ঋতুপর্ণাদের এশিয়ান কাপের জন্য বাফুফের যত পরিকল্পনা
১৫ জুলাই ২০২৫
এএফসি এশিয়ান কাপের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ঢুকলে চোখে পড়বে ঋতুপর্ণা চাকমার ছবি৷ অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপানের তারকা ফুটবলারদের পাশে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের এই ফরোয়ার্ড৷
নারী এশিয়ান কাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বের টিকিট বিক্রি শুরু ১৮ জুলাই৷ যে বিজ্ঞাপনে এএফসি রেখেছে ঋতুপর্ণাকে৷
বিজ্ঞাপনটিকে চাইলে প্রতীকী হিসেবে দেখাই যায়৷ বাছাই পর্বে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিয়ে এশিয়ান কাপের চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ৷ এশিয়ার শক্তিশালী দলগুলোর সঙ্গে তাই সমানভাবে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম৷
আগামী বছর ১-২১ মার্চ অস্ট্রেলিয়াতে বসবে নারী এশিয়ান কাপের আসর৷ যেখানে স্বাগতিক হিসেবে সরাসরি খেলবে অস্ট্রেলিয়া৷ আরও খেলবে গত আসরের চ্যাম্পিয়ন চীন৷ যারা এশিয়ান কাপে নবমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়েছে৷ রানার্স আপ দক্ষিণ কোরিয়া ও তৃতীয় জাপানও সরাসরি খেলবে৷
এশিয়ান কাপের ১২ দলের মধ্যে বাকি ৮টি দল বাছাইপর্ব পেরিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে৷ বাংলাদেশ ‘সি' গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলবে অস্ট্রেলিয়ায়৷ বাছাই পর্বে বাংলাদেশ হারিয়েছে বাহরাইন, মিয়ানমার ও তুর্কমেনিস্তানকে৷ এই জয়গুলোর মাহাত্ম্য শুধু একটি বাক্যে লিখে শেষ করা যাবে না৷ কারণ বাংলাদেশ (১২৮) র্যাঙ্কিংয়ে বাহরাইনের চেয়ে (৯২) ৩৬ ধাপ পিছিয়ে পড়া দল এবং মাঠের লড়াইয়ে সেই বাহরাইনকে হারিয়ে দিয়েছে ৭-০ গোলের বিশাল ব্যবধানে৷ এরপর বাংলাদেশ হারিয়েছে গ্রুপের টপ ফেবারিট স্বাগতিক মিয়ানমারকে, যাদের র্যাঙ্কিং ৫৫৷ গ্রুপের কঠিন প্রতিপক্ষ মিয়ানমারকে ২-১ গোলে হারানোয় বড় অবদান রাখেন ঋতুপর্ণা চাকমা৷ দুর্দান্ত দুটি গোল করে সবাইকে মুগ্ধ করেন তিনি৷ গ্রুপের সবচেয়ে দুর্বল দল তুর্কমেনিস্তানকে (১৪১) অনুমিতভাবেই হারায় (৮-০) বাংলাদেশ৷
এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় দু দুবার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছে বাংলাদেশের মেয়েরা৷ টানা দুবারের সাফজয়ী নারীদের দক্ষিণ এশিয়াতে আদৌ প্রমাণের কিছু ছিল? সাফ চ্যাম্পিয়ন দলটিকে এশিয়ার মঞ্চে খেলার সুযোগ সেভাবে দিত না বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)৷ অথচ সেই মেয়েরাই নিজেদের যোগ্যতায় খেলবে এশিয়ার সর্বোচ্চ প্লাটফর্মে৷
বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন
প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মারিয়া মান্দা, আফঈদা খন্দকারদের৷ এবার তারা স্বপ্ন দেখছেন বিশ্বকাপে খেলার৷
বাংলাদেশ ছাড়াও প্রতিবেশী ভারত, চাইনিজ তাইপে, ভিয়েতনাম, উজবেকিস্তান, ফিলিপাইন্স ও উত্তর কোরিয়া এরই মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার টিকিট পেয়েছে৷ শুধু ‘এ' গ্রুপের বাছাই পর্বের কিছু ম্যাচ এখনও বাকি৷ ১৯ জুলাইয়ের পর পাওয়া যাবে এশিয়ান কাপের ১২তম দলটি৷
এই ১২ দল নিয়ে ২৯ জুলাই হবে চূড়ান্ত পর্বের ড্র৷ এরপরই জানা যাবে বাংলাদেশ খেলবে কোন গ্রুপে৷ প্রতিপক্ষ হিসেবেই বা কোন কোন দেশ পাবে৷
২০২৭ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ থাকছে বাংলাদেশের৷ অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় এশিয়া কাপের সেরা ৬ দলের মধ্যে থাকলেই বাংলাদেশ খেলতে পারবে বিশ্বকাপে৷ তবে পরের দুই দলের মধ্যে থাকলেও সুযোগ রয়েছে৷ সে ক্ষেত্রে আন্তঃমহাদেশীয় প্লে-অফে অংশ নিতে হবে৷ আর এশিয়ান কাপের সেরা আটে থাকলে ২০২৮ সালের লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিকেও খেলার সুযোগ পেতে পারে বাংলাদেশের মেয়েরা৷ ভারত, ভিয়েতনামের মতো দলগুলো চূড়ান্ত পর্বে ওঠায় বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে৷
এশিয়ার কাপের প্রস্তুতি
বাফুফে এরই মধ্যে নারী ফুটবলারদের এশিয়ান কাপের প্রস্তুতির কার্যক্রম শুরু করেছে৷ জাতীয় দলের ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার তো ঋতুপর্ণাদের জন্য বৈশ্বিক ‘এক্সপোজার', চেয়েছেন৷ শুধু টুর্নামেন্ট জেতা বা কোয়ালিফাই করা নয়, বিশ্বমঞ্চে খেলার জন্য ও বিশ্বমানের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজন নিয়মিত প্রীতি ম্যাচে খেলার সুযোগ, অভিজ্ঞতা ও প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হওয়া৷ সেটাই দরকার এই মেয়েদের৷ তবে এর পাশাপাশি ফুটবলারদের ফিটনেস, ডিসিপ্লিন ও মানসিক দৃঢ়তা তৈরিতেও নজর দিয়েছেন তিনি৷
এশিয়ান কাপের মতো বড় মঞ্চে খেলতে মুখিয়ে রয়েছেনসাফের সেরা ফুটবলার ঋতুপর্ণা৷ মার্চের আগে যত বেশি সম্ভব ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে চান রাঙামাটির এই ফুটবলার৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি এখন জাতীয় দলের ক্যাম্পে নেই৷ ভুটানে নারী লিগ খেলছি৷ কিন্তু নিজের যা যা করার দরকার যেমন কঠোর অনুশীলন সেগুলো করে যাবো৷ পাশাপাশি এশিয়ান কাপে যাওয়ার আগে আমাদের অবশ্যই বড় দলের বিপক্ষে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলার দরকার৷ তাহলে আমরা বুঝতে পারবো আমাদের দুর্বলতা ও শক্তি কোথায়৷ দেশের বাইরে গিয়েও ট্রেনিং করা দরকার আমাদের৷''
প্রয়োজন আরও সুযোগ-সুবিধার
বর্তমান নারী দলের বড় সমস্যা আবাসন৷ বাফুফের মতো ব্যস্ত দাপ্তরিক ভবনের চতুর্থ তলার ১১টি কক্ষে প্রায় ৭০ নারী ফুটবলার থাকেন৷ অথচ এই ভবনে নেই লিফট৷ দৈনিক একাধিকবার ট্রেনিং, জিম সেরে সেই ভবনের সিঁড়ি বেয়ে ক্লান্ত মেয়েদের পৌঁছাতে হয় কক্ষে৷ একেকটি কক্ষে ছয় থেকে আটজনকে থাকতে হয় গাদাগাদি করে৷
কিন্তু যে মেয়েরা বাংলাদেশকে এত বড় সাফল্য এনে দিচ্ছেন তাদের জন্য আরও ভালো সুযোগ সুবিধা প্রয়োজন বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার রেহানা পারভীন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ফুটবলাররা যেখানে থাকে ওটার পরিবর্তন করা দরকার৷ ওদের আবাসন ব্যবস্থা আরও উন্নত করা উচিত৷''
শক্তিশালী দলের বিপক্ষে লড়তে হলে যা প্রয়োজন
অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে৷ বর্তমানে জাপান ৭ম, অস্ট্রেলিয়া ১৫তম ও চীনের র্যাঙ্কিং ১৭তম৷ চূড়ান্ত গ্রুপিংয়ের পর এদের যে কোনও একটা দলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেতে পারে বাংলাদেশ৷ এমন শক্তিশালী দলের বিপক্ষে খেলতে হলে অন্তত নারী ফুটবল লিগটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করা প্রয়োজন৷ অথচ বাংলাদেশে নামকা ওয়াস্তে একটা নারী লিগের আয়োজন করে বাফুফে৷ যেখানে আবাহনী, মোহামেডানের মতো বড়ো কোনও দল অংশ নেয় না৷ লিগটাও দ্রুত শেষ হয়৷ তাইতো একট পেশাদার নারী লিগ চালুর আহ্বান জানালেন রেহানা৷ বললেন, ‘‘এই লিগ নিয়ে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি৷ বাদল দা যেমন মোহামেডানের, আসলাম ভাই যেমন আবাহনীর ছিলেন সেভাবেও নারী ফুটবলারদেরও একটা ঠিকানা হোক৷ ক্লাবগুলো যেন এগিয়ে আসে নারী লিগের ব্যাপারে৷ আবাহনী, বসুন্ধরার মতো ক্লাবগুলো যেন মেয়েদেরকে দলে নিতে কাড়াকাড়ি করে৷ তাহলেই একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লিগ হবে৷ সেই লিগের প্রভাব পড়বে মাঠের খেলাতেও৷''
সাধারণত এশিয়ান কাপ বা বিশ্বকাপের বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পুরুষ দলের ক্যাম্প শুরু হয় প্রতিযোগিতা শুরুর কিছুদিন আগে৷ কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে এমনটা দেখতে চান না জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম৷ মনিকা চাকমা, মারিয়া মান্দাদের জন্য বিশ্বমানের সুযোগ সুবিধা দাবি করলেন এই মিডফিল্ডার৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ট্রেনিং বা অন্য সুযোগ সুবিধা হতে হবে বিশ্বকাপ মানের৷ কারণ আমরা যাদের বিপক্ষে খেলবো, সুযোগ সুবিধার স্ট্যান্ডার্ডও তেমনই হতে হবে৷ ঠিক এক মাস আগে ক্যাম্প শুরু করলে হবে না৷ এমনকি ট্রেনিং সেশনও দেশের বাইরে করাতে হবে৷ কারণ এশিয়ান মানের ফ্যাসালিটিজ বাফুফের নেই৷ তাছাড়া ইউরোপের অনেক দল আছে যারা নারী ইউরোতে ভালো করে৷ ওদের সঙ্গে ম্যাচ খেলানোর আয়োজন করতে হবে৷''
প্রায় দেড় যুগ আগে যখন বাংলাদেশের মেয়েরা হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে চলেছে তখন বাফুফের মহিলা কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন মাহফুজা আক্তার৷ যিনি বর্তমানে বাফুফের মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান৷
নারী ফুটবলাররা এশিয়ান কাপে খেলা নিশ্চিত করেছে, এটা যেন স্বপ্নের মতো মনে হয় মাহফুজার কাছে৷ ঘোরলাগা বিস্ময়ে তিনি বলেন, ‘‘২০০৮ সালে যখন আমি কাজ শুরু করি তখনও ভাবিনি বাংলাদেশের মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি এশিয়ান কাপে খেলতে পারবে৷ কিন্তু আমি সব সময় বলে এসেছি যখন যেখানে কাজ করি একটা লক্ষ্য নিয়ে কাজ করি৷ সেই লক্ষ্যটা এতদিন পূর্ণতা পেয়েছে৷ আমার স্বপ্ন পূরণে সব চেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন বাফুফের সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন৷ তখন তিনি বলেছিলেন কিরণ (মাহফুজা আক্তার) শুরু করো৷ একটা কিছু হবেই৷ উনি তো কোনও কিছুতে না করতেন না৷''
দক্ষিণ এশিয়ায় দুবার চ্যাম্পিয়ন হলেওএশিয়ান পর্যায়ে লড়াইয়ের মতো সামর্থ্য বাংলাদেশের হয়নি৷ সেই বাস্তবতা মানছেন মাহফুজা৷ বললেন, ‘‘আমরা এই লেভেলে ভালো করছি৷ কিন্তু ওই লেভেলে যাওয়ার মতো সময় হয়নি৷ তারপরও আমাদের সামনে একটা সুযোগ এসেছে যেটা অবশ্যই আমরা সদ্ব্যবহার করব৷ শতভাগ নয় আমরা ১২০ ভাগ দিয়ে লড়ব৷''
এশিয়ান কাপে যাতে শক্তিশালী দলগুলোর সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে পারে বাংলাদেশ সেই পরিকল্পনা এরই মধ্যে নিয়েছে বাফুফে৷ মাহফুজা জানান ইউরোপে গিয়ে অনুশীলন করবেন মনিকা, ঋতুপর্ণারা৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন আমাদের এশিয়ান কাপ ঘিরে যে পরিকল্পনা সেটা নিয়ে আমি তাবিথ আউয়ালের (বাফুফে সভাপতি) সঙ্গে বসেছিলাম৷ তাবিথ বলেছেন আমরা এবার চেষ্টা করব ইউরোপে ওদের ট্রেনিং করানোর, ম্যাচ খেলানোর৷''
যদিও ফিফা উইন্ডোতে খুব বেশি ম্যাচ পাওয়া যাবে না বলে জানালেন তিনি৷ তারপরও কঠিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে ম্যাচ আয়োজন করবেন৷
বাফুফে ভবনে মেয়েদের আর গাদাগাদি করে থাকতে হবে না এমন আশ্বাসও দিলেন তিনি৷ বললেন, ‘‘আমাদের পরিকল্পনা আছে বিকেএসপি বা অন্য কোনও জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে৷ এক্সক্লুসিভভাবে ওদের রেখে দেব৷ যেখানে ওরা শুধু ট্রেনিংয়ের মধ্যেই থাকবে৷''
মাহফুজা ফিফার সাবেক কাউন্সিলর৷ ওই সময়ে বিভিন্ন ভেন্যুতে এশিয়ান কাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হতো তাকে৷ তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের মেয়েরা এশিয়ান কাপে খেলবেন৷ সর্বশেষ ২০২২ এশিয়ান কাপ হয়েছিল ভারতের মাটিতে৷ সেখানেও নারী এশিয়ান কাপের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি৷ ওই স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘‘আমি যখন ফিফা কাউন্সিলর ছিলাম তখন এএফসির নারী কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলাম৷ তখন অন্য দলগুলো দেখে স্বপ্ন দেখতাম কবে আমাদের দলও এখানে খেলবে৷ আমার আনন্দ তখন অনেক বেড়ে যাবে৷ সর্বশেষ মুম্বাইয়ে আয়োজনের সময়ও মনে হতো আমার মেয়েরা কবে এখানে খেলবে৷ আজ যদি আমার টিম এখানে থাকত সবচেয়ে বেশি গর্ববোধ করতাম৷ সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম৷''