বাংলায় দুর্গাপুজো উদযাপনের যে আবহমান স্মৃতি সে-ও ফিরে ফিরে আসবে নানাজনের স্মৃতিকথায়, সংবাদমাধ্যমে কিংবা কলকাতা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রের পুজোসংখ্যাগুলোতে৷ ঢাকায় যেমন আমরা পত্রিকাগুলোর ঈদসংখ্যার জন্য মুখিয়ে থাকি, তেমনি অধীর আগ্রহে বসে থাকি কখন পছন্দের পুজোসংখ্যাটি হাতে আসবে৷ একসময় ‘পুজোর নতুন রেকর্ড’ বলে একটি ব্যাপার ছিল৷ আজকাল হয়ত পুজো উপলক্ষে নতুন গান পাওয়া যায় ইউটিউব বা স্পটিফাইয়ের দৌলতে; কিন্তু ছোটোবেলায় পুজোর নতুন রেকর্ড বা ক্যাসেট প্রাপ্তির যে আনন্দ আমরা ঢাকায় বসে পেয়েছি, তার তুলনায় সে কিছুই নয়৷ এখনও পুজোর সময় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি৷ বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি নেমন্তন্ন খাবার চলে খানিক ভাটা পড়লেও, যোগাযোগটা থাকে ষোলো আনাই৷ এসব কিছু মিলিয়ে পুজোর একটি হৈ হৈ স্মৃতি আমার চোখে লেগে থাকে সর্বক্ষণ৷
উপরের এ নাতিদীর্ঘ স্মৃতিচারণটুকু আমার ব্যক্তিগত৷ সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে৷ এর কিছু ঘটেছে স্বাভাবিকভাবে, সময়ের প্রয়োজনে; আর কিছু ঘটানো হয়েছে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রয়োজনে৷ গত প্রায় এক দশক ধরেই নানা কারণে বাংলাদেশে পুজোর চিত্রটি আলাদা করে বর্ণনা করতে হয়৷ একটু যেন জোর দিয়েই বলতে হয়- বাংলাদেশের দুর্গোৎসবটাও বেশ রঙিন, দারুণ ঘটা করে উদযাপন করা হয়৷ কথাগুলো জোর দিয়ে যে বলতে হয়, এর কারণ ঐতিহাসিক নয়; বরং রাজনৈতিক৷ ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, বাংলাদেশে আবহমান কাল ধরেই বিভিন্ন পূজা-পার্বন, বিশেষত দুর্গোৎসব, ভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠীর কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়েই উদযাপিত হয়ে আসছে- মানে নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড়-বাওড় বিধৌত বাংলাদেশের শ্যামশ্রীটুকুই তার উদযাপনের নানামাত্রায় ফুটে উঠে৷ আমার মতে, এ হলো ঐতিহাসিক বা নৃতাত্ত্বিক সত্য৷ কিন্তু এ সত্যের বাইরেও তো আরো সত্য আছে- যেখানে শুভবোধের রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির সামনে, যেখানে মানুষের সংস্কৃতি হয়ে পড়ে শ্লথ আর সে সুযোগে ভেদাভেদের সংস্কৃতি তার দানব পায়ের তলায় পিষ্ট করে সভ্যতাকে৷ সুতরাং, বাংলাদেশের আবহমানকালের ইতিহাসের পাতায় শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপনের যে রঙ লেগে আছে; আজ তা ফিকে, মলিন এবং অনেকটাই আর্তরবে পীড়িত- এ সত্যভাষণে আমার অন্তত কোনো কুণ্ঠা নেই৷ গেল বছর শারদীয় দূর্গোৎসবের পুরোটা সময়ই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে নারকীয় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটেছিল কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন, বাংলাদেশের একজন নাগরিকের কাছে পুজোর স্মৃতির আরেক নাম সেই সন্ত্রাসের অবহ ট্রমা৷ গত কয়েক বছর ধরেই আমরা এ কথাটি বলতে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, বাংলাদেশে পুজো আসে আসলে প্রতিমা ভাঙার সংবাদ দিয়ে৷
এ কারণেই বাংলাদেশে পুজোর আনন্দ-জোয়ারের সাথে শঙ্কার একটি চোরাস্রোতও থাকে৷ সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ জানেন, যে কোনো মুহূর্তেই বদলে যেতে পারে উৎসবের চালচিত্র৷ গত বছর এ সত্য তো গোটা পৃথিবীই দেখেছে৷ প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে একের পর এক, এর কি কোনো প্রতিকার নেই? আমার সহজ উত্তর হলো- প্রতিকারের সদিচ্ছা থাকলে প্রতিকার অবশ্যই আছে৷ তবে সে প্রতিকার বিধি-নিষেধের ঘেরাটোপের চেয়ে স্বতস্ফূর্তভাবেই হওয়া উচিত৷ জানি, এবারের পুজোমণ্ডপগুলোতে বিগত যে কোনো সময়ের চেয়ে নিরাপত্তা বেশি থাকবে৷ নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যগণ আগে কেবল বড় শহরগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কিছু মণ্ডপেই নিযুক্ত থাকতেন, এবার হয়ত তাঁদের কাজের চৌহদ্দি বাড়বে৷ হয়ত মফস্বলের পুজোমণ্ডপেও এবার নিরাপত্তা আগের চেয়ে জোরদার থাকবে৷ কিন্তু ষষ্ঠী থেকে দশমী- মণ্ডপে মণ্ডপে নিরাপত্তা দিয়েই কি এ গভীর সমস্যাটির সমাধান সম্ভব? নিরাপত্তা অবশ্যই জরুরি- সে তো রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে; কিন্তু আইনের যে শাসন, তার কি কোনো অর্থই নেই? সংশয়টি প্রকাশ করলাম, কারণ, গেলবারের পুজোতে যে নারকীয় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটেছিল, তার বিচারের কোনো অগ্রগতির সংবাদ নেই৷ পুজো চলাকালীন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ধরে যে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তারা কেউই কিন্তু সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলেন না৷ অথচ তাদের ওপর দোষ চাপিয়েই মুরাদনগর থেকে লামায় একের পর এক হামলা চালানো হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে, উপাসনালয়ে; ভাঙচুর করে লণ্ডভণ্ড করা হয়েছে পূজামণ্ডপ৷ কিন্তু এক বছর পেরিয়ে যেতে বসলেও, অপরাধীদের শাস্তির কোনো সংবাদ আমাদের কাছে নেই৷
এ তো গেল এক বছর আগের ঘটনার কথা৷ বাংলাদেশে বিগত সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসগুলো ঘটেছে, তার একটিরও বিচার হয়েছে বলে আমার জানা নেই৷ নাগরিকদের প্রতিবাদ বা নানা মহলের চাপে পড়ে মামলা হলেও, সেগুলোর কোনো অগ্রগতি নেই৷ এই যে আইনের শাসনের প্রতি সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন, সেটাই দেশে সাম্প্রদায়িকতাকে আরো উস্কে দেয়৷ কারণ, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা তো জানে, এসবের কোনো বিচার হয় না৷ ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ঘটে যাওয়া অসংখ্য সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তার প্রমাণ, গত এক দশকে ঘটে যাওয়া রামু, নাসিরনগর, মুরাদনগর, হাজীগঞ্জ, বাঁশখালী তার প্রমাণ৷ এগুলোর কোনো বিচারই হয়নি৷ উল্টো কোনো কোনো ঘটনায় সন্ত্রাসের শিকার ব্যক্তিকেই জেল খাটতে হয়েছে বিনা বিচারে৷ এসব ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যে কোনো উৎসব আনন্দকে ম্লান করে দেয়৷ প্রতি মুহূর্তে তাদের সামনে ভেসে ওঠে পূর্বতন ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি৷ এই যে মানসিক ট্রমা, এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন শিশুরা বা বয়সে যারা নবীন৷ ফলে আপাতদৃষ্টিতে উৎসবের দিনগুলো পেরিয়ে গেলেও ট্রমার দিনগুলো কখনোই পেরুতে চায় না৷
এর সঙ্গে আরো কিছু বিষয়ও সম্পৃক্ত৷ আমাদের সংবিধানে সুস্পষ্ট করে বলা আছে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক৷ কিন্তু রাষ্ট্র যেন প্রতিমুহূর্তেই তার কৃতকর্মের মাধ্যমে আমাদের মনে করিয়ে দিতে চায়, এই নাগরিকদের মধ্যে কেউ কেউ ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু’, কেউ বা ‘জাতিগত সংখ্যালঘু’৷ ফলে অসাংবিধানিক হলেও ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি ঘুরেফিরে আলোচিত হয় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে৷ একজন সনাতন, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীকে, এমনকি একজন শিয়া মুসলমান বা আহমদীয়া জামাতের সদস্যকে তার পরিপার্শ্ব প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় যে, তিনি ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু'; যেমন একজন চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, হাজং বা মুণ্ডা জাতিগোষ্ঠীর সদস্যকে প্রতিদিন শিখতে হয়, তিনি একজন ‘জাতিগত সংখ্যালঘু'৷ এই যে মানসিক পীড়ন, নিজ দেশে নাগরিকের পরিবর্তে একজন ‘সংখ্যালঘু' হিসেবে চিহ্নিত হওয়া- এর চেয়ে বড়অসহায়ত্ব আর কী আছে? তা প্রত্যেকেই হয়ত নিজ নিজ উৎসবে-পার্বনে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের শুভেচ্ছাবার্তা পান; কিন্তু প্রতিদিনের মানসিক যন্ত্রণার কোনো সুরাহা পান না৷ এসব ঘটনারও একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে উৎসব আয়োজনে৷
বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও লেখক শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার একবার একটি লেখা লিখেছিলেন প্রতিদিনের দ্বিজাতিতত্ত্ব শিরোনামে৷ গত বছরের দুর্গোৎসবে যখন সারাদেশ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের নখরে বিদ্ধ হচ্ছে, তখন সে লেখাটি থেকে প্রাণিত হয়েই বাংলাদেশের লেখক ও ব্লগার মারুফ রসূল একই শিরোনামে আরেকটি লেখা লিখেছিলেন নিজের ব্লগসাইটে৷ শুভ দা'র লেখাটি ছিল ভারতে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠীর নিরিখে আর মারুফের লেখাটি ছিল বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরিখে৷ কাগজে-কলমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হলেও, এদেশে সরস্বতী পুজোর সময় ফেলা ভোটের তারিখ আন্দোলন করে পেছাতে হয়৷ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ পড়লে দেখা যায়, কর্তৃপক্ষ জানেনই না সেদিন সনাতন, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কোনো অবশ্য পালনীয় উৎসব আছে৷ কোনো কোনো অফিস-আদালতের ছুটিতেও একই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে কর্তৃপক্ষ৷ মূল কথা হলো, বাংলাদেশে গত দু দশকে সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত বিদ্বেষের জীবাণু কর্কটরোগের মতোই ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মানসিকতায়৷ ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কর্মস্থল, রাস্তাঘাট থেকে নিজ বাসগৃহ সর্বত্রই সনাতন, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন৷ পরিস্থিতি এমন অবস্থায় গেছে যে, একজন শিক্ষক পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছেন না তাঁর শিক্ষার্থীদের হাত থেকে৷ এই যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-জীবাণুর বিস্তার, তা আজ পারিবারিক পর্যায় থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি আইন-আদালত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে৷ এসবের সম্মিলিত প্রভাব পড়ছে প্রতিটি উৎসবে, পার্বণে, আয়োজনে৷
আমি তারপরও মনে করি, একটি গাঢ় অন্ধকার সময় হামাগুড়ি দিয়ে এগুলেও শেষ পর্যন্ত ভোরের সূর্যের কাছেই পৌঁছায়৷ সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস দমনে রাষ্ট্রের নানামাত্রিক গাফিলতি, সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের বিচারের আওতায় আনতে না-পারার রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা বা ইতিহাসচ্যুত ও ঐতিহ্যবিমুখ একটি কূপমণ্ডুক জাতিতে পরিণত হবার সকল সাম্প্রদায়িক আয়োজনের পরও কোথাও না কোথাও সত্যের শঙ্খটি বাজতে থাকে, বেজেই চলে... যা দেবী সর্ব্বভূতেষু শ্রদ্ধারূপেণ সংস্থিতা৷