করোনার জন্য তাবলিগকে দায়ী করেছিল যে কলকাতা, আজ তারাই লাখে লাখে রাস্তায় নেমে পড়েছে পুজোর উন্মাদনায়।
বিজ্ঞাপন
বেশি দিন নয়, মাত্র মাস সাতেক আগের কথা। করোনা-লকডাউন তখনো শুরু হয়নি ভারতে। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে দিল্লিতে সভা আয়োজন করেছিল তাবলিগ জামাত। প্রায় হাজার দু'য়েক সদস্য দেশ বিদেশ থেকে এসে সেই সভায় যোগ দিয়েছিলেন। ভারতে তখন দৈনিক করোনা সংক্রমণ হাজারেরও কম। এর এক সপ্তাহের মধ্যে জানা যায়, ওই জমায়েতে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের মাধ্যমে করোনা ছড়িয়েছে। পুলিশ এবং প্রশাসন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। গোটা দেশ জুড়ে প্রাথমিক ভাবে তাবলিগের বিরুদ্ধে এবং তার পর গোটা মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধেই বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রাজনৈতিক ভাষ্য, সর্বত্রই ভারতে করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য তাবলিগকে দায়ী করা হয়।
সাত মাস পরের ছবিটা কী? দেশে প্রতিদিন সংক্রমণ হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার। লকডাউন উঠে গিয়েছে। সব কিছু স্বাভাবিক। এবং তারই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে দুর্গা পুজোর ধূম লেগেছে। শুধু কলকাতাতেই প্রায় ৩০ হাজার পুজোর আয়োজন হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার ষষ্ঠী। পুজোর প্রথম দিন। তার অন্তত চার দিন আগে থেকেই প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ভিড় জমাতে শুরু করেছেন দর্শনার্থীরা। লাখ লাখ মানুষ বেরিয়ে পড়েছেন পুজোর বাজারে। করোনা বলে যে কোনো প্যানডেমিকের অস্তিত্ব আছে, কলকাতার চেহারা দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। এতটুকু জৌলুস কমেনি কোনো পুজোর। উদ্যোক্তারা রাস্তা বন্ধ করে, বাঁশ বেঁধে, মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে দর্শনার্থীদের মণ্ডপে আসার আসার আহ্বান জানাচ্ছেন প্রতি বছরের মতোই।
করোনাকালে পুজোর ভিড়
কলকাতার রাস্তায় পুজোর ভিড় দেখে বোঝার উপায় নেই, করোনায় কুপোকাত গোটা বিশ্ব। নিয়ম মানার বালাই নেই। দেদার চলছে কেনাকাটি।
ছবি: Durga Puja festival/Reuters
পুজোর ভিড়
করোনা, তাই অনলাইনে পুজোর উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তাই বলে কলকাতার মানুষ বাড়িতে বসে নেই। রাস্তায় জনসমুদ্র।
ছবি: Sudipta Bhoumick
নিউ মার্কেট
কলকাতার অন্যতম জামা কাপড়ের বাজার নিউ মার্কেট। সেখানে থিক থিক করছে মানুষ। অন্য বছরের সঙ্গে এ বছরের কোনো তফাত নেই। অথচ প্রতিদিন করোনার প্রকোপ বাড়ছে।
ছবি: Sudipta Bhoumick
হাতিবাগান
হাতিবাগান মার্কেটের ছবিও একই রকম। পুলিশের বক্তব্য, করোনার জন্য যা যা নিয়ম স্থির করা হয়েছিল, তার কিছুই মানছেন না ক্রেতারা। গায়ে গায়ে চলছে বাজার।
ছবি: Sudipta Bhoumick
মাস্ক কই
পুজো শুরু হতে আরও কয়েক দিন বাকি। তার আগে হয়ে গিয়েছে খুঁটি পুজো। লাইন দিয়ে খুঁটি পুজোর প্রসাদ নিচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। কিন্তু কারও মুখে মাস্ক নেই।
ছবি: Sudipta Bhoumick
মণ্ডপেও ভিড়
দুর্গা পুজোয় কলকাতা কার্যত ইনস্টলেশন নগরী হয়ে ওঠে। বাহারি প্যান্ডেলে রূপ বদলে যায় শহরের। এ বারেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। দিকে দিকে প্যান্ডেলে মানুষ ভিড় জমাতেও শুরু করে দিয়েছেন। সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই।
ছবি: Sudipta Bhoumick
একা ব্যতিক্রমী
কলকাতার অন্যতম পুরনো পুজো সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যার। প্রতিদিন এক লাখ দর্শনার্থী ভিড় জমান তাদের প্যান্ডেলে। এ বছর কর্মকর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন, পুজো হবে কিন্তু দর্শক ঢুকতে দেওয়া হবে না। অনলাইনে দেখা যাবে পুজো এবং মণ্ডপ।
ছবি: Sudipta Bhoumick
কী বলছে প্রশাসন
পুজোর আগে বেশ কিছু সতর্কবার্তা জারি করেছিল প্রশাসন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, যে ভাবে ঢালাও প্যান্ডেল তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাতে সতর্কবার্তা কেউ মানবেন না। ইতিমধ্যেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে।
ছবি: Sudipta Bhoumick
করোনার প্রকোপ
রাস্তায় ভিড় যত বাড়ছে, কলকাতায় করোনার প্রকোপও ততই বাড়ছে। হাজারেরও বেশি মানুষ প্রতিদিন সংক্রমিত হচ্ছেন। তবু মানুষের ফূর্তির শেষ নেই।
ছবি: Durga Puja festival/Reuters
8 ছবি1 | 8
যাঁরা পুজোর আয়োজন করছেন, যাঁরা পুজো দেখতে এর মধ্যেই লাইন লাগিয়েছেন, যাঁরা ভিড় ঠেলে ব্যাগ বোঝাই বাজার করছেন, তাঁদের অনেকেই, সাত মাস আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় 'অমানুষ' বলে তাবলিগের বিরুদ্ধে গালাগালির বন্যা বইয়েছিলেন। হ্যাঁ, তাঁরাই দাবি করেছিলেন তাবলিগের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। হ্যাঁ, তাঁরাই প্রতিদিন টেলিভিশন চ্যানেল, নিউজ প্রিন্ট, সোশ্যাল মিডিয়ার অপরিসীম স্পেসে নিত্যনৈমিত্তিক বিচারসভা সভা বসিয়েছেন একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে ঠাঁসা শারদ উৎসবের কলকাতার বিচার করবে কে?
বিচার হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্টপুজো দেখার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আর তা নিয়ে গোঁসাও হয়েছে কর্মকর্তা এবং দর্শনার্থীদের। বাৎসরিক উৎসবে বাধা পড়ায় তাঁদের মেজাজ খারাপ। হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে, তা সময়ের দাবি। কিন্তু মানসিকতার বিচার হয় কি? আদালতের রায় বলছে, মণ্ডপের পাঁচ থেকে ১০ মিটারের মধ্যে ব্যারিকেড লাগিয়ে দিতে হবে। যাতে দর্শনার্থীরা ভিড় করে মণ্ডপে ঢুকতে না পারেন। একটু আগেই কলকাতার এক বড় পুজোর কর্মকর্তা তথা তৃণমূলের প্রথম সারির নেতার সঙ্গে ফোনে কথা হলো। খুব জোরের সঙ্গে বললেন, মণ্ডপে ঢুকতে নিষেধ করেছে আদালত, মণ্ডপ দেখায় তো আপত্তি করেনি! দর্শনার্থীরা আসবেন এবং দূর থেকে মণ্ডপ দেখে চলে যাবেন। এমন ব্যবস্থা করব, যাতে দূর থেকেই মণ্ডপের ভিতরটাও দেখা যায়। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, তাবলিগ নিয়ে আপনিও সরব হয়েছিলেন না? কথা ঘুরিয়ে দিলেন নেতাবাবু।
করোনা কালের ঈদ
করোনা মহামারির আতঙ্কের মধ্যেই এসেছে ঈদ৷ সৌদি আরব, মিশর, ওমানসহ বিশ্বের অনেক দেশ এবার ঈদ জামাত নিষিদ্ধ করে জনগণকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে৷
ছবি: imago images/Pacific Press Agency/R. S. Hussain
সৌদি আরবে কারফিউ
সৌদি আরবে আগামী ২৩ থেকে ২৭ মে ঈদুল ফিতরের ছুটি৷ করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশটির সরকার ঈদের ছুটিতে দেশজুড়ে কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং জনগণকে এ বছর ঘরেই ঈদের নামাজ আদায়ের আহ্বান জানিয়েছে৷
ছবি: Reuters
কাবা শরীফ
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকায় মার্চের মাঝামাঝি থেকেই মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র দুই নগরী মক্কা ও মদিনায় অবস্থিত মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী মুসল্লিদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়৷
ছবি: Reuters
সৌদি আরবের পথে মিশর
সৌদি আরবের মত মিশরও ঈদের ছুটিতে কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ১৯ মে বিকাল ৫টা থেকে দেশটিতে কারফিউ শুরু হয়েছে৷ এছাড়া ২৪ মে থেকে টানা ছয় দিন সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও জানিয়েছে দেশটির সরকার৷ ছবিতে কায়রোর একটি মসজিদে অতীতে অনুষ্ঠিত ঈদের জামাত দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters
ওমানে জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা-শাস্তি
ওমানের বাসিন্দাদের এবার বাড়িতে বসেই ঈদের নামাজ পড়তে হচ্ছে৷ দেশটিতে ঈদ জামাতসহ সব ধরনের গণজমায়েত নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি আইন লাঙ্ঘনে জেল-জরিমানার শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে৷ দেশটিতে বাইরে মাস্ক করা বাধ্যতামূলক৷
ছবি: Anne Allmeling
জর্ডানে যান চলাচলে কড়াকড়ি
মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ জর্ডানে ঈদের দিন যান চলাচলে কড়াকড়ি আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Mazraawi
ইরানে দ্বিতীয় দফায় বাড়ছে সংক্রমণ
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরানে প্রথম করোনা ভাইরাস মারাত্মকভাবে বিস্তার লাভ করে৷ প্রথম দফার সংক্রমণ কমে গেলেও সেখানে দ্বিতীয় দফায় আবারও সংক্রমণ বাড়ছে৷ তারপরও দেশটির সরকার স্বাস্থ্যসুরক্ষার নিয়ম মেনে ঈদ জামাতের অনুমতি দিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ZB/R. Zimmermann
তুরস্কে ঈদে চারদিনের লকডাউন
ঈদের ছুটির চারদিন দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান৷ ২৩ মে থেকে কার্যকর হচ্ছে লকডাউন৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/O. Dogman
পাকিস্তানে নিয়ম মেনে ঈদ জামাত
পাকিস্তানে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যু উভয়ই বাড়ছে৷ তারপরও দেশটির সরকার স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মানার শর্তে ঈদ জামাত আয়োজনের অনুমতি দিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Ali
বাংলাদেশে খোলা জায়গায় ঈদ জামাতে মানা
করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে এবার ঈদুল ফিতরের নামাজ ঈদগাহ বা খোলা জায়গার বদলে বাড়ির কাছের মসজিদে পড়তে বলেছে সরকার৷ তবে কোলাকুলি ও হাত মেলানো বারণ৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid Swapan
দিল্লিতে বাড়িতেই ঈদের নামাজ
এ বছর ঈদ বাড়িতে বসেই কাটানোর নির্দেশ দিলেন দিল্লির জামে মসজিদের শাহী ইমাম৷ তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন ভারতের ইসলামিক স্কলাররা৷
ছবি: DW/Syamantak Ghosh
যুক্তরাজ্যে প্রথমবার ঈদ জামাত হচ্ছে না
যুক্তরাজ্য সরকার দেশটির মুসলমানদের এবছর ঘরেই ঈদের নামাজ পড়ার আহ্বান জানিয়েছে৷ দেশটিতে এই প্রথম ঈদের জামাত হচ্ছে না বলে জানান দেশটির ধর্মীয় নেতারা৷
ছবি: picture-alliance/empics/A. Chown
11 ছবি1 | 11
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘুরে যায়। যে ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাত মাস আগে বিচার সভা বসেছিল সোশ্যাল নেটওয়ার্কের ওয়ালে ওয়ালে, তাঁরা কিন্তু দু'টো ঈদ কার্যত বাড়িতে বসে কাটিয়ে দিয়েছেন। ইমাম থেকে শুরু করে একাধিক মুসলিম সংগঠন সকলের কাছে একবার নয়, একাধিকবার আবেদন করেছিলেন, যাতে সকলে বাড়িতে বসে উৎসব পালন করেন। ভিড় না করেন। ঈদের বাজারেও তার প্রভাব দেখা গিয়েছে। শুধু কলকাতাতেই প্রতি বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম বিকিকিনি হয়েছে ঈদের আগে। আর দুর্গাপুজোয়? হিসেবের দরকার নেই। ছবি কথা বলছে। লাখ লাখ বুদ্ধি-বন্ধক রাখা মানুষের জনসমুদ্র মনে পড়িয়ে দিচ্ছে 'গণশত্রু'র কথা। ইবসেনের লেখা পড়ার দরকার নেই। সত্যজিৎ রায়ের ছবি তো অনেকেই দেখেছেন। দেখেছেন, কী ভাবে ধর্মান্ধ মানুষ অসুখ অস্বীকার করে মন্দিরে চরণামৃত খেতে গিয়েছেন। এবং তাতে সায় দিয়েছে রাজনীতি। যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, তাঁদের বাড়ি ঘর ভাঙচুর হয়েছে।
আসলে রাজনীতিই শেষ কথা। ক্ষমতাবানের রাজনীতি। সংখ্যায় যাঁরা কম, তাঁদের সব কাজেই দোষ। আর সংখ্যায় যাঁরা গুরু, তাঁদের কাজে কোনো অন্যায় নেই। তাঁদের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচারসভা বসে না। তখন আর কেউ একটি সংগঠনের ভুলের সঙ্গে একটি গোটা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে গুলিয়ে ফেলেন না।
লজ্জা করছে। কলকাতার মানুষ হিসেবে সত্যিই খুব লজ্জা করছে চোখের সামনে এই অন্যায় দেখতে দেখতে। দুই হাজার মানুষকে নিয়ে তাবলিগ যে অনুষ্ঠান করেছিল, তা ভুল ছিল, সন্দেহ নেই। লাখ লাখ মানুষ নিয়ে কলকাতায় এই মুহূর্তে যা চলছে, সেই ভুল তো সব মাপকাঠি ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রশাসন, সরকার, বিরোধী দল, জনগণ-- সকলে সেই ভুলের সমান অংশীদার। ধন্যবাদ কলকাতা হাইকোর্ট, ভুলটুকু অন্তত চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে তাতে মানসিকতা বদলাবে, এমনটা এখনও মনে করি না।