আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের উষ্ণতা সর্বোচ্চ হতে পারে বলে সতর্ক করল জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক সংস্থা।
বিজ্ঞাপন
জাতিসংঘের জলবায়ু সংক্রান্ত সংস্থার নাম ওয়ার্ল্ড মেটিওরজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডাব্লিউএমও)। বুধবার এক বৈঠকের পর তারা জানিয়েছে, আগামী পাঁচবছর রেকর্ড তাপমাত্রা দেখতে চলেছে বিশ্ব। আবহাওয়ার চরম পরিবর্তন এই সময় দেখা যাবে। এল নিনোর অবস্থান এবং গ্রিন গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ হিসেব করে এই উপসংহারে পৌঁছেছেন তারা।
তারা জানিয়েছে, ৯৮ শতাংশ আশঙ্কা হলো, এই পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো একটি বছরে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছাবে। তবে আগামী পাঁচ বছরে তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান ভাবে বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপদের আশঙ্কা তৈরি হবে বলে জানিয়েছে ডাব্লিউএমও।
পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি আটকানোর জন্য গত কয়েকটি জলবায়ু সম্মেলনে প্রভূত আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ডাব্লিউএমও জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রির উপরে উঠে যেতে পারে।
আগামী কয়েকমাসের মধ্যেই এল নিনো তৈরির আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। এল নিনো আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক অবস্থান। এল নিনো আবহাওয়া গরম করে, লা নিনা আবহাওয়া ঠান্ডা করে। ডাব্লিউএমও-র বক্তব্য, এল নিনো তৈরি হলেও লা নিনা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তাই তাপমাত্রা বাড়তেই থাকবে। এর প্রভাব পড়বে স্বাস্থ্য, খাদ্যভাণ্ডার এবং সার্বিকভাবে পরিবেশের উপর। খড়া এবং বন্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। শস্য উৎপাদনে সমস্যা হতে পারে। নানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটতে পারে। সকলে যাতে এর জন্য তৈরি থাকে, সেই সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। আগামী ২২ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত আবহাওয়া সংক্রান্ত এক সম্মেলনে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা হবে বলে জানিয়েছে ডাব্লিউএমও।
২০২২ : জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের বছর
এ বছর বিশ্বের নানা দেশে প্রচণ্ড গরম পড়েছে, খরা, দাবদাহ হয়েছে, ঝড় আর বন্যার কারণেও বিপর্যস্ত হয়েছে কোটি কোটি মানুষের জীবন৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Peter Dejong/AP Photo/picture alliance
ইউরোপ : আগের চেয়ে গরম ও শুষ্ক
এ বছর গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম ছিল ইউরোপে৷ তখন এমন খরা ছিল যা গত ৫০০ বছরেও দেখা যায়নি৷ স্পেনে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে৷ দাবানলের কারণে রেকর্ড ৪৫জন মারা যান৷ ব্রিটেনসহ আরো কয়েকটি দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ায়৷ তখন বিভিন্ন স্থানে খাওয়ার পানির সংকট দেখা দেয়৷
ছবি: Thomas Coex/AFP
দাবদাহের কবলে ইউরোপ
পশ্চিমে পর্তুগাল, স্পেন এবং ফ্রান্স, পূর্বে ইটালি, গ্রিস ও সাইপ্রাস হয়ে উত্তরে সাইবেরিয়া পর্যন্ত ইউরোপের বিশাল এলাকা গ্রীষ্মে দাবদাহে পুড়েছে৷ আগুনে পুড়েছে ছয় লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমি৷ ২০০৬ সালের পর আর কখনো দাবদাহে এত বড় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি৷
বর্ষায় এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বন্যা হয়েছে৷ সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে পাকিস্তানে৷ প্রবল মৌসুমী বৃষ্টিতে দেশটির এক তৃতীয়াংশ ডুবে যায়, কমপক্ষে ৩৩ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়, প্রাণ যায় কমপক্ষে ১১০০ জনের৷ বন্যায় ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ আফগানিস্তানের কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনেক মানুষ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধার যন্ত্রণা মেনে নিতে বাধ্য হন৷
ছবি: Stringer/REUTERS
এশিয়ায় ঘূর্ণিঝড়
আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতকে এবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতও সামলাতে হয়৷ তবে চীনে গত ৬০ বছরের মধ্যে ভয়াবহতম খরা ও স্মরণকালের ভয়ঙ্করতম দাবদাহ হয়েছে৷ খরা ও দাবদাহের পাশাপাশি ছোট-বড় ১২টি ঘূর্ণিঝড়ও বয়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির ওপর দিয়ে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ফিলিপাইন্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া আর বাংলাদেশও টের পেয়েছে৷ এশিয়ার এই চার দেশেও এবার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে৷
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
আফ্রিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব
বিশ্বের বাকি সব অঞ্চল থেকে অনেক দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে আফ্রিকা৷ এ কারণে এই মহাদেশে বৃষ্টির ধরন বদলাচ্ছে, বাড়ছে অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, অনাবৃষ্টি, খরা৷ আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া এখন গত ৪০ বছরের মধ্যে ভয়াবহতম খরার সঙ্গে লড়ছে৷ খরার কারণে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে৷
ছবি: ZOHRA BENSEMRA/REUTERS
আফ্রিকায় বন্যা,খরায় চাষাবাদ বন্ধের জোগাড়
বন্যা এবং দীর্ঘ খরার কারণে আফ্রিকার বড় একটি অংশে বছরের বেশির ভাগ সময় স্বাভাবিক চাষবাস সম্ভব হয়নি৷ ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এবং কেনিয়ায় এ বছর অনেক মানুষ ক্ষুধায় মারা গেছে৷
ছবি: Dong Jianghui/dpa/XinHua/picture alliance
নর্থ অ্যামেরিকায় আগুন এবং বন্যা
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা এবং অ্যারিজোনায় একাধিক ভয়াবহ ঝড় হয়েছে৷ গ্রীষ্মের শেষ দিকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রার কারণে তিন রাজ্যেই দাবানল ছড়িয়ে পড়ে৷ অন্যদিকে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক এবং কেন্টাকি রাজ্যে ছিল বিপরীত চিত্র৷ প্রবল বর্ষণের কারণে বন্যা হয়েছে সেখানে৷
ছবি: DAVID SWANSON/REUTERS
ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড অ্যামেরিকা
সেপ্টেম্বরে ফ্লোরিডার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ইয়ান৷ ঝড়ের কারণে যে ব্যাপক ক্ষতি হয় রাজ্য কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে বর্ণনা করে৷ ফ্লোরিডার আগে অবশ্য কিউবায় আঘাত হেনেছিল ইয়ান৷ ঝড়ের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় বেশ কিছুদিন অন্ধকারে থাকতে হয় কিউবানদের৷ সেপ্টেম্বরে লাতিন অ্যামেরিকা এবং ক্যারিবিয়া হয়ে ক্যানাডার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ফিওনা৷
ছবি: Giorgio Viera/AFP/Getty Images
সেন্ট্রাল অ্যামেরিকাতেও ঝড়ের আঘাত
সেন্ট্রাল অ্যামেরিকায় শুধু ফিওনা আঘাত হানেনি৷ অক্টোবরে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় জুলিয়া৷ ব্যাপক ক্ষতি হয় তাতে৷
ছবি: Matias Delacroix/AP Photo/picture alliance
সাউথ অ্যামেরিকায় খরা
এ বছর প্রায় পুরো সাউথ অ্যামেরিকাই ভয়াবহ খরার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যায়৷ চিলিতে অনাবৃষ্টি চলছে ২০০৭ সাল থেকে৷ দেশটির অনেক নদী-নালা ৫০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে৷ মেক্সিকোতেও অনেক বছর ধরে বৃষ্টি হয় না৷ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে, বলিভিয়া, পানামা এবং ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ার একাংশও কয়েক বছর ধরে খরার সঙ্গে বসবাস করছে৷
ছবি: IVAN ALVARADO/REUTERS
জলমগ্ন নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া
অতিবৃষ্টির ফলে এ বছর অস্ট্রেলিয়ায় দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা৷ জার্মানিতে সারা বছরে যেটুকু বৃষ্টি হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে তার চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে শুধু জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাসে৷ লা নিনার প্রভাবে নিউজিল্যান্ডেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: Jenny Evans/Getty Images
11 ছবি1 | 11
ডাব্লিউএমও জানিয়েছে, তাদের অংক বলছে, ২০২৩ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে তাপমাত্রা গড়ে এক দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। যা রেকর্ড হিসেবে ধরা হবে। এর ফলে মেরু অঞ্চলে তাপমাত্রা তিন গুণ বাড়তে পারে। গত পাঁচটি শীতকালে তাপমাত্রার এই পরিমাণ বৃদ্ধি মেরু অঞ্চল দেখেনি। উত্তর ইউরোপ, আলাস্কা এবং উত্তর সাইবেরিয়ায় প্রবল বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা আছে। অন্যদিকে, অ্যামাজন এবং অস্ট্রেলিয়ায় খড়া হতে পারে।
এর আগে বিশ্বের উষ্ণতম সময় হিসেবে ধরা হতো ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী সময়কে। ২০১৬ সাল সবচেয়ে উষ্ণ ছিল বলে মনে করা হয়। এবার সেই রেকর্ড ভাঙতে চলেছে।