এই সাংসদ আর ওসি যেন সেই পাকসেনা আর রাজাকার
৩১ জানুয়ারি ২০২১![Bangladesch illegale Ziegellei in Jessore](https://static.dw.com/image/56392938_800.webp)
যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দিনকে থানায় বোমা মেরে এক পরিবেশকর্মীকে ফাঁসানোর নির্দেশ দিয়েছেন৷ অভিযোগ হাওয়া থেকে আসেনি৷ শাহীন চাকলাদার এবং জসিম উদ্দিনের সেই কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছে৷ সেখানে আওয়ামী লীগ নেতাশাহীন চাকলাদারকে শেখ সাইফুল্লাহ নামের এক পরিবেশকর্মীকে ফাঁসাতে থানায় বোমা মারার নির্দেশ দিতে শোনা গেছে৷
পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)-র নেটওয়ার্কিং সদস্য শেখ সাইফুল্লাহর ‘অপরাধ’ যশোরের কেশবপুর উপজেলার উত্তর সাতবাড়িয়া গ্রামের একটি ইটভাটার বিরোধিতা করা৷ গ্রামের অনেকেই ইটভাটার বিরুদ্ধে৷ লিখিতভাবে গ্রামের ভিতরে ইটভাটা না রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন তারা৷ পরে বেলা’র পক্ষ থেকে ‘সুপার ব্রিকস'-এর বিরুদ্ধে রিট করলে আদালত সেই ইটভাটার কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেয়৷ সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, শেখ সাইফুল্লাহ ইটভাটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বলেই সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার সংসদীয় এলাকাবাসীর কল্যাণ সাধনের দায়িত্ব ভুলে ক্ষমতার দম্ভে যার কাজ বোমাবাজদের আইনের আওতায় আনা, সেই ওসিকেই বলেছেন বোমা মেরে এক পরিবেশকর্মীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাতে৷
শাহীন চাকলাদার অবশ্য অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন৷ ওসিও বলছেন এমন কোনো কথোপকথনের কথা তার মনে নেই৷ সংসদ সদস্য এবং ওসির এমন প্রতিক্রিয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ বড় অভিযোগ সামনে এলে সব অভিযুক্তকেই অভিযোগ অস্বীকার করতে দেখা যায়৷ এমন প্রবণতা দলকেন্দ্রিক বা পেশাকেন্দ্রিকও নয়৷ সব দল, সব পেশা, সব সমাজ, সব দেশেই অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে অপরাধী হলেও সাধারণত দায় এড়ানোর কৌশল অবলম্বন করে রেহাই পেতে চায়৷ একই কৌশলে শাহীন চাকলাদার এবং জসিম উদ্দিনও পার পেয়ে যাবেন কিনা তা সময়ই বলতে পারবে৷ দেশে বিচারহীনতার ইতিহাস খুব দীর্ঘ৷ তাই কেশবপুর খানার ওসির কেশাগ্রও হয়ত বাঁকা হবে না, শাহীন চাকলাদারও ভবিষ্যতে হয়ত আরো দানবীয় ক্ষমতায় আরো অনেক প্রতিকারপ্রার্থীকে ঘায়েল করবেন নতুন কোনো অপকৌশলে- এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না৷
কথিত এ ফোনালাপে শাহীন চাকলাদারের বক্তব্য কোনো সংসদ সদস্যের মুখে তো নয়ই, এমনকি সাধারণ কোনো ‘সুস্থ’ মানুষের মুখেও মানায় না৷ ওসি জসিম উদ্দিনের ভূমিকাও কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়৷
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের প্রায়ই প্রতিপক্ষকে ‘রাজাকার’ বলতে শোনা যায়৷ তখন কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরে কি আর দেশে রাজাকার থাকতে পারে? প্রশ্ন উত্থাপনকারীরা বোঝাতে চান, ৭১-এ যারা স্বাধীনতার সরাসরি বিরোধিতা করেছিলেন তাদের বেশিরভাগই তো বেঁচে নেই, সুতরাং এখন আর রাজাকার থাকার কথা নয়৷
রাজাকার একটি আরবি শব্দ৷ এর অর্থ স্বেচ্ছাসেবী৷ কিন্তু ৭১-এ পাক বাহিনীর সকল বর্বরোচিত কাজে সহায়তা করায় রাজাকারের অর্থ অভিধানে যা-ই থাকুক, ইতিহাসে তারা ঘৃণিত৷ ৭১-এর বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশে রাজাকার শুধুই একটা গালি৷
ক্ষমতাধরের অন্যায় কাজেও সর্বতোভাবে সহায়তা করা মানুষ এখনো অনেক আছে সমাজে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা একাত্তরের পাকবাহিনী এবং রাজাকারের কথাই মনে করিয়ে দেয়৷
কথিত ফোনালাপে সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের বক্তব্য অনেকটা ১৯৭১ সালের পাকসেনার সঙ্গেই মেলে৷ অন্যদিকে ওসি জসিম উদ্দিনের ভূমিকা মেলে রাজাকারের সঙ্গে৷ পাক বাহিনী যেমন রাজাকারদের সহায়তায় এই ভূখণ্ডে হামলা, নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, রাজাকাররা সব কাজে তাদের সহায়তা করেছে; ওসি জসিম উদ্দিন ঠিক সেভাবেই শাহীন চাকলাদারের ‘পাকসেনাসুলভ’ নির্দেশে সায় দিয়েছেন৷ এই ২০২১ সালেও বাংলাদেশের এক ওসির মানসিকতা এতটাই ‘রাজাকারসুলভ’ যে, সংসদ সদস্য ফোনে সাইফুল্লাহর পরিচয় জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওসি বলেছেন, ‘‘ও একটা বাজে ছেলে, স্যার৷’’ বোমা মারার নির্দেশেও নীরবে কার্যত সায়ই দিয়েছেন তিনি৷
এমন সংসদ সদস্য আর ওসি থাকলে মানুষ রাজাকারদের ঘৃণা করতে ভুলে যেতে পারে৷
রাজাকারদের প্রতি বাংলাদেশের হৃদয়ভরা ঘৃণা ধরে রাখতেও (অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে) যশোর-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদার এবং কেশবপুর থানার ওসি জসিম উদ্দিনের বিচার হওয়া জরুরি৷