘটে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা৷ অজ্ঞাতনামা হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কায় পাচার করে দেয়৷ ফিলিপিন্সে পাচার করা ৮.১ কোটি ডলারের এখনো কোনো সুরাহা হয়নি৷ এ ঘটনার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷
ছবি: Reuters/A. Rahman
জালিয়াতের খপ্পরে এটিএম কার্ড
‘স্কিমিং ডিভাইস’ নামের বিশেষ এক যন্ত্র বসিয়ে গ্রাহকদের কার্ডের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে৷ চুরি করে তারা এর সঙ্গে এক জার্মান নাগরিক জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ প্রতারকদের আটক করা হলেও তারা বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে দুই দিনেই অন্তত ২০ লাখ টাকা তুলে নেয়৷
ছবি: bdnews24.com
হলমার্ক কেলেঙ্কারি
২০১২ সালে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা ফাঁস হয়৷ সে সময় কেবল সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে ২০১০-২০১২ সময়ে মোট তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়৷ এর মধ্যে অখ্যাত হলমার্ক গ্রুপ একাই আত্মসাৎ করে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা৷ তখন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়নি৷
ছবি: DW
বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি
রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া আব্দুল হাই বাচ্চু পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ পাওয়ার পর ব্যাংকটি অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়৷ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটিতে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম পায় বাংলাদেশ ব্যাংক৷ ব্যাংকের টাকা মেরে দিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনেক ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়৷ এসব ঋণের বেশিরভাগই আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি৷
ছবি: bdnews24.com
ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে লুটপাট
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে ঘটে এই ঘটনা৷ ব্যাংকটির তৎকালীন উদ্যোক্তারা অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা৷ লুটপাটের কারণে ২০০৬ সালে ব্যাংকটি অতিরুগ্ন হয়ে পড়ে৷ মালিকপক্ষের হাতে থাকা ব্যাংকের ৮৬ শতাংশ শেয়ারও বাজেয়াপ্ত করা হয়৷ তা কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ৷ তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তিত হয়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক হয়, তবে এখনো পুরো টাকা ফেরত পাননি গ্রাহকেরা৷
ছবি: imago/Milestone Media
ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়ম
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুমোদন দেয়া একটি ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংক৷ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দীকী নাজমুলের মালিকানাধীন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের ছয়টি শাখায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম পাওয়া যায়৷ এতে জনগণের সংরক্ষিত আমানত ফেরত দিতে অক্ষম হয়ে পড়ে ব্যাংকটি৷
ছবি: bdnews24.com
লুটপাটের অন্ত নেই
নতুন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ৭৪১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম দেখা যায়৷ ২০১০-২০১৫ সালে আইন লঙ্ঘন করে অ্যাননটেক্স নামে একটি গ্রুপকে ৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকার ফান্ডেড, নন-ফান্ডেড ঋণ প্রদান করে জনতা ব্যাংক৷ বিসমিল্লাহ গ্রুপ ২০১১ ও ২০১২ সালে দেশের পাঁচটি ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়৷
ছবি: DW
আরো আছে অনেক
এখানেই শেষ নয়৷ সময়ে সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে নানান অভিনব কৌশলে ভূয়া চুক্তিপত্র দেখিয়ে, কিংবা এক কাজে ঋণ নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করার অসংখ্য নজির আছে দেশে৷ তাই নানা সময়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংক খাত৷ শুধু তাই নয়, শেয়ার বাজারকে নানা সময়ে অতিমূল্যায়িত করে ব্যাংক খাতের ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance / Photoshot
8 ছবি1 | 8
আরসিবিসি দাবি করছে, সাইবার হামলার এই ঘটনায় কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক তাদেরকে অভিযুক্ত করে যাচ্ছে৷ অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘‘মানহানি, হয়রানি ও হুমকি প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আরসিবিসির সুনাম, খ্যাতি ও ভাবমূর্তি নষ্টের পরিকল্পনায় নেমেছে৷ উদ্দেশ্য একটাই, আরসিবিসি যাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে টাকা পরিশোধ করে৷ যদিও আরসিবিসির কাছে বাংলাদেশের কোনো টাকা পাওনা নেই৷’’ এর ফলে তাদের যে মানহানি হয়েছে তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১০ কোটি পেসো বা কমপক্ষে ১৯ লাখ ডলার চেয়েছে আরসিবিসি৷ বিষয়টি তারা মঙ্গলবার এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে৷
এদিকে চুরি যাওয়া টাকা ফেরত পেতে গেল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে মামলা দায়ের করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ এতে আরসিবিসিকে অর্থ আত্মসাতের ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার জন্য দায়ী করা হয়৷ মামলায় বাংলাদেশকে কারিগরি সব ধরণের সহযোগিতা দেয়ার কথা বলেছে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক৷
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অজ্ঞাত হ্যাকাররা নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভে থাকা ৮.১০ কোটি ডলার চুরি করে৷ এই টাকা তারা ম্যানিলার মাকাতি শাখার চারটি অ্যাকাউন্টে সরায়৷ অর্থ স্থানান্তরকারী প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের মাধ্যমে যা পরে ক্যাসিনোতে পাঠানো হয়৷ নির্দেশনা সত্ত্বেও আরসিবিসি তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ছাড় করে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগ রয়েছে৷ ব্যাংকটির শাখা ব্যাবস্থাপক মায়া দিগুইতোর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের ঘটনায় জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দেশটির আদালতও৷ গত ১০ জানুয়ারি দেশটির আদালত তাকে ৩২ থেকে ৫৬ বছরের কারাদণ্ড ও ১০.৯ কোটি ডলারের জরিমানা করেছে৷
চুরি যাওয়া ৮.১০ কোটি ডলারের মধ্যে এখন পর্যন্ত ফিলিপাইন্সের কাছ থেকে ১.৫ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা মূলত দেশটির এক জুয়ার কারবারি ফেরত দিয়েছে৷