শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে শাহীন রেজা নূর আশা করেন, এই সরকারের আমলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হবে৷ কারণ এই সরকারের সময়ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন সম্ভব হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক৷ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বাংলাদেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক সেই সময় ১০ই ডিসেম্বর তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আলবদররা৷ এরপর তাঁকে আর তারা ফিরিয়ে দেয়নি৷ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন তখন আলবদর কমান্ডার৷ তার নেতৃত্বেই সিরাজুদ্দীন হোসেনকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়৷ এই হত্যাকাণ্ড ট্রাইব্যুনালে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে৷ তাই মুজাহিদের ফাঁসির রায়ে সন্তুষ্ট সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে শাহীন রেজা নূর৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, তাঁরা ৪২ বছর ধরে এই দিনটির অপক্ষোয় ছিলেন৷ সেই অপেক্ষার অবসান ঘটেছে৷ স্বাধীন বাংলায় ঘাতকদের শাস্তি হয়েছে৷ শহিদের আত্মা আজ তাই শান্তি পাবে৷
মুজাহিদের ফাঁসি
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে বুধবার (১৭.০৭.১৩) ফাঁসির রায় দিয়েছেন আদালত৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
‘আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে’ মৃত্যুদণ্ড
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দিয়েছেন ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২৷ বুধবার (১৭.০৭.১৩) দেওয়া রায়ে তাকে ‘আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে’ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে৷
ছবি: DW/S. Kumar Dey
আমৃত্যু কারাদণ্ড
মাত্র দু’দিন আগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় নব্বই বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১৷ বয়স বিবেচনায় এনে আযমকে মৃত্যুদণ্ড দেননি আদালত৷
ছবি: Nashirul Islam/AFP/Getty Images
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশ সরকারের দাবি, মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ এবং সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দুই লাখের মতো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ তবে আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, মুক্তিযুদ্ধে তিন থেকে পাঁচ লাখ প্রাণহানি হয়েছিল৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: AP
আলবদর কমান্ডার
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে আলবদর বাহিনী গঠন করে হত্যা, গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজসহ পাঁচটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে৷ ২০১০ সালের ২৯শে জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় তাকে৷ বর্তমানে তিনি কারাবন্দি আছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Stringer
‘‘মানুষ হত্যা করেছেন মুজাহিদ’’
যুদ্ধাপরাধ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘মুজাহিদ শুধু বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং গণহত্যার পরিকল্পনাকারীই ছিলেন না, তিনি নিজেও সরাসরি গুলি করে মানুষ হত্যা করেছেন৷ ফরিদপুর এলাকায় তার নৃশংসতার সাক্ষী এখনো আছে৷’’ এই রায়ে সন্তুষ্ট বাদল৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
ফেসবুক প্রতিক্রিয়া
ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘এই রায় মানি৷’’ আর শরিফুল হাসান লিখেছেন, ‘‘যে যাই বলুন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আমি শতভাগ তৃপ্ত না হলেও এ পর্যন্ত যা পেয়েছি তাতেও আমি অনেক খুশি৷’’ তবে তপু হোসেন ডয়চে ভেলের ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘‘এটা ভুয়া রায়... মানিনা মানবো না৷’’
ছবি: Reuters
‘‘এটি প্রহসনের রায়’’
জামায়াতে ইসলামী এই রায় ঘোষণার প্রতিবাদে বুধবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করেছে৷ মুজাহিদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘এটি প্রহসনের রায়৷ রাষ্ট্রপক্ষ কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি৷’’ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলেও জানান ইসলাম৷
ছবি: Reuters
দুই দিনে নিহত ৯
যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ১৫ ও ১৬ জুলাই সহিংসতায় কমপক্ষে নয় ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে৷ জামায়াতে ইসলামী এই সময় হরতাল পালন করেছে৷ মঙ্গলবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছে চার ব্যক্তি৷ আর সোমবার পাঁচ ব্যক্তি৷ দৈনিক প্রথম আলো প্রকাশ করেছে এই তথ্য৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনালের ষষ্ঠ রায়
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে এই রায় যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের ষষ্ঠ রায়৷ এর আগে ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সাবেক নেতা আবুল কালাম আযাদকে ফাঁসি, জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে ফাঁসি, মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসি এবং সর্বশেষ সোমবার গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Stringer/AFP/Getty Images
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
শাহীন রেজা নূর বলেন, চরম হতাশায় কেটেছে তাঁদের গত ৪২টি বছর৷ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, ঘাতকরা আবার স্বরূপে ফিরে আসে, প্রতিষ্ঠিত হয়৷ তারা আবার চলে যায় ক্ষমতার কেন্দ্রে৷ ঘাতকের গাড়িতে ওঠে জাতীয় পতাকা৷ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর আদর্শকে বিদায় করা হয়৷ দেশ ফিরে যায় পাকিস্তানি আদর্শে৷ আর তখন যুদ্ধাপরাধীর বিচার, পিতৃহত্যার বিচার পাওয়া তো দূরের কথা, তাঁদের জন্য বেঁচে থাকাই ছিল কষ্টকর৷ কিন্তু একদিন ন্যায় বিচার পাওয়া যায়৷ কারণ, ঘাতকরা যতই ক্ষমতাধর হোক, তারা ঘাতকই৷
শাহীন রেজা নূর জানান, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ‘ম্যান্ডেট' নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে৷ তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে কাজ করছে৷ ট্রাইব্যুনালও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ৷ এ পর্যন্ত মুজাহিদসহ ছয়জনের শাস্তি হয়েছে৷ সে জন্যই শাহীন রেজা নূরের আশা, এই সরকারের মেয়াদকালেই এসব রায় কার্যকর হবে৷
তিনি অবশ্য বলেন, ‘‘সামনে আরো বাধা আছে৷ যে অশুভ শক্তি আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তারা এখনও সক্রিয়৷ সক্রিয় যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত-শিবিরও৷ তারা চায় এই বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করতে৷ তাই তারা প্রতিটি রায়ের পর দেশ জুড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে৷ তারা হামলা ও সন্ত্রাস করে ভীতির সৃষ্টি করছে৷ আর এই কাজে তাদের মদদ দিচ্ছে তাদের সহযোগিরা৷ কিন্তু তারা সফল হবে না৷ কারণ অশুভ শক্তি শেষ পর্যন্ত সফল হয় না৷''
শাহীন রেজা নূরের কথায়, শুধু ঘাতকদের নয়, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত-শিবিরকেও বিচারের আওতায় আনতে হবে৷ এই দলটি নয়ত তাদের আস্ফালন অব্যাহত রাখবে৷