আজ ভারতে এবং ভারতের বাইরেও, সারা সঙ্গীত বিশ্ব তোলপাড় হয়ে গেছে ‘লাল সেলাম' ছবিতে এ আর রহমানের প্রয়াত একজন শিল্পীর কণ্ঠে গান ব্যবহার নিয়ে৷ যে মানুষ নেই তার কণ্ঠের গান একটি প্রশ্ন তুলেছে৷
বিজ্ঞাপন
যে প্রশ্নটি উঠছে, সেটি মৌলিক৷ প্রথমত, এআই-এর এই চমকপ্রদ ঘটনাটি বাইরে প্রকাশিত হওয়ায় একটা এথিকাল বা নৈতিক প্রশ্ন উঠেছে , প্রশ্ন উঠেছে এভাবে কি এআই কে ব্যবহার করা উচিত না উচিত নয়? তার থেকেও বড় প্রশ্ন যেটা উঠেছে তা হল এআই কি আদৌ পারে? হ্যাঁ, এআই অনেক কিছুই পারে, এই যেমন এআই পারল একজন মৃত মানুষের স্বরকে আবার ফিরিয়ে আনতে৷
শ্রদ্ধেয় এ আর রহমান যখন তৈরি করেছেন তখন ভাবা যেতেই পারে ব্যাপারটি অসাধারণ, অনবদ্য হয়েছে৷ কিন্তু তা পারল কে? না এআই , কিন্তু সেখানে মূল গায়ক তো একজন মানুষই৷ তাকে দিয়ে গাইয়েই তো কণ্ঠটি জোড়া হল,সেই মূল গায়ক কোথায়? আমি তাকে খুঁজছি৷ তিনি কোত্থাও নেই৷ তাহলে, এটি কি সঙ্গীতের ল্যাবরেটরি? যেখানে মানুষের জন্য কিছু তৈরি করবার আগে অজস্র গিনিপিগের ওপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়? সে প্রশ্নও যাক৷
আরো একটা প্রশ্ন তবু থেকে যায় যে, শিল্প কী তবে পেছনে হাঁটা শুরু করবে এবার? আর একটু বুঝিয়ে বলি – গানের পরিসর ধরেই যদি বলি তবে কিশোরকুমার, লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত মুখোপাধায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এনারা যদি আজ স্বমহিমায় থাকতেনও তবে কি আমরা আজও শুধু তাদের গানই শুনতাম? কিশোরকুমারের গলা ব্যবহারের জন্য কি তবে অমিতাভ বচ্চনকেই নিজের যৌবন কালের ‘শোলে' বা ‘অভিমান' এ ফিরে যেতে হবে? নাকি এখনকার ছবিতে তারাই গাইবেন? একটা গান তো শুধু কণ্ঠস্বর নয়৷ একটা গানে একটা সময় জেগে থাকে ,একটি কণ্ঠধারণ করে সময়ের দলিল৷
কারণ গানের কথা, স্বর, সুর, তার যে বিশেষত্ব তা কখোনোই সমসাময়িকতার প্রভাব মুক্ত নয়, হতে পারে না৷ আইসোলেশনে কোন গানের জন্ম হতে পারে না৷ তাকে সেই সময়কে সঙ্গে নিয়েই, তার গল্পকে জড়িয়েই গান হয়ে উঠতে হয়৷ আমরা কতজন আসলে জানি যে কোন পটভূমিতে দাঁড়িয়ে সেই সব শ্রদ্ধেয় প্রয়াত শিল্পীদের কণ্ঠ নিয়ে আসা হয়েছে৷ এ কি শুধুই পরীক্ষা নিরীক্ষা? নাকি জরুরি প্রয়োজনীয়তা সত্যিই ছিল? আমি জানি আজ পৃথিবীর নানা প্রান্তে এরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা হচ্ছে তা সম্ভব, ঠিকই৷
হিন্দি ছবিতে নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, সমালোচনার তোপে এ আর রহমান
কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটিতে নিজের মতো সুরারোপ করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন ভারতীয় সংগীত পরিচালক এ আর রহমান। এ ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পীরা ক্ষুব্ধ। ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Sayles
নজরুলসংগীত শিল্পী সংস্থার প্রতিবাদ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যশোরের গরিবপুরের একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে রাজা কৃষ্ণ মেনন নির্মান করেছেন ‘পিপ্পা’ ছবিটি৷ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি ব্যবহার করা হয়েছে সেই ছবিতে। গত ৭ নভেম্বর জি মিউজিক কোম্পানি এবং এ আর রহমানের ইউটিউব চ্যানেলে এটি প্রকাশিত হয়। সুর ‘বিকৃত’ করায় সংবাদ সম্মেলন করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ নজরুলসংগীত শিল্পী সংস্থা।
ছবি: Johny Hoque/DW
শাহীন সামাদ, নজরুলসংগীত শিল্পী
গানটা শুনে আমি ভাবছিলাম- এটা কি নজরুলসংগীত? এটা কি আমাদের ‘কারার ঐ লৌহ কবাট’? এরকম একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা কেন ঘটালেন এ আর রহমান? যদি মূল সুরটা রাখতেন তিনি, তাহলে তো কোনো আপত্তি ছিল না। সরকারিভাবে এ ঘটনার নিষ্পত্তি হওয়া দরকার।
ছবি: Johny Hoque/DW
সুজিত মোস্তফা, নজরুলসংগীত শিল্পী
‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ আমাদের চেতনায় দোলা দেয়। এতে অন্য সুর কোনোভাবে সমর্থন করা যায় না। বাঙালি কণ্ঠশিল্পীরাও গেয়ে খালাস হয়ে গেলেন, এই বিষয়টা মেনে নিতে পারছি না। তবে চাইলেই এটি সংশোধন করা যায়। এ আর রহমান মূল গানে নতুন সংগীতায়োজন করলে চমৎকার কাজ হবে। এতে তার ভুল লাঘব হবে, আমরাও খুশি হবো।
ছবি: Johny Hoque/DW
ফাহমিদা নবী, সংগীতশিল্পী
এ আর রহমান কালজয়ী, অমর গানটি সঠিক সুরে নতুন সংগীতায়োজন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিকৃত করেছেন। আমরা খুবই লজ্জিত বোধ করছি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি এই অসম্মানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। অবিলম্বে গানটি ‘পিপ্পা’ চলচ্চিত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে নিষিদ্ধ করা হোক।
ছবি: privat
কনকচাঁপা, কণ্ঠশিল্পী
‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানের রক্ত গরম করা আবেদন হাজার বছর পরেও একই থাকবে। এ আর রহমানের কাজটি খুবই নিম্নমানের ও অনৈতিক। এত ভাবনাহীন কাজ তার সঙ্গে যায় না। আশা করি, অচিরেই গানটি সিনেমা থেকে বাদ দেওয়া হবে এবং এ আর রহমান নিজের কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন।
ছবি: privat
শাফিন আহমেদ, সংগীতশিল্পী
স্কুল থেকেই এই অনুপ্রেরণা জোগানো গান শিখে বেড়ে উঠেছি। কিন্তু এ আর রহমানের সংস্করণটি আমাদের চেনা নজরুলের সেই গান নয়। এমন কাজ করা উচিত হয়নি তার। জি মিউজিক কোম্পানি ও এ আর রহমান এই বিকৃতির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী। কাজী নজরুল ইসলাম তাদের জন্য গানটি লেখেননি। অবিলম্বে এটি সরিয়ে নেওয়া উচিত।
ছবি: privat
ইয়াসমিন মোশতারি, নজরুলসংগীত শিল্পী
কোথায় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, কোথায় এ আর রহমানের নতুন গানটি! সত্যি বলতে এটি এতই অখাদ্য হয়েছে যে, এ আর রহমানের সুর মনেই হয় না। এ আর রহমান তো জাদুর মতো সুর করেন। সেই তিনি কিনা এভাবে ব্যর্থ হয়ে গেলেন? তিনি খুব ঘৃণ্য কাজ করেছেন৷ এটা তাকে জানানো প্রয়োজন। সিনেমায় গানটি বদলে নজরুলীয় স্বাদের মতো নতুনভাবে বসানো হোক। একমাত্র এই কাজ করলেই আমরা ভাববো সংশ্লিষ্টরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
ছবি: Johny Hoque/DW
প্রিন্স মাহমুদ, সুরকার ও সংগীত পরিচালক
এ আর রহমানকে ইলাইয়ারাজার কোনো গানের কথা অপরিবর্তিত রেখে নতুন সুর করতে বলা হলে তিনি করবেন? কেউ যদি এ আর রহমানেরই একটা গানের কথা অপরিবর্তিত রেখে নতুন সুর করে সিনেমায় ব্যবহার করতে চান, তিনি কি অনুমোদন দেবেন? নজরুলের গগন কাঁপানো ‘কারার ঐ লৌহ কবাট’ নিজেই মহাশক্তি। এই সুর প্রতিটি বাঙালির রক্তে, শিরায়-উপশিরায়, মজ্জায়।
ছবি: Imtiaz Alam Beg
আসিফ আকবর, কণ্ঠশিল্পী
এ আর রহমান কোন মন্ত্রণায় নতুনভাবে সুরে ফেলেছেন সেটি বোধগম্য নয়। একইসঙ্গে বাংলা উচ্চারণ মিটারে ফেলতে গিয়ে পুরো কাজটা গুবলেট করে ফেলেছেন। কাজটি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। গানটির নানাবিধ বিকৃতি এ আর রহমানের দীর্ঘ ক্যারিয়ারকে সমালোচিত করেছে। আমরা যারা কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ধারণ করি, তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ চলছে। বিকৃত গানটি দ্রুত প্রত্যাহারের সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।
ছবি: Omar Farukh Titu
নূপুর কাজী, কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি এবং সংগীতশিল্পী
যে গান আমাদের দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িয়ে, যা শুনলে মহান বিপ্লবীদের প্রতি মাথা নত হয়ে আসে, রক্তে শিহরণ জাগে; সেটি নষ্ট করার অধিকার কারোর নেই। কাজী নজরুল ইসলামের এ গানের আত্মাকে ধ্বংস করা হয়েছে। এ আর রহমানের মতো শিল্পীর কাছ থেকে এটা আশা করিনি। তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
ছবি: privat
মিষ্টি কাজী, কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি
পিপ্পা’র গানটি নিয়ে আমার বড় বোন খিলখিল কাজীর সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা বুঝতে পারছি না এ আর রহমান কার অনুমতি নিয়ে কীভাবে নতুন সুর করলেন? আমার চাচি কল্যাণী কাজী গানটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন শুনেছি, কিন্তু সুর ঠিক রাখার শর্তে অনুমতি দেওয়ার কথা। এ আর রহমান সম্মানিত একজন মানুষ, তার তো এমন বাজে কাজ করার কথা নয়। আমার দাদুর অমর গানটি বিকৃত করায় তীব্র নিন্দা জানাই।
ছবি: Johny Hoque/DW
মাহমুদুল হক বাবু, নজরুল গবেষক
গিরীন চক্রবর্তীর মেয়ে ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। গিরীন চক্রবর্তী ছিলেন নজরুলের সান্নিধ্য-ধন্য সুহৃদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ তিনি। পরে কলকাতায় স্থায়ী হয়েছেন। তার মেয়ে এ আর রহমানের গানটি শুনেছেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ আর রহমানের উচিত গানটি সরিয়ে নেওয়া এবং মূল সুরে সংরক্ষিত করা।
ছবি: Johny Hoque/DW
যেভাবে রচিত হয়েছে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’
১৯২১ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কারাগারে থাকাকালীন তার স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে স্বদেশপ্রেমের পটভূমিতে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ রচনা করেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৪৯ সালে গিরীন চক্রবর্তীর কণ্ঠে গানটি প্রথম রেকর্ড করা হয়। একই বছর ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ সিনেমায় স্থান পায় এই গান। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় একই সুরে গানটি রাখা হয়।
ছবি: Anis Films Corporation
রূপঙ্কর বাগচী, সংগীতশিল্পী
গানটা শুনে দুঃখ পেলাম। কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসাধারণ একটি গানের এমন পরিণতিতে অবাক হয়েছি। ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা একজন সুরকার ও সংগীত পরিচালক কাজটি করেছেন বলে আরো বেশি অবাক লেগেছে। তার এই কাজ করা ভুল হয়েছে। সুরটা পুরোপুরি বদলে দেওয়া দুঃখজনক।
ছবি: Debajyoti Chakraborty/NurPhoto/IMAGO
রাঘব চট্টোপাধ্যায়, সংগীতশিল্পী
এ আর রহমানের একটি গানের নতুন সংস্করণ অন্য একজন সংগীত পরিচালক তৈরির পর তিনি সমালোচনা করেন, কিন্তু হাস্যকরভাবে তিনি নিজে একই কাজ করেছেন। আমাদের সবার উচিত এ ধরনের কাজ বর্জন করা। গানটি গেয়েছেন বাঙালি শিল্পীরাই, কিন্তু তারা একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি কিংবা প্রতিবাদ জানাননি। (ওপরের ছবিতে কাজী নজরুল ইসলাম)
ছবি: Subho Singha
15 ছবি1 | 15
আসলে এআই সেটুকুই পারে যা মানুষ কল্পনা করতে পারে৷ অর্থাৎ, মানুষ কল্পনা করেছে এবং চেয়েছে যে আহা যদি এই গানটি আমার প্রিয় শিল্পীর কণ্ঠে শুনতে পেতাম! তার এই চাওয়া, সে যতই অকারণ অদ্ভূত হোক, এআই তা করে দেখাতে পারে৷ কিন্তু , আজও এআই ডানা ঝাপটায় মানুষেরই কল্পনার আকাশে৷ মানব কল্পনার বাইরে স্বাধীন ভাবে ওড়া কিন্তু এখনও সে শেখেনি৷ হ্যাঁ, অবশ্যই সে যেটা পারে তা হল মানব কল্পনাকে অবিকল খুব দ্রুত রূপদান করতে৷ তবে যেদিন এ আই মানুষের কল্পনাকে হারিয়ে ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে যাবে, সেদিন , আমি নিশ্চিত মানুষের কল্পনাও অন্য ডানা পাবে, পাবে আরও বড় আকাশ৷ যে কথা বলছিলাম,কোন গানই কিন্তু কোন বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি নয়৷ তার নির্মাণের পেছনে থাকে সেই সময়ের বেশ কিছু দাবি, তাই যে কোনো গানই একটি বিশেষ সময়ের কণ্ঠ৷ সেটি সেই সময়ে শ্রেষ্ঠ হলেও মানুষ কিন্তু তাকে পেছনে ফেলেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়৷ তার এই যাওয়ার রাস্তায় যে নরম পলি পড়ে থাকে তাতে আঁকি বুকি কেটে তার ওপর দিয়েই স্রোতস্বিনী বয়ে চলে৷ এই বহমানতাই বাঁচিয়ে রেখেছে যে কোনো সৃষ্টিকে৷ তাই পেছনে ফিরে যাওয়া মানে কিছুটা সৃষ্টির নিয়মের বিপরীতে যাওয়া৷ রহমানের মত সৃষ্টিশীল সঙ্গীত পরিচালক কি তাই করবেন?
এই ছবিতে এই কণ্ঠ ব্যবহার কতোটা প্রয়োজনীয় আর কতোটা উন্নততম প্রযুক্তি ব্যবহারের কৌশলকে তুলে আনা, তা খানিক ভাবনার জায়গা তৈরি করে , এ আর রহমান আমার বন্ধু এবং ব্যক্তিগত বন্ধুতার খাতিরে আমি জানি এ আর রহমানের মত একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালকের কাছে সঙ্গীত কত পবিত্র৷ আগেও তার মিউজিকে তিনি বহু রকম প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন এবং এও জানি তিনি কী পরিমাণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন তার ল্যাবরেটরিতে৷ সঙ্গীত নিয়ে তার যা ভাবনা তা হয়ত অনেকেরই নেই৷ তাই তার ভাবনাকে সম্মান জানিয়ে আমরা এই মুহূর্তে ভাবতে চাইব যে সেই ছবিতে এই কণ্ঠস্বরের প্রয়োজনীয়তা ছিল৷ ছিল বলেই এ আর রহমান এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন৷
একটা কথা বলি৷ একদিন গুহামানব নিজের খেয়ালেই গুহার দেওয়ালে তার সামনের দেখা প্রাণীটির প্রতিকৃতি এঁকে ফেলেছিল৷ আধুনিক চিত্রকলার সেই তো শুরু, তারপর কালের নিয়মে কত উন্নত হলো প্রযুক্তি কিন্তু ভ্যান গখ রেমব্রান্ট অবনীন্দ্র রামকিঙ্কর ঘুরে হাতে আঁকা ছবি তো আজও আছে৷ এবং থাকবেও৷ উন্নত প্রযুক্তি মানুষেরই নির্মাণ৷ মানুষের জন্য৷ যদিও শুনতে পাচ্ছি হলিউডে এআই স্ক্রিপ্ট এর ব্যবহার নিয়ে ধর্মঘট করেছেন ওখানকার স্ক্রিপ্ট লেখকেরা৷ তবু আমি এখনও মানিনা যে এআই মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী, তার নির্মাণ মানুষের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে৷ অনেকেই আমরা ছোটবেলায় রচনা লিখেছিলাম বিজ্ঞান- আশীর্বাদ না অভিশাপ? এআই ও আজ ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে৷ প্রয়োজন সঠিক সুচিন্তিত ব্যবহারের৷
রহে না রহে হাম, রশিদ থাকবেন
৫৬ বছর বয়সে উস্তাদ রশিদ খান ছেড়ে চলে গেছেন আমাদের। কিন্তু তার গান, তার গায়কী বহু প্রজন্মের কানে কানে বেঁচে থাকবে।
ছবি: Sudipta Bhowmick
মার না খেলে সুর শেখা যায় না
আড্ডাবাজ রশিদ আর পাঁচজন শাস্ত্রীয় সংগীতের দিকপালের মতো গম্ভীর ছিলেন না। খোলামেলা মেজাজে খুব কঠিন কথা বলে ফেলতে পারতেন তিনি। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে খুব সহজেই তাই বলে ফেলেছিলেন, শিক্ষকের মার না খেলে তিনি সুর শিখতে পারতেন না।
ছবি: Sudipta Bhowmick
শিক্ষক দাদু
১৯৬৮ সালে উত্তরপ্রদেশের বদায়ুঁতে জন্ম রশিদের। যে ঘরে জন্ম সে ঘর ততদিনে বিখ্যাত রামপুর ঘরানার হিন্দুস্তানী সংগীতের জন্য। দাদু নিসার হুসেন খানের কাছে প্রথম তালিম। ভোর চারটে থেকে শুরু হতো তালিম। সারা দিন ধরে কেবল একটি সুর লাগিয়ে যেতে হতো। ছোটবেলার সেই কঠিন অধ্যাবশায় মোটেই পছন্দ ছিল না রশিদের। অনেক পরে রশিদ নিজে সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন, ১৮ বছর বয়সে পৌঁছে সংগীতের আসল রস পেতে শুরু করেন তিনি।
ছবি: Sudipta Bhowmick
উস্তাদজির সঙ্গে কলকাতা
১৯৮০ সালে উস্তাদ নিসার হুসেন খান কলকাতায় চলে আসেন আইটিসি সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমির দায়িত্ব নিয়ে। সঙ্গে নিয়ে আসছেন রশিদকে। সেই যে কলকাতার প্রেমে পড়লেন রশিদ। আর কখনো ফিরে যাননি পৃথিবীর কোনো প্রান্তে।
ছবি: Sudipta Bhowmick
রাতভর আড্ডা আর রান্না
রশিদের বন্ধুরা বলেন, উস্তাদ আড্ডা মারতে শুরু করলে থামতে পারতেন না। পকেট থেকে বেরিয়ে আসতো একের পর এক পান। গানে-গল্পে রাত কাবার হতো। এক সুর থেকে আরেক সুরে ক্রমাগত চলতে থেকেছেন অনর্গল। ঈদে বন্ধু-আত্মীয়দের বাড়িতে ডেকে বিরিয়ানি খাওয়াতেন রশিদ। সে রান্নাও হতো রাতভর। গোটাটা একার হাতে। হাঁড়ি থেকে প্লেটে বিরিয়ানি তুলে দেওয়ার দায়িত্বও নিতেন নিজে। খুঁত খুঁতে, তাই কারো হাতে সেই দায়িত্ব ছাড়তেন না।
ছবি: privat
আওগে জব তুম
হিন্দুস্তানী সংগীত গায়কদের অনেকেরই গান নিয়ে ছুৎমার্গ আছে। সিনেমায় গান গাইতে চান না তারা। রশিদ বহু ছবিতে গান গেয়েছেন। তার গলা হাওয়ার মতো ভেসে বেড়িয়েছে সুরের সমস্ত দরজায়। রশিদের গলায় অন্যতম গান 'আওগে জব তুম ও সাজানা'। জব উই মেট ছবির এই গানের কথা অনুষ্ঠানে খেয়ালের মতো ব্যবহার করতেন রশিদ। এই গান থেকেই তান তৈরি করতে করতে আবেশ তৈরি করতেন। সুরের ফুল ঝরিয়ে দিতেন দর্শকের মনে-- অঙ্গনা ফুল খিলেঙ্গে...
ছবি: Subrata Goswami/DW
খেয়ালের ছাঁচে তারানা
হিন্দুস্তানী সংগীতের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ স্টাইল তারানা। প্রায় সমস্ত শিল্পীই স্বীকার করেন সুরের কাঠামোয় অন্যতম কঠিন এই অংশ। খুব দ্রুত যেখানে একের পর এক সুর লাগতে লাগতে এক আবেশ তৈরি হয়। উস্তাদ রশিদ খান সম্ভবত প্রথম শিল্পী যিনি এই তারানাকে খেয়ালের ঢঙে গাইতে শুরু করেন। অর্থাৎ, কেবল শুধু কিছু সুর বলা নয়, সেই সুরের শরীরে এক আত্মার জন্ম দেওয়া। রশিদ নিজে বলতেন, সুরের কাঠামোয় 'ইমোশন' তৈরি করা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
ক্যান্সার আক্রান্ত
প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন রশিদ। শুরুতে বুঝতে দেননি কাউকে। চিকিৎসা শুরু হওয়ার পরেও অনুষ্ঠান করেছেন। ছেলেকে নিয়ে মঞ্চে উঠেছেন সুদূর অ্যামেরিকাতেও। কিন্তু ক্রমশ শরীর খারাপ হচ্ছিল। গত নভেম্বরে মাথায় রক্তক্ষরণ হয়। সেখান থেকেই মৃত্যুর সঙ্গে বন্ধুতা শুরু উস্তাদজির।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শেষকৃত্যে মানুষের ঢল
কলকাতার রবীন্দ্রসদনে রাখা হয়েছিল তার মরদেহ। ভক্তের ঢল নেমেছিল সদন চত্বরে। সকলের চোখে জল। ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সংগীত জগতের প্রায় সমস্ত তারকারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
গান স্যালুট
পুরস্কার, সম্মান প্রথাগত কোনো কিছুকেই কখনো বিশেষ তোয়াক্কা করেননি রশিদ। তার সব কথার শেষেই শেষপর্যন্ত এসে পড়তো সংগীত। তার মরদেহ ঘিরে যখন একের পর এক বন্দুকের শব্দ গর্জে উঠছে, তখনো কী তিনিও গাইছেন-- বরসে গা সাওয়ান/ঝুম ঝুম কে/দো দিল অ্যাসে মিলেঙ্গে...