বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের একটা অভিনব উপায় বের করেছেন আফ্রিকার দেশ আইভরি কোস্টের একদল গবেষক৷ তারা গ্রামবাসীদের নিয়ে সমিতি করেছেন৷ সমিতির আয়ের ব্যবস্থা করেছেন৷ সেই আয় বন ও মানুষ উভয়ের কাজে লাগাচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
মোনিইউ ইয়াইয়া কুলিবালি ও তার গবেষক দল প্রতি মাসেই তানো-এ-এহি জঙ্গলে পশুপাখি পর্যবেক্ষণে যান৷
একটা সময় শিকারী ছিলেন তিনি৷ তার সহজাত ধারণা তাকে সাহায্য করত৷ এখন অবশ্য তিনি প্রাণী সুরক্ষায় কাজ করেন৷ বিশেষ করে বানরদের জন্য৷ পর্যবেক্ষণ মিশনগুলোতে এ অঞ্চল সম্পর্কে তার জ্ঞান তাকে সাহায্য করে৷
আইভোরি কোস্টের দক্ষিণ-পূর্বে তানো-এ-এহি বনে ছয়টি ভিন্ন প্রজাতির বানর বাস করে৷ তাদের মধ্যে রয়েছে রোলোওয়ে - এক বিপন্ন প্রজাতির বানর, যা শুধু এখানেই দেখা যায়৷
গেল 50 বছরে, আইভোরি কোস্ট ৮০ ভাগেরও বেশি বনভূমি হারিয়েছে চোরাশিকার ও মনোকালচারের কারণে৷
তবে গহীন হবার কারণে তানো-এ-এহি জঙ্গল এখনো টিকে আছে৷ এর চারপাশে জলাভূমি৷ তাই বছরের একটা বড় অংশ জুড়ে এখানে ঢোকা কঠিন৷ এই ১২ হাজার হেক্টর এলাকা এখনো বিপন্ন স্তন্যপায়ীদের অভয়ারণ্য৷
সমিতির মাধ্যমে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ
04:22
সুইস সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চ পর্যবেক্ষণের জন্য এই বৈজ্ঞানিক মিশনগুলোর উদ্যোগ নিয়েছে৷ তাদের কাজ বন সংরক্ষণ এবং পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ৷ গবেষক ড. কফি জাহা আন্দ্রের ভাষায়, ‘‘বনের কোন এলাকার সংরক্ষণে আরও মনোযোগী হতে হবে, তা বায়ো-মনিটরিংয়ের মাধ্যমে জানা সম্ভব৷ কারণ, কোথাও প্রাণীরা বেশি থাকে, কোথাও মানুষের কর্মকাণ্ড বেশি৷''
গবেষকরা স্থানীয় গ্রামে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করেন৷
যেমন এখানে, তারা একটি নতুন, উচ্চ ফলনশীল জাতের কাসাভা রোপণ শেখাচ্ছেন৷ কারণ গ্রামবাসীদের উপার্জনের যথেষ্ট উপাদান থাকলে তারা বনে সম্পদ খুঁজতে যাবেন না৷
স্থানীয় নারীদের একটি দল একটি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন উদ্যোগে যোগ দিতে সম্মত হয়েছেন৷ স্থানীয় কৃষক নিয়ামকে আদজোবা বলেন, ‘‘কাসাভা বিক্রি করে আমার যে লাভ হয় তা আমি সমিতির তহবিলে রাখি৷ যদি বন সংরক্ষণের কাজে অর্থ প্রয়োজন হয়, বা যদি কেউ অসুস্থ হয়, আমরা এখান থেকে টাকা তুলি৷ তাই এটি বন ও মানুষ উভয়ের কাজে লাগে৷''
আয়ের ১০ ভাগ বন সুরক্ষায় নিয়োজিত মনিটরিং দলগুলিকে দেয়ার জন্য রাখা হয়৷ গবেষকরা ১১টি গ্রামের মানুষকে এই প্রকল্পে যোগ দিতে রাজি করিয়েছেন৷
আদনানের ক্যামেরায় বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী
বাংলাদেশের বিভিন্ন বনে-জঙ্গলে দেখা যায় নানান বন্যপ্রাণী৷ বাংলাদেশের ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার আদনান আজাদ আসিফের তোলা চমৎকার কিছু আলোকচিত্র নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: Adnan Azad Asif
চিতা বিড়াল
চিতা বিড়ালের ইংরেজি নাম লেপার্ড ক্যাট৷ ছেলে ও মেয়ে বিড়ালের মধ্যে চেহারায় কিছুটা ভিন্নতা আছে৷এরা গভীর বনের বাসিন্দা৷ এরা শিকারে পটু৷ এদেরকে চিতা বাঘের রেপ্লিকাও বলা হয়৷
ছবি: Adnan Azad Asif
মুখপোড়া হনুমান
ক্যাপড লেঙ্গুর বা মুখপোড়া হনুমানের ছবিটি হবিগঞ্জের সাতছরি জাতীয় উদ্যান থেকে তোলা৷ লালা হনুমান নামেও পরিচিত এরা৷ বর্তমানে সারা বিশ্বেই এই প্রজাতিটির অস্তিত্ব বিপন্ন৷ একটি পুরুষের নেতৃত্বে দলের সব স্ত্রী, যুবক ও বাচ্চারা থাকে৷ এরা খুবই শান্তিপ্রিয়৷দলবদ্ধ এই প্রাণীদের একেকটি দলে সচরাচর ২ থেকে ১৪টি প্রাণী থাকে৷ এরা মূলত পাতাভোজী৷
ছবি: Adnan Azad Asif
উল্লুক
হুলক গিবন বা উল্লুক৷ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছে প্রাণীটি৷ পুরুষদের গায়ের রং কালো, কিন্তু দর্শনীয় সাদা ভ্রু রয়েছে৷ অন্যদিকে মেয়ে উল্লুকের সারা গায়ে আছে ধূসর-বাদামী লোম৷ ছবিটি তোলা হয়েছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে৷
ছবি: Adnan Azad Asif
মেছোবাঘ
ফিশিং ক্যাট বা মেছোবাঘের এ ছবিটি মৌলভী বাজারের হাইল হাওড় থেকে তোলা৷ এরা সাধারণত নদী ও পাহাড়ি ছড়া ও জলাভূমির পাশে বাস করে৷ বাংলাদেশের বিপন্ন প্রজাতির এ প্রাণীটি রাতেই শিকার করে৷
ছবি: Adnan Azad Asif
বন বিড়াল
বন বিড়ালের ইংরেজি নাম ‘জাঙ্গল ক্যাট’৷ এরা জংলি বিড়াল নামেও পরিচিত৷ দিনে এদের দেখা যায় না বললেই চলে৷ এরা সাধারনত ছোট ছোট প্রাণী ও পাখি শিকার করে খায়৷
ছবি: Adnan Azad Asif
চশমাপরা হনুমান
ফেরে’স লিফ মাঙ্কির বাংলা নাম চশমাপরা হনুমান৷ কালো হনুমান নামেও এটি পরিচিত৷ চোখের চারপাশের লোম সাদা রঙের হয়ে থাকে বলেই মনে হয় চশমা পরে আছে৷ অন্যান্য প্রজাতির হনুমানের চেয়ে এরা কিছুটা লাজুক প্রকৃতির৷ ছবিটি তোলা হয়েছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে৷
ছবি: Adnan Azad Asif
এশীয় তাল খাটাশ
এশিয়ান পাম সিভেট বা এশীয় তাল খাটাশ৷ এদের নামও ঠাঁই পেয়েছে পৃথিবীর বিপন্ন প্রাণীর তালিকায়৷ ছবিটি হবিগঞ্জের কালেংগা সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে তোলা৷ খাটাশের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এরাই মানুষের বেশি কাছাকাছি থাকে৷ এরা মূলত ফলখেকো হলেও কীটপতঙ্গ, শামুক, ডিম, বাচ্চা-পাখি, ছোট প্রাণী, তাল-খেজুরের রসও খায়৷
ছবি: Adnan Azad Asif
দেশি সজারু
ইন্ডিয়ান ক্রেস্টেড পোরকুপিন মূলত দেশি সজারু নামেই পরিচিত৷ নিরামিষভোজী জীব হিসেবে এটি পাতা, ঘাস, ফলমূল, শস্য, গাছের শিকড় ছোট ছোট গাছপালা খেয়ে জীবনধারণ করে৷ ছবিটি তোলা হয়েছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে৷
ছবি: Adnan Azad Asif
মায়া হরিণ
মায়া হরিণের ইংরেজি নাম বার্কিং ডিয়ার৷ সর্বভূক এ প্রাণীটি গভীর বনে একাকী চলাফেরা করতে পছন্দ করে৷ ঘাস- লতাপতা ছাড়াও পাখির ডিম, এমনকি ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণীও মায়া হরিণের প্রিয় খাদ্য৷ সামান্য শব্দ পেলেই এরা পালিয়ে যায় বলে এদের দেখা পাওয়া খুবই কঠিন৷ ছবিটি তোলা হয়েছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে৷
ছবি: Adnan Azad Asif
লজ্জাবতী বানর
লজ্জাবতী বানরের ইংরেজি নাম বেঙ্গল স্লো লরিস৷ নিশাচর এ প্রাণিটি সাধারণত গাছের উঁচু ডালে থাকতে পছন্দ করে৷ দিনে গাছের ডালে বা গাছের গর্তে পায়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে বলের মতো হয়ে থাকে৷
ছবি: Adnan Azad Asif
কুলু বানর
নর্দার্ন পিগ টেইলড ম্যাকেক বা উল্টোলেজী বানর৷ কুলু বানর নামেও পরিচিত৷ পুরুষ কুলু বানর বেশ রাগী হয়, স্ত্রী বানর তুলনামূলকভাবে শান্ত৷ ফল, মূল, কচি পাতা, কুঁড়ি, কীটপতঙ্গ, কাঁকড়া, পাখির বাচ্চা ইত্যাদি খেয়ে থাকে৷ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে তোলা ছবিটি৷
ছবি: Adnan Azad Asif
চিত্রা হরিণ
স্পটেড ডিয়ার বা চিত্রা হরিণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সুন্দরবনে৷ আদনান এ ছবিটি সুন্দরবনেই তুলেছেন৷
ছবি: Adnan Azad Asif
রেসাস বানর
রেসাস ম্যাকেক-এর বাংলা নাম রেসাস বানর৷ বাংলাদেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে এদের প্রচুর দেখা যায়৷ এরা সাধারণত গাছের ডালে বিচরণ করে থাকে৷ এছাড়া মানুষের কাছাকাছি থাকতেও পছন্দ করে এরা৷ ছবিটি তোলা হয়েছে সুন্দরবন থেকে৷
ছবি: Adnan Azad Asif
লোনা পানির কুমির
সল্ট ওয়াটার ক্রোকোডাইল বা লোনা পানির কুমির৷ উপকূলীয় এলাকার অল্প লবণাক্ত পানি ও নদীতে বসবাস করে৷ বাংলাদেশের সুন্দরবনে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ ছবিটি তোলাও সুন্দরবনে৷ সুন্দরবনের করমজলে এই প্রজাতির কুমিরের একটি প্রজনন কেন্দ্রও আছে৷
ছবি: Adnan Azad Asif
আদনান আজাদ আসিফ
পেশায় মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ নেশায় একজন বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী ও গবেষক৷ টিভি ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি সময় পেলেই ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যান বনে-জঙ্গলে৷ খুব কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করেন বন্যপ্রাণীদের জীবন৷
ছবি: Sabit Hasan
15 ছবি1 | 15
‘‘দীর্ঘমেয়াদে, স্থানীয় মানুষকেই এই কাজ চালু রাখতে হবে৷ এমনকি আমরা এখানে না থাকলেও৷ তাই পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমটি কেমন করে টেকসই করা যায়, তাই শেখাচ্ছি আমরা,'' বলেন ড. আন্দ্রে৷
১১টি গ্রাম একটিই সংরক্ষণ ও উন্নয়ন সমিতির অন্তর্গত, এবং কুলিবালি এর সভাপতি৷ নিজের ক্ষেতে আর গাছ না কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি৷ তিনি বনে কৃষিকাজের পরীক্ষা করছেন৷ কমলা, কোকো আর নারকেল গাছ বেড়ে তুলছেন৷ তার আয়ের সিংহভাগ আসে এখান থেকেই৷
মোনিইউ ইয়াইয়া কুলিবালির ভাষায়, ‘‘আমি এভাবেই অবসরে যাচ্ছি৷ আমি যখন থাকব না, তখন আমার ছেলেমেয়েরা দেখবে যে তাদের বাবা ভালো কিছু করে গেছে এবং তারাও শিকারী হবে না৷ শিকারী হয়ে কতটাই বা খাবার জোটে?''
গ্রামবাসী আর গবেষক দল মিলে বনটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করার জন্য আবেদন করেছেন৷ এখন তারা কেবল রাষ্ট্রপতির আদেশের অপেক্ষায়৷