‘এইভাবে দখল, চাঁদাবাজি চললে আমরা কী জুলাই উদযাপন করছি!'
১ আগস্ট ২০২৫
ডয়চে ভেলে: গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর চাঁদাবাজি , দখলদারির ক্ষেত্রেও মানুষ একটা পরিবর্তন আশা করেছিল। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন , আগে ব্যবসায়ীদের চাঁদা দিতে হতো এক লাখ টাকা , এখন দিতে হয় পাঁচ লাখ টাকা। সেই হিসেবে চাঁদা তো পাঁচগুণ বেড়ে গেল...
স্নিগ্ধা রেজওয়ানা: আশা থাকলেও এখন আমরা হতাশ। চাঁদা আগেও ছিল। সেটা সিস্টেম্যাটিকভাবে হতো। যারা নিতেন, যারা দিতেন, তারা সিন্ডিকেটের অংশ হিসাবেই এটা করতেন। এই সিন্ডিকেট ভেঙে পড়েছে। তার প্রভাব সরাসরি সাধারণ মানুষের ওপর পড়েছে। আগে আপনি জানতেন কখন, কাকে, কত টাকা দিলে কাজ হতো। কিন্তু ৫ আগস্টের পর এই চাঁদার এত এত ভাগীদার যে কাকে, কখন, কত টাকা দিলে কাজ হবে- এটা এখন আর লোকজন জানে না।
তাহলে ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজ ও চাঁদার পরিমাণ কি বেড়ে গেল?
হ্যাঁ , চাঁদার পরিমাণ ও দাবিদার দুইটিই বেড়ে গেছে। এখন ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। আগে ছিল একটা। আর মানুষ জানেও না কোন দলকে দিলে কাজ হবে। ফলে সবাইকে দিতে হয়। একইভাবে দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা- সেটার শিকারও এভাবেই সাধারণ মানুষ হচ্ছে।
বিএনপির চাঁদাবাজ কেন বেড়ে গেল? তারা কেন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে?
বিএনপি ১৫ বছর ধরে নিপীড়নের শিকার হয়েছে। তাদের নেতৃত্ব কিন্তু এখন বলতে গেলে ‘ব্রোকেন'। ফলে, তৃণমূল থেকে শুরু করে সব জায়গায় তারা নিয়ন্ত্রণহীন। কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের নেতা-কর্মীদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। গত ১৫ বছর ছিল না, এখনো নাই। ফলে যে যার মতো চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে ১৫ বছর বা তার বেশি সময় না খাওয়ার, না পাওয়ার একটা তাড়নাও আছে।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তো আছে...
পুরো নেতৃত্বে আছেন তারেক রহমান। কিন্তু আমি সেভাবে দেখছি না। যেমন, আমরা জানতাম বিগত আওয়ামী লীগ সরকারে বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতো ওবায়াদুল কাদের। আরো অনেক ভাগ ছিল। কে কোনটা দেখছে তা ভাগ করা ছিল। কিন্তু বিএনপিতে এখন সেটা নাই। আপনি জানেন যুবদল, ছাত্র দল কে নিয়ন্ত্রণ করে? ফলে নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় তারা চলছে।
বিএনপি তো ব্যবস্থাও নিচ্ছে। তারপরও তো কাজ হচ্ছেন।
ওই যে সব কিছু এক জায়গা বা উপর থেকে দেখলে হবে না। কাজ ও দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে।
তরুণদের নতুন দল এনসিপি। তারা তো পরিবর্তনের কথা বলছে। তারা তো নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছে। তাদেরও কেউ কেউ চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন। গ্রেপ্তারও হচ্ছেন চাঁদাবাজি করতে গিয়ে।
বিএনপি তো পুরনো বন্দোবস্তের রাজনৈতিক দল। কিন্তু নয়া বন্দোবস্তের কথা বলে যারা এসেছে, তারাও একই কাজ করছে। এর কারণ হলো, আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা এনসিপি যাদের কথাই বলেন, আসলে মানুষের মধ্যে কোনো সততা নাই। দেশপ্রেম নাই। এখানে রাজনীতি ইনকাম করার একটা মাধ্যম। এখানে রাজনীতিতে পদ অনুযায়ী আয় হয়।
উমামা ফাতেমা বলেছেন, যারা চাঁদাবাজি করে ধরা পড়েছেন, তাদের শেকড় অনেক গভীরে। তাহলে এটা কি কেন্দ্রীয়ভাবেই করা হচ্ছে নতুন দলের ফান্ডের জন্য?
এখনকার তরুণদের মধ্যে একটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে - দখলদারিত্ব এবং পয়সা। এটা একটা ভয়ঙ্কর প্রবণতা। এরা আবার পরিবারের রেসপনসিবিলিটি নেয় না। নিজেরাই আনন্দ করে বা ভোগ, বিলাসে পয়সা ব্যয় করে। আগে এটা ছিল না। আগে ফ্যামিলি রেসপনসিবিলিটির বিষয় ছিল। এখন তরুণরা হয় অর্থ পাচার করছে, নয়তো ব্যাংকে রাখছে। তারা কিন্তু এই চাঁদবাজির অর্থ বিনিয়োগ করছে না।
জামায়াত কি চাঁদাবাজির বাইরে? তারা চাঁদাবাজি করে না - এই দাবি কি চলে?
-জাময়াত কি কোনো আদর্শিক দল? তাদের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ কম আছে? ধরেন, চাঁদাবজির অভিযোগ নাই, ‘হত্যার' অভিযোগ আছে। তাহলে কি অপরাধ কম? বিভিন্ন জায়গা থেকে রগকাটার অভিযোগ করা হয়, জামায়ত অস্বীকার করে। এই অভিযোগগুলো কি চাঁদাবাজির চেয়ে কম?
কেউ বলেন চাঁদা, কেউ ডোনেশন, কেউ হাদিয়া, কেউ ইয়ানত - আবার কেউ বলেন ক্রাউড ফান্ডিং। তাহলে কোনো রাজনৈতিক দল কি চাঁদাজির বাইরে আছে?
এমনকি জামায়াতের তো নিয়মিত ‘ডোনার' আছে। তারা কি তাদের ডোনারদের নাম প্রকাশ করে? কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের ডোনারদের নাম প্রকাশ করে না। ট্রাম্পের নির্বাচনে ডোনার ইলন মাস্ক। এটা প্রকাশ্য। কিন্তু আমাদের এখানে এই সততা নাই। কোনো রাজনৈতিক দলেই নাই। দলের আয়ের উৎস। রাজনৈতিক নেতার আয় এবং আয়ের উৎস এগুলো তো সাধারণ মানুষের জানার অধিকার আছে। এগুলো প্রকাশ না করলে আপনি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে বরবেন?
ওই যে চাঁদার নানা নামের কথা বলছিলাম...
এখানে এখন চাঁদাবাজি কারটা বৈধ, কারটা অবৈধ, কারটা জায়েজ- এই তিন ধরনের গ্রুপ তৈরি হয়েছে। বিএনপি যেহেতু বড় দল, পুরনো দল, সে যখন চাদাবাজি করে তখন সে হচ্ছে সন্ত্রাসী। এনসিপি যখন চাঁদাবাজি করে, তখন সেটা তার ডিমান্ড, সে বলে ক্রাউড ফান্ডিং। যেহেতু সে নতুন দল, সে বলে ডোনেশন। আর জামায়াতের ক্ষেত্রে হলে সে বলে হাদিয়া, ‘সবাই তো আমাদের হাদিয়া দেয়। তারা তো বলে তারা আমাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাই হাদিয়া দেয়।' জাকাতের টাকাও যদি জামায়াতের কাছে যায়, তাতেও আমি বিস্মিত হবো না।
আমরা প্রকাশ্যে যে চাঁদাবাজি হয় তা দেখি বা জানি। ধরা পড়লে জানি। কিন্তু অপ্রকশ্য চাঁদাবাজি হয় না? সেটার পরিমাণ কেমন?
আসলে অপ্রকাশ্য চাঁদাবজি অনেক বেশি, যেটা আমরা দেখি না। যেটা ধরা পড়ে, সেটা আমরা জানি। কয়টা ধরা পড়ে? আর কয়জনইবা অভিযোগ করে! আর সামনে যে দুই-চারজনকে দেখি, তারাই কি মূল? আসল চাঁদাবাজটা কে তা তো আমরা দেখি না। আমরা জানতে পারি না।
তাহলে সরকারের কি দায়িত্ব নাই? সরকার কী করছে? পুলিশ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কী করছেন? সেনবাহিনীও তো মাঠে আছে...
আসলে সরকারের সক্ষমতা নাই। সরকারের নিয়ন্ত্রণ নাই। যে যার মতো চলছে। তার সদিচ্ছা নাই। আর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ‘লিপ সার্ভিস' দিচ্ছেন। তিনি লিপ সার্ভিস দিয়েই দিন পার করছেন। এখন প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে কেউ মবকে যখন বলেন ‘প্রেসার গ্রুপ', তখন পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়? অনেক স্থাপনা, ভবন ভাঙা হলো সেনাবাহিনীর সামনে। তারা ব্যবস্থা নিলো না। অইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই পরিস্থিতিতে এখন চাঁদবাজির কৌশলে নতুন দুইটি দিক যোগ হয়েছে। মব সৃষ্টি করে বা মবের ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়। আরেকটি হলো. মামলার ভয় দেখিয়ে বা মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায়।
‘স্বৈরাচারের দোসর' বলেও চাঁদা আদায়ের আরেকটি কৌশল চলছে কিনা...
ওটা তো ৫ আগস্টের পর থেকেই চলছে। আর আপনি সঠিক কথা বললেও আপানাকে এই ধরনের ট্যাগ দেয়া হয়। এটা গত সরকারের সময় থেকেই শুরু।
দখলদারিত্বও তো চলছে। জমি দখল, পুকুর দখল, বাড়ি দখল...। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও দখল হচ্ছে।
এগুলো অন্যায় হচ্ছে। সরকারের এগুলো আইনগতভাবে দেখা উচিত। আসলে এইভাবে দখল, চাঁদাবাজি চললে আমরা কী জুলাই উদযাপন করছি! আগের সরকারের সময় খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর প্রক্রিয়া- এগুলো ছিল অসুস্থ রাজনীতি। সেই অসুস্থ রাজনীতির পুনরোৎপাদন হচ্ছে।