উৎসাহ যেমন দেখছি, কষ্টও দেখছি: ড. নাজনীন আহমেদ
৬ মে ২০২২ঈদের কেনাকাটায় কতোটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে অর্থনীতি? শ্রমজীবী মানুষ কি স্বাচ্ছন্দে ঈদ উৎযাপন করতে পেরেছেন? অর্থনীতির এসব খুটিনাটি বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকনোমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ৷
ডয়চে ভেলে : করোনা মহামারির পর প্রথম সবাই স্বাভাবিক ঈদ উদযাপন করল৷ কতটা চাঙা হলো অর্থনীতি?
ড. নাজনীন আহমেদ : মহামারিতে আমাদের অর্থনীতির যে ক্ষতিটা হয়েছে, সেখান থেকে আমরা কেবল ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি৷ ঈদ উপলক্ষে যে কেনাকাটা বা সবকিছু সেখান থেকে কোভিড রিকভারি আমরা সেই প্রক্রিয়ায় আছি৷ ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোভিড পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে এবার তাদের অনেক বেশি বেচাকেনা হয়েছে৷ এটা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক৷ আপনারা জানেন অর্থনীতির চাকা যখন ঘোরে তখন মানুষের চাহিদা অনুযায়ী জোগান আসে৷ এভাবেই অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটে৷ বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের এটা এক ধরনের শক্তি৷ অনেক বেশি পপুলেশন কিন্তু আমাদের জন্য শক্তি৷
অর্থনীতির সব সেক্টরে কী এর প্রভাব পড়েছে?
সব সেক্টর বললে বিশাল ব্যাপার হয়ে যায়৷ এখানে কোন সেক্টর সরাসরি জড়িত৷ আবার কোন সেক্টর সরাসরি জড়িত না হলেও এখানে সেখানেও প্রভাব পড়ছে৷ আমরা অর্থনীতির তিনটি সেক্টরের কথা বলতে পারি৷ একটা কৃষি, একটা শিল্প এবং আরেকটা হল সেবা খাত৷ এই উৎসবকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে শিল্প ও সেবা খাতে৷ এখানে হয়ত কৃষিখাতে সরাসরি কোন প্রভাব পড়েনি৷ তারপরও মানুষের অনেক বেশি খাওয়া দাওয়া কারণেও কৃষিতে একটা প্রভাব পড়ে৷ তবে সবচেয়ে বেশি প্রভাব লক্ষ্য করছি, শিল্প এবং সেবা খাতে৷ বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কেনাবেচা অনেক বেশি হয়েছে৷ দেশীয় পোশাক কিন্তু এবার কম দাম থেকে শুরু করে বেশি দামে মানুষ অনেক বেশি কিনেছে৷ আগে কিন্তু বিদেশি জুতার একটা প্রাধান্য ছিল, এবার কিন্তু সবাই দেশি জুতা কিনেছেন৷ সেবা খাতের মধ্যে বিনোদন বা ট্যুরিজম খাতে বড় একটা প্রভাব পড়েছে৷ কোভিডের সময় কিন্তু এটা একদম বন্ধ ছিল৷ জামাকাপড় কিছুটা হলেও অনলাইনে কেনাবেচা হয়েছে৷ কিন্তু ট্যুরিজম একেবারেই বন্ধ ছিল৷ অনলাইনে তো আর বিনোদন হয় না৷ অনলাইনে তো ঘুরতে যাওয়া যায় না৷ এখন প্রশ্ন হল অর্থনীতির সব খাতে প্রভাব যাচ্ছে কি-না? কম বেশি সব খাতেই এর প্রভাব যাচ্ছে৷
গ্রামীণ অর্থনীতি কতটা ঘুরে দাঁড়ালো?
আমাদের এখানে যেহেতু ৮৯ শতাংশ মুসলমান৷ ১৭ কোটি মানুষের দেশে এটা একটা বড় উৎসব৷ ফলে এটা গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গাতেই এর প্রভাব আছে৷ ধনী দরিদ্র কেউ এই প্রভাবের বাইরে না৷ সবারই উৎসব এটা বলা যায়৷ কাজেই এখানে গ্রামকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই৷ গ্রামে যারা বসবাস করেন তারাও কিন্তু কেনাকাটা করছেন৷ ফলে আমি মনে করি, এই উৎসবে গ্রামেও একটা বড় প্রভাব পড়েছে৷ গ্রামীণ অর্থনীতি কিন্তু এখন অনেকটাই শহরের সঙ্গে সংযুক্ত৷ ফলে গ্রাম আর শহর মিলিয়ে পুরো অর্থনীতিতেই এর প্রভাব পড়েছে৷
শ্রমজীবী মানুষের ঈদ কেমন ছিল?
এতক্ষণ আমরা যে উজ্বল অবস্থার কথা বললাম, প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো বিরাজমান যে আয় বৈষম্য যেটা করোনার আগেও ছিল, করোনার পর সেটা আরেকটু বৃদ্ধি পেয়েছে৷ দরিদ্র মানুষ বেশি সমস্যায় পড়েছেন৷ বিশেষ করে নতুন দরিদ্র৷ অতিদরিদ্রদের কাছে সরকারি সাহায্য কোনো না কোনোভাবে পৌঁছায়, কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্তরা সংকটে পড়েছেন৷ একটুখানি ঝড়ঝাপটা হলেই এই মানুষগুলো দারিদ্রের কাতারে চলে যান৷ অনেকই এই করোনায় কর্ম হারিয়েছেন, আবার অনেকে কাজে ফিরেও গেছেন৷ আমি বলব, কোভিডের মধ্যে এই যে কর্মযজ্ঞ সেখানে অনেক মানুষ সংযুক্ত হতে পেরেছে৷ তবে ঈদের কারণে কৃষি শ্রমিকের যে লাভ হয়েছে তা নয়৷ ঈদকে ঘিরে যে লাভ হওয়া সেখানে মূলত সেবা খাত আর শিল্প শ্রমিকদের হয়েছে৷ আমাদের সার্বিক অর্থনীতিতে যে আয় বৈষম্য রয়ে গেছে সেটা কিন্তু আছে৷
বিপুলসংখ্যক মানুষ ঈদে বিদেশে বেড়াতে গেছেন৷ ফলে ঈদে কি দেশের পর্যটন শিল্পটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে?
দেশের বাইরেও যেমন মানুষ গেছেন, দেশের মধ্যেও কিন্তু যেসব ট্যুরিজম স্পট আছে সেখানে মানুষ বেড়াতে গেছেন৷ আপনি যদি কক্সবাজার বলেন, রাঙ্গামাটি বলেন বা বান্দরবান বলেন কোথাও কিন্তু খালি নেই৷ দেশে যে সব পর্যটনকেন্দ্র আছে সেখানেও কিন্তু মানুষ যাচ্ছে৷ দেশে যে সুবিধা নেই বলে মানুষ বিদেশে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়৷ মানুষের গড় মাথাপিছু আয় যেহেতু বেড়েছে সেহেতু তারা খরচ করার জন্য বিদেশে যাবেন সেটাই তো স্বাভাবিক৷ আর্থিক সক্ষমতা থাকার কারণে ধনী দেশের নাগরিকেরা যেমন বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যান, আমাদের এখানেও যাদের সক্ষমতা আছে তারাও কিন্তু বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যান৷ আমাদের দেশে কিন্তু পর্যটনের যে চাহিদা আছে সেটাও কিন্তু আরেকটু বাড়ানো উচিত৷
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তিটা কি বেসরকারি খাত?
আমি মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল শক্তিটা হল একটা শক্তিশালী বেসরকারি খাত৷ সরকারের পলিসি, সমর্থন নেওয়ার মতো যদি একটা বেসরকারি খাত না থাকে তাহলে কিন্তু অগ্রগতিটা সমানতালে বা দ্রুত হয় না৷ বাংলাদেশের জনগণও একটা বড় শক্তি৷ এই শক্তিটা আরও বেগবান হতে পারে যদি তারা দক্ষ হয়৷ যেহেতু বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে তারুণ্যের আধিক্য বেশি, এটা ২০৪০ সাল পর্যন্ত থাকবে৷ এই তরুণদের দক্ষ করা আমাদের দরকার৷ কারণ এই তরুণেরাই আমাদের বড় শক্তি৷
অনেকেই শ্রীলংকার অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করছেন? এটা কেন করছেন?
আমি মনে করি, বাংলাদেশের তুলনা বাংলাদেশের সঙ্গেই কথা উচিত৷ শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত৷ এটা আসলে তুলনা নয়৷ তুলনা বললে মনে হবে, শ্রীলঙ্কা কেমন করছে, আমি কেমন করছি৷ এটা করলে দু'টো ভুল হতে পারে৷ তাদের সঙ্গে তুলনা করে আমরা ভাবতে পারি, আমরা তো অনেক ভালো আছি৷ এটা কিন্তু ঠিক না৷ আমাদের কিছু খাতে সমস্যা আছে, সেখানে কিন্তু চিন্তার ব্যাপার আছে৷ আবার কিছু জায়গায় শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মিলে গেলে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই৷ কোভিডের পর আমরা কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি৷ সেখানে কিন্তু ভুল বার্তা যেতে পারে৷ ফলে এখানে তুলনা করে ভালো আছি, এটাও যেমন খারাপ, আবার সব গেল গেল এটাও খারাপ৷
এবারের ঈদটা আপনি কিভাবে উদযাপন করলেন?
আমার কাছে ঈদটা হচ্ছে, অন্য সময় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হয় কম৷ কিন্তু ঈদের সময় কারও সঙ্গে দেখা হয়, কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়৷ আমরা নিজেরা বড় হতে হতে এখন আমাদের থেকে বড়দের সংখ্যা কমে যাচ্ছে৷ অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন৷ এই সময়টাতে আমি পরিবার এবং বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগটা করি, এবারও সেটাই করেছি৷
আপনার আশপাশের মানুষের ঈদ কেমন ছিল?
আমার আশপাশে যারা স্বচ্ছল আছেন তারা তো মহা আনন্দে ঈদ উৎযাপন করছেন৷ আমার আশপাশের মধ্যে যদি এটা রাখেন, যে আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধব বা পরিচিতজন৷ সেখানে আমি উৎসাহ যেমন দেখছি, কষ্টও দেখছি৷ আমাদের যেহেতু জাকাত দেওয়ার একটা বিধান আছে, সেখানে আমি দেখেছি, যারা কোনভাবে চাকরি করে চলছিলেন, তাদের অনেকে আবার চাকরি ফিরে পেয়েছেন৷ কিন্তু অনেক কম বেতনে তারা চাকরি করছেন৷ তারা হাত পাততে পারছেন না কিন্তু সাহায্য তাদের নিতে হচ্ছে৷ ফলে আনন্দ উৎসাহের পাশাপাশি অনেকেই কষ্ট করে চলতে হচ্ছে৷