কৃষকদের জন্য আলাদা প্রণোদনাকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও কৃষি খাত বিশেষজ্ঞরা৷ তবে ঋণ সুদমুক্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন কেউ কেউ৷ পাশাপাশি দরকার সরবরাহ ব্যবস্থা ও কৃষি উপকরণের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা৷
বিজ্ঞাপন
শনিবার প্রধানমন্ত্রী কৃষি খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ তহবিল গঠনের কথা জানিয়েছেন৷ তার বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক এই স্কিমটি গঠন করবে৷ সেখান থেকে মৎস্য চাষ, পোলট্রি, ডেইরিসহ কৃষি উৎপাদনের জন্য ঋণ নেয়া যাবে৷ এই সুবিধা পাবেন শুধু ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিরা৷
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শিল্প খাতের জন্য ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার একটি প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন৷ সব মিলিয়ে করোনাকালীন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের ঘোষিত তহবিলের আকার দাঁড়ালো ৭৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকায়৷
তবে কৃষি খাতের জন্য সবশেষ ঘোষিত তহবিলের যোগানটি কোথা থেকে, কিভাবে আসবে তা পরিস্কার নয়৷ এ বিষয়ে এখনও কোন নির্দেশনা পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকও৷
সাধারণত প্রতি বছর কৃষি খাতে আলাদাভাবে ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ ২০১৯-২০ অর্থবছরে যা ছিল ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকা৷ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত তহবিলের যোগান এর বাইরে কিনা তাও স্পষ্ট নয়৷ এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম রোববার সন্ধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সাধারণ এসব বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে আমাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়৷ তখন সেই নির্দেশনার আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দিষ্ট পলিসি অনুযায়ী তা পরিপালনের ব্যবস্থা করে৷ এই বিষয়ে এখন চিঠি দেয়া হলে আমরা পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করব৷’’
বাংলাদেশের কৃষির হালহকিকত
বাংলাদেশে কৃষির সার্বিক চিত্র পাওয়া যায় সরকারের কৃষিশুমারিতে৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি কৃষিশুমারি ২০১৯ জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে৷ তাতে উঠে এসেছে কৃষি সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য৷
ছবি: AFP/Getty Images/R. Gacad
জমি নেই ১১.৩৪ ভাগের
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মোট তিন কোটি ৫৫ লাখ ৩০ হাজার খানার উপর জরিপটি পরিচালনা করেছে ৷ এর মধ্যে কোন ধরনের জমি নেই এমন ভূমিহীনের সংখ্যা ৪০ লাখ ৩০ হাজার খানা৷ শতকরা হিসেবে যা ১১ দশমিক ৩৪ ভাগ৷
ছবি: dpa - Report
ভূমিহীন বেশি শহরে
শহরের খানাগুলোর মধ্যে ১৭ লাখ বা ২৮ দশমিক ৭৯ শতাংশেরই কোন জমি নেই৷ অন্যদিকে গ্রামের মোট খানার ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভূমিহীন৷
ছবি: Sophie Tarr
অধিকাংশ নির্ভরশীল গ্রামে
স্বভাবতই দেশে কৃষির উপর নির্ভরশীল বেশিরভাগ মানুষেরই বসবাস গ্রামে৷ জরিপ অনুযায়ী গ্রামে খানার সংখ্যা ২ কোটি ৯৬ লাখ যা ৮৩ দশমিক ৩৭ ভাগ৷ আর বাকি ৫৯ লাখ বা ১৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ রয়েছে শহরাঞ্চলে৷
ছবি: DW/M. M. Rahman
কৃষিভিত্তিক জীবিকা
দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ ভাগই কৃষিতে নিয়োজিত৷ তবে যাদের আয়ের প্রধান উৎস কৃষি এমন শ্রমভিত্তিক খানা আছে ২৬ শতাংশ৷ বিভাগের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি কৃষি শ্রমিক খানা পাওয়া গেছে রংপুরে, ৪২ ভাগ৷ মৎস্যজীবী খানার পরিমান ৯৯ লাখ ৬০ হাজার৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/A. K. Ronnie
বেড়েছে গরু
দেশে এখন গরুর পরিমান দুই কোটি ৮৪ লাখ ৮৭ হাজার ৪১৫ টি৷ ২০০৮ সালে ছিল দুই কোটি ৫৬ লাখ ৭৮ হাজার ৩০৮ টি৷ ১০ বছরে গরুর সংখ্যা বেড়েছে ২৮ লাখ নয় হাজার ১০৭ টি৷
ছবি: DW
বেড়েছে ছাগলও
বাংলাদেশে বর্তমানে এক কোটি ৯২ লাখ ৫৭ হাজার ৪১৩ টি ছাগল রয়েছে৷ ২০০৮ সালে ছিল প্রায় ১ কোটি ৬৪ লাখ৷ ১০ বছরে ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে ২৯ লাখ৷
ছবি: picture-alliance/N. Carson
হাঁস-মুরগি
জরিপ চলাকালে বাংলাদেশে ১৮ কোটি ৯২ লাখ ৬২ হাজার ৯০১ টি মুরগি ছিল৷ হাঁস আছে ছয় কোটি ৭৫ লাখ ২৯ হাজার ২১০ টি৷ এর বাইরে ১৪ লাখ ৪৫ হাজার ৪২০ টি টার্কি আছে৷
ছবি: Getty Images
7 ছবি1 | 7
নামমাত্র বা বিনা সুদে দেয়া উচিত
কৃষি খাতের এই প্রণোদনাকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা৷ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ-বিআইডিএস এর সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী সাহাবুদ্দিন বলেন, অন্যান্য খাতের তুলনায় কৃষির জন্য প্রণোদনার আকার ছোট৷ তারপরও তা কৃষকদেরকে উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে উৎসাহিত করবে৷
বর্তমানে কৃষি খাতে ঋণের সুদ হার প্রতিষ্ঠান ভেদে নয় থেকে ২০ ভাগ পর্যন্ত৷ নতুন ঘোষিত তহবিলে এর হার পাঁচ ভাগ৷ তবে ড. সাহাবুদ্দিন মনে করেন সংকটকালীন এই সময়ে নামমাত্র বা বিনা সুদে কৃষকদের ঋণ দেয়া উচিত ছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘সবচেয়ে ভাল হতো এই টাকা অনুদান হিসেবে প্রদান করলে, তা না হলেও শূন্য সুদে দেয়া যেত৷ অর্থাৎ, কৃষক ৫০০ টাকা নিয়ে সমপরিমান টাকা ফেরত দিবেন৷’’
তাঁর সঙ্গে অনেকটা একমত বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং- সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রথমত টাকাটা যাতে কৃষকের কাছে পৌঁছায় তা নিশ্চিত করতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, সুদের ব্যাপারটিও সরকার ভেবে দেখতে পারে৷ আমার ধারণা এই সুদ পরে সরকার মওকুফ করে দিতে পারে৷’’
তাঁর মতে, সামনে এমন পরিস্থিতি আসতে পারে যার জন্য সরকারের নিজ থেকেই এমন উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন হতে পারে৷
শুধু ঋণ যথেষ্ট নয়
ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, কৃষকদের জন্য শুধু ঋণ দেয়াই যথেষ্ট নয়৷ ‘‘আরো কিছু উদ্যোগ নিতে হবে৷ কৃষি উপকরণের অভ্যন্তরীন বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে৷ সেক্ষেত্রে শুধু ঋণ দিয়ে সংকট সমাধান করা যাবে না৷ এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে কৃষি উপকরণের সরবরাহ ব্যবস্থাটা সচল রাখার উদ্যোগ নিতে হবে৷ কৃষকরা দেখা যাবে টাকা পাবে, কিন্তু সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে না৷ যেহেতু ফসল নির্দিষ্ট সময়ের উপর নির্ভরশীল তাই ভেঙ্গে পড়া সরবরাহ ব্যবস্থাকে দ্রুত স্বাভাবিক করতে হবে,’’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ৷
বোরো ফসল তোলার জন্য শ্রমিকদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়তের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শও দেন তিনি৷
আসছে মৌসুমে সরকার সাড়ে ১১ লাখ টন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷ এক্ষেত্রে সরকারকে আগের চেয়েও সতর্ক থাকতে বলেন ড. সাহাবুদ্দিন৷ তার মতে, ‘‘উৎপাদন খরচ না বাড়ায় ধান চাল সংগ্রহ অভিযানের জন্য বেধে দেয়া দামে কৃষকের লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে৷ তবে এজন্য কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি চাল কেনার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে৷ মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা যেন কৃষকের সুবিধা না ভোগ করে৷’’
কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা
জার্মানি ও উত্তর ইউরোপের বেশ কিছু স্থানে কৃষকরা গত কয়েক মাসে প্রচণ্ড গরম ও শুষ্ক আবহাওয়া মোকাবেলায় হিমসিম খেয়েছে৷ কেউ কেউ মনে করছেন, গরমে এমন আবহাওয়া এখন প্রায়ই থাকবে, তাই প্রয়োজন অভিযোজন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Skolimowska
কমেছে জলীয় উপাদান
বার্লিনের উত্তরে গাড়িতে ৯০ মিনিট গেলে হান্স-হাইনরিশ গ্র্যুনহাগেনের আবাদী জমি৷ তিনি দেখলেন যে, তাঁর ফসল বেড়ে উঠতে এবার বেশি সময় লাগছে৷ কয়েক বছর আগেও যেখানে অক্টোবরের শুরুর দিকেই তিনি আলু তুলতেন, এখন তার চেয়ে বেশি সময় লাগছে৷ তাঁর মতে, এর কারণ শীতের কুয়াশা পড়তে দেরি হওয়া৷
ছবি: DW/T. Walker
এক বস্তা আলু
গ্র্যুনহাগেন একটি চারা থেকে এ পরিমাণ আলুর ফলন আশা করেন৷ কিন্তু যেহেতু ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বেশি হলে এরা বিবর্ণ হয়ে পড়ে, তাই ভালো আলুর ফলন কঠিন হয়ে পড়ছে৷ সেজন্য প্রচুর পানি খরচ করতে হচ্ছে৷ তারপরও এই গ্রীষ্মে তিনি অর্ধেক ফলন ঘরে তুলছেন৷
ছবি: DW/T. Walker
নানা শস্য
এই কৃষক নানা রকমের শস্য উৎপাদন করেন৷ অনেক শস্যেরই দ্রুত অঙ্কুর বের হয় এবং তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাচ্ছে৷ এতে দেরিতে আসা কুয়াশায় এদের ফলন খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ যেখানে সম্ভব, সূর্যের তাপের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তিনি এখন শস্যের বহুমুখীকরণ করছেন৷
ছবি: DW/T. Walker
কুয়াশার কামড়
আঙ্গুর চাষিরাও বিপাকে পড়েছেন৷ নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের যেসব জায়গায় ওয়াইন তৈরি হয়, সেখানে উজ্জ্বল দিনের আলোর কারণে অঙ্কুর দ্রুত বের হয়৷ কিন্তু রাতে তাপমাত্রা অনেক কমে গেলে এদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে৷ কুয়াশার কামড়ে এদের মৃত্যুও হতে পারে৷
ছবি: DW/T. Walker
আঙুর ঘরে তোলা
লম্বা গ্রীষ্মকাল মানে আঙুর পাকবেও দ্রুত৷ তার মানে, ফল তুলতেও হবে তাড়াতাড়ি৷ এমনকি বেশি উষ্ণ তাপমাত্রায় এদের স্বাদও বদলে যায়৷ অথচ ওয়াইন তৈরি প্রক্রিয়ায় পর্যাপ্ত ঠান্ডা তাপমাত্রা বজায় রাখতে প্রযুক্তির বিশেষ ব্যবহার প্রয়োজন হয়৷ তাই চাষিরা রাতে অথবা খুব ভোরে, তাপমাত্রা বেড়ে যাবার আগে আঙুর তুলে ফেলতে চেষ্টা করেন৷
ছবি: Reuters/R. Orlowski
মৃত্তিকার যত্ন
ভূমির প্রতি বাড়তি যত্ন নিতে জার্মান চাষিরা আহ্বান জানিয়েছেন৷ তাঁদের কথা হলো, যেই ভূমি দেশের খাদ্যের চাহিদা মেটায়, তাকে তুষ্ট রাখতে হলে প্রচুর গাছ ও ঝোঁপ লাগাতে হবে, যেন শুষ্ক বাতাস না আসে৷
ছবি: Sarah Selig
মাটির পুষ্টি
জার্মানির অরগ্যানিক ফুড ইন্ডাস্ট্রি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান ফেলিক্স সু ল্যোভেনস্টাইন বলেছেন, মাটিতে হিউমাস ও অন্য উদ্ভিদ অণু কতটা আছে, তার ওপর এর পুষ্টি নির্ভর করে৷ এসব উপাদান যত বেশি থাকবে, তত মাটির পানি শোষণ ক্ষমতা বাড়বে৷ তখন এটি খরা ও অত্যাধিক বৃষ্টি উভয়কেই মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে৷