ভারতের প্রায় এক লাখ কৃষক রাজধানী নয়াদিল্লিতে সংসদ অভিমুখে যাত্রা করেছেন৷ দ্রব্যমূল্য ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে বিপাকে পড়া এই কৃষকদের দাবি– ঋণ মওকুফ ও ফসলের ন্যায্য দাম নিয়ে সংসদে বিশেষ অধিবেশন বসুক৷
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে যে, দু'দিনব্যাপী এই আন্দোলনে ২০০ সংগঠনের প্রায় এক লাখ কৃষক অংশ নিয়েছেন৷ বৃহস্পতিবার সকালে তাঁরা প্রথমে আনন্দ বিহার রেল স্টেশনে জড়ো হন৷ সেখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিল্লি হয়ে রামলীলা ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন৷
সন্ধ্যায় রামলীলা ময়দানে সভায় যোগ দেন৷ শুক্রবার রামলীলা ময়দান থেকে সরাসরি সংসদভবনের উদ্দেশে রওনা দেন তারা৷
এই নিয়ে গত কয়েকমাসে দিল্লিতে তৃতীয়বার কৃষক আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছেন৷ এর আগেও আন্দোলনের সময় প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন৷ কিন্তু কাঙ্খিত ফল পাননি তাঁরা৷ তাই মোদী সরকারের ওপর যারপরনাই ক্ষুব্ধ কৃষকরা৷
‘‘কৃষকরা প্রায়ই আত্মহত্যা করছেন,’’ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন জয় কিষাণ আন্দোলনের নেতা ইয়োগেন্দ্র ইয়াদব৷ ‘‘খুবই লজ্জার বিষয় যে, যারা আমাদের খাবারের জোগান দিচ্ছেন, তাদের কথা শোনার সময় সরকারের নেই৷’’
সরকারের নানা নীতির কারণে ভারতের গ্রামের মানুষের আয় বাড়েনি৷ তার ওপর কৃষিতে ভর্তুকির বদলে সরকারের বিনিয়োগনীতি গ্রহণের ফলে কৃষকরা আরো বেশি হতাশ হয়ে পড়েছেন৷
দেশটির ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে প্রায় ১৫ ভাগ অবদান কৃষির৷ তার চেয়েও বড় কথা হলো, কৃষির সঙ্গে দেশের ১৩০ কোটি মানুষের অর্ধেকই জড়িত৷
‘‘আমার পরিচিত অনেক কৃষকই আত্মহত্যা করেছেন৷ তাঁদের পরিবারের করুণ দশা,’’ উত্তর প্রদেশ থেকে আসা কৃষক লাখান পাল সিং বলেন রয়টার্সকে৷ ‘‘মোদী সরকারের নীতির কারণেই আজ এই অবস্থা৷’’
সিং বলেন, ‘‘আমরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলাম৷ অথচ এই সরকারের কৃষক-বিরোধী নীতিগুলো আমাদের বিপদে ফেলেছে৷’’
ভারতের ৭০ ভাগ মানুষ থাকেন গ্রামে৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী'র দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দেশটির গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় জয় নিয়ে সরকার গঠন করেছে৷
এই ভোটারদের একটা বড় অংশ কৃষক৷ এদের সংখ্যা প্রায় ২৬ কোটি ৩০ লাখ৷ কৃষকদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ আগামী মে মাসের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের ওপর পড়বে বলে ধারণা করেন অনেকেই৷
জেডএ/এসিবি (রয়টার্স)
গত মার্চের ছবিঘরটি দেখুন...
দাবি আদায়ে রাজপথে কৃষকরা
শেষমেষ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে নামতে হলো ভারতের বেশ কয়েক হাজার কৃষককে৷ ঋণ মওকুফ, পণ্যের ভালো দাম আর জমির অধিকার নিশ্চিতে তাদের রাপজথের আন্দোলন ইতোমধ্যে ফল দিতে শুরু করেছে৷
ছবি: Imago/Hindustan Times/R. Choudhary
লাল পতাকার সমুদ্র
মাথায় লাল টুপি পরে আর হাতে লাল পতাকা নিয়ে নাসিক থেকে সপ্তাহান্তে ১৮০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ে পৌঁছান কয়েক হাজার কৃষক৷ তাঁদের লক্ষ্য ছিল মুম্বইয়ে অবস্থিত মহারাষ্ট্রের সংসদ ঘিরে ফেলা৷ কৃষকদের অধিকাংশই দরিদ্র৷ মার্চের গরমের মধ্যে খালি পায়ে লম্বা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকের পায়ে ফোস্কা পড়ে যায়, অসুস্থও হয়ে পড়েন কেউ কেউ৷
ছবি: REUTERS
সরকারের সহায়তা দাবি
কৃষকদের দাবি, কৃষিকাজে তাঁদের যে খরচ হয়, শষ্য বিক্রি করে যেন তার দেড়গুণ লাভ করা যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে৷ পাশাপাশি, কৃষি ঋণে জর্জরিতদের ঋণ মওকুফের দাবি জানান তাঁরা৷ আন্দোলনকারী কৃষকদের মধ্যে অনেক উপজাতি ছিলেন, যাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে জমিতে চাষ করছেন, অথচ সেই জমির মালিকানা এখনো পাননি৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমাধানের চেষ্টা
মহারাষ্ট্র সরকার অবশ্য কৃষকরা মুম্বই পৌঁছানোর পর তাঁদের দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার ঘোষণা দেয়৷ গতবছর মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ জানিয়েছিলেন যে কৃষকদের ৩০৫ বিলিয়ন ভারতীয় টাকার যে ঋণ রয়েছে, তা মওকুফের চেষ্টা করা হচ্ছে৷ এবার কৃষকদের আন্দোলন বেগে পেলে সব দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দেয় রাজ্য সরকার৷
ছবি: P. Paranjpe/AFP/Getty Images
সংকটে কৃষিখাত
মহারাষ্ট্র হচ্ছে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃষি রাজ্য৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় তীব্র খরা দেখা দেয়৷ ফলে চরম বিপাকে পড়েন কৃষকরা৷ রাজ্যটিতে শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই আত্মহত্যা করেছেন আড়াই হাজারের বেশি কৃষক৷ তবে কৃষকদের সমস্যা শুধু মহারাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ নেই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
অসন্তোষ বাড়ছে
গত কয়েকমাস ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কৃষকরা নানা দাবিতে আন্দোলন করছেন৷ কৃষিখাতের প্রতি সরকারের আরো সহায়তা চান তাঁরা৷ এ সব আন্দোলনে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষক এবং কৃষিখাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত দিনমজুরদের অংশগ্রহণ বেশি দেখা গেছে৷
ছবি: AP
কম আয়
অনেক কৃষকই ঋণে জর্জরিত৷ একদিনে ঋণের কিস্তি শোধের চাপ, অন্যদিকে ফসলের ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার কারণে তাঁদের অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে৷ মধ্যসত্ত্বভোগীরা অনেক সময় কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কৃষকদের শষ্য বিক্রি করতে বাধ্য করে৷ মোটের উপর, প্রকৃতির বৈরি আচরণও ভোগাচ্ছে কৃষকদের৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
দ্রুত সমাধান?
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কৃষকদের ঋণ মওকুফ করা হলে তা তাঁদের অসন্তোষ কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে শষ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত নানা পর্যায়ে কৃষকদের ঠকানোর যে চর্চা রয়েছে, তা বন্ধে আরো উদ্যোগের প্রয়োজন৷ তাই কৃষকরা যাতে তাঁদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য পান, তা নিশ্চিতে সরকারকে আরো সক্রিয় হতে হবে৷
ছবি: Imago/Hindustan Times/R. Choudhary
বড় চ্যালেঞ্জ
ভারতের কৃষকদের মধ্যে এই অসন্তোষ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বিপাকে ফেলে দিয়েছে, যিনি কিনা ঘোষণা করেছিলেন পাঁচ বছরের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা হবে৷ ক্ষুব্ধ কৃষকদের শান্ত করতে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচির পরিধি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ভবিষ্যতে নির্বাচনের উপরও বড় প্রভাব ফেলতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
কৃষির উপর নির্ভরতা
ভারতের এক দশমিক তিন বিলিয়ন নাগরিকের দুই-তৃতীয়াংশই জীবিকার জন্য কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল, যদিও দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষিখাতের অবদান ১৪ শতাংশ৷ গত দুই দশকে দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মানুষ শহরে চলে আসলেও এখনো গ্রামাঞ্চলে রয়ে গেছেন অর্ধেক জনগোষ্ঠী৷