একই দিনে দুই জায়গাতে নিশানায় তদন্তকারীরা
৬ জানুয়ারি ২০২৪রেশন দুর্নীতির তদন্তে শুক্রবার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায় তদন্তকারী সংস্থা। উত্তর ২৪ পরগনার জেলা পরিষদের তৃণমূল সদস্য শেখ শাহজাহানের বাড়িতে গিয়ে আক্রান্ত, রক্তাক্ত হন আধিকারিকরা। এই জেলার বনগাঁর সাবেক পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যকে গ্রেপ্তার করার সময় রোষের মুখে পড়েন তারা।
শাহজাহানের রাজত্ব
রেশন দুর্নীতি মামলায় সন্দেহভাজন শাহজাহান এখনো নিপাত্তা। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ এই নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেন বলে অনুমান ইডির। তাই তার নামে লুকআউট নোটিস জারি হয়েছে।
ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও সন্দেশখালির সরবেড়িয়া এলাকা থমথমে হয়ে রয়েছে। গতকালের গন্ডগোলের নানা নমুনা ছড়িয়েছিটিয়েরয়েছে গ্রামে। সংবাদমাধ্যমের ভাঙা ক্যামেরা, গাড়ির কাচের টুকরো ইত্যাদি।
শাহজাহানকে নিয়ে হইচইয়ের পর সামনে এসেছে তার অগাধ সম্পত্তির কথা। বিশাল বাড়ির চত্বরে মিলেছে ত্রাণে ব্যবহৃত রাজ্য সরকারের অজস্র ত্রিপল। নেতার গ্যারেজের আচ্ছাদন হয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের ওই ত্রিপল দিয়ে।
ধামাখালি এলাকায় রয়েছে একটি বড় হোটেল, যার মালিকানা তৃণমূলের দাপুটে নেতার বলেই দাবি স্থানীয় সূত্রের। শুধু তাই নয়, শাহজাহানের নামেই সরবেড়িয়ায় রয়েছে একটি বাজার। এই এলাকায় মাছের আড়ত, একাধিক ইটভাটা, মাছ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রের ‘মালিকও' এই শাহজাহান।
সন্দেশখালির নদীর বুকে গজিয়ে ওঠা চরে, কংক্রিটের ঢালাই করে গজিয়ে উঠেছে ইমারতি সামগ্রীর ব্যবসা। এখান থেকে বিভিন্ন দ্বীপে নৌকো করে পণ্য সরবরাহ করা হয়। নদীর ধারে গড়ে উঠেছে সার সার বেআইনি দোকান। এসবই এলাকার 'বেতাজ বাদশা' শাহজাহানের নেতৃত্বে চলে বলে খবর স্থানীয় সূত্রের।
বনগাঁয় উত্তেজনা
রেশন বণ্টন দুর্নীতি মামলা কেন্দ্রীয় সংস্থার জালে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁর সাবেক পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য। শুক্রবার টানা ১৭ ঘণ্টা তল্লাশি চলে শঙ্করের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি-সহ আরও পাঁচ ঠিকানায়। ইডি-র দাবি, নগদ প্রায় আট লক্ষ টাকা উদ্ধার হয় তার শ্বশুরবাড়ির আলমারি থেকে।
মধ্যরাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের পর তৃণমূল নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এলাকার প্রভাবশালী এই নেতাও জ্যোতিপ্রিয়র ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ইডি সূত্রের দাবি, রেশন দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করার ভার ছিল শঙ্করের উপর। তার বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবসা আছে।
আজ শঙ্করকে আদালতে পেশ করে ইডির দাবি, রেশন দুর্নীতির মোট অঙ্ক ১০ হাজার কোটি। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন এই নেতা। তাকে ১৪ দিনের ইডি হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।
শুক্রবার সকালে যে ছবি দেখা গিয়েছে সন্দেশখালিতে, তার থেকে গন্ডগোল কম হলেও তদন্তকারীদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয় বনগাঁয়। শঙ্করকে বাড়ি থেকে বার করার সময় বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন তার 'অনুগামীরা'। ধৃতকে গাড়িতে তুলতে বেগ পেতে হয় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। ভিড়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়।
উত্তেজিত মানুষজন ইডি আধিকারিকদের লক্ষ্য করে ইট ছোড়ে। এলাকা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। কেন্দ্রীয় বাহিনী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
পুলিশের ভূমিকা
একইদিনে দুটি ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, তদন্ত করতে এলে আক্রমণের মুখে পড়া কি বঙ্গ রাজনীতির নতুন ট্রেন্ড হয়ে উঠল? পুলিশ কেন তদন্তকারীদের নিরাপত্তা দিতে পারল না?
বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, "পুলিশ দলদাসের মতো কাজ করছে। তাই তদন্তকারীরা আক্রান্ত হলেও তারা কাউকে ধরতে করতে পারছে না।"
তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের বক্তব্য, "কেন্দ্রীয় সংস্থার উচিত তাদের গতিবিধি জানিয়ে কোনো এলাকায় যাওয়া। তা হলে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যেতে পারে।"
শুক্রবার আক্রান্ত ইডি আধিকারিকদের গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। তারা সন্দেশখালি থানার লঞ্চে চেপে নিরাপদ স্থানে যান। এই থানায় স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ দায়ের করেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। পাল্টা ন্যাজাট থানায় শাহজাহানের বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণকারী ইডির বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছেন।
আধিকারিকদের নিরাপত্তা
ভবিষ্যতে যে কোনো তদন্তের সময় আধিকারিকরা কতটা নিরাপদ থাকবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আধাসেনার উপস্থিতি সত্ত্বেও কেন এটা ঘটল? এটাকে বাহিনীর 'কৌশল' বলে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
রাজ্যের সাবেক পুলিশ কর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, "সন্দেশখালিতে গুলি চলুক এটা শাসক দল চাইছিল। এতে শীতলখুচির মতো পরিস্থিতি তৈরি হত। তারা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারত।"
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সাবেক শীর্ষ কর্তা উপেন বিশ্বাসের মতে, "পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ করেছে। ওরা জানত, এমন পরিস্থিতি কোনো দিন আসবে। গুলিচালনার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছিল। মার খেয়েছে, রক্ত ঝরেছে, কিন্তু বাহিনী গুলি চালায়নি।"
ঘটনাকে 'অনভিপ্রেত' বললেও শাসক দল একে 'জনরোষ' আখ্যা দিচ্ছে। মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বক্তব্য, "ইডি-সিবিআইকে দিয়ে বিজেপি এসব করাচ্ছে। তৃণমূলকে হেনস্থা করছে। তাই জনতা রুখে দাঁড়িয়েছে।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শাহজাহানের মতো নেতাদের উপর স্থানীয় মানুষজন নির্ভর করে। নেতার বিরুদ্ধে তদন্ত হলে তাদেরও সমস্যা হবে, এটা মনে করে জনতা আক্রমণ করে। আর সংখ্যালঘুদের এই কাজে রাজনীতির বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যেহেতু তারা অন্যান্য গোষ্ঠীর থেকে আগের মতোই পিছিয়ে আছে।''