ইসলামি জঙ্গিদের হাতে ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যার এক বছর পূর্ণ হচ্ছে ২৬ ফেব্রুয়ারি৷ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রায়, ছিলেন সাহসী মানুষ, যাঁর স্মৃতি আমাদের বাঁচিয়ে রাখা উচিত বলে মনে করেন ডিডাব্লিউর গ্রেহেম লুকাস৷
বিজ্ঞাপন
মুক্তমনা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ব্লগ যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, নাস্তিকতা, বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে স্বাধীনভাবে লেখালেখি করা যায়৷ এটি আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনি অনন্য এক প্রয়াস৷ মুক্ত সমাজ গঠনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করতেন রায়৷ তাঁর বিশ্বাস ছিল, মুক্তমনা ব্লগ হবে এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামির বিষয়গুলো প্রকাশ করা হবে৷ ২০০৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে রায় বলেছিলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য এমন এক সমাজ গড়ে তোলা যেটি স্বেচ্ছাচারিতা, কুসংস্কার আর গোঁড়ামি দ্বারা নয়, পরিচালিত হবে যুক্তি, মানবতা, সমতা আর বিজ্ঞান দিয়ে৷''
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
রায় জন্মেছিলেন এক হিন্দু পরিবারে৷ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে এটি সংখ্যালঘুদের ধর্ম যারা এখনও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন৷ ছাত্র অবস্থায় রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন৷ রবি ঠাকুরের লেখাই তাঁকে সত্য সন্ধানে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিনির্ভর তথ্যের ব্যবহার করতে শিখিয়েছে৷ পরবর্তীতে অ্যামেরিকান দার্শনিক ও নাস্তিক পল কুর্টজ দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি৷
বাংলাদেশের অনেক মুসলমান মনে করেন, ইসলামের সমালোচনা করা ব্লাসফেমি, আর এর শাস্তি মৃত্যু৷ সে কারণে ২০০৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করা রায় হত্যার হুমকি পেতে শুরু করেন৷ পরের বছরগুলোতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে৷
যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৩ সাল থেকে শীর্ষ ইসলামি নেতাদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এর পরিণতিতে ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হয়৷ তিনিও মুক্তমনা ব্লগে লিখতেন৷ ইসলামি জঙ্গিরা ইন্টারনেটে ৮৪ জন ব্লগারের একটি তালিকা প্রকাশ করে, যাদেরকে তারা হত্যা করতে চায়৷ তালিকায় অভিজিতের নামও ছিল৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনের (কয়েকটি দল যেটি বয়কট করেছিল) মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়৷
মুক্তমনা ব্লগের অন্যতম মডারেটর ফরিদ আহমেদ ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান'কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অভিজিৎ যখন ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বৃদ্ধ মা'কে দেখার জন্য বাংলাদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করে তখনই তাঁকে প্রাণের হুমকির ব্যাপারে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল৷ কিন্তু অভিজিৎ রায় শোনেননি৷ তিনি বলেছিলেন, তিনি নীরবে যাবেন৷ কিন্তু তাঁর একমাত্র ভুল ছিল তিনি বইমেলায় গিয়েছিলেন৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি রায়ের ওপর হামলা করে ইসলামি জঙ্গিরা৷ তাঁর স্ত্রীও মারাত্মকভাবে আহত হন৷ রায় প্রাণ দিয়ে তাঁর সাহসের মূল্য দেন৷
২০১৫ সালের বাকি সময়টায় আরও তিন ব্লগার ও এক প্রকাশককে হত্যা করে ইসলামি জঙ্গিরা৷ এ ধরণের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না৷ ব্লগারদের রক্ষায় সরকার কিছু করেনি৷ বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রসার এবং গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে অভিজিৎ রায় ও মুক্তমনা ব্লগের ব্লগাররা যে অবদান রেখেছেন সরকার তার স্বীকৃতি দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না৷ হয়ত সরকার তা বিবেচনাতেই নিচ্ছেনা৷ কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট, যারা বাকস্বাধীনতার সমর্থক, তাঁদের হৃদয়ে অভিজিৎ বেঁচে থাকবেন চিরদিন৷
বন্ধু, আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? জানান নীচের ঘরে৷