জার্মানির কথাই বলছি৷ এখানে আসার পর প্রথম দশ বছর দেখেছিলাম একটি দেশ, তার দু'টি ভাগ, সেই দুই ভাগের দু'রকম মতাদর্শ, রাজনীতি, অর্থনীতি৷ পরে অদ্ভুত তাড়াতাড়ি তা বদলে গেল...৷
বিজ্ঞাপন
কথা হচ্ছিল জার্মান পুনর্মিলন নিয়ে৷ তাহলে একটু খুলে বলি...
বন থেকে ট্রেনে ওয়ারশ গেছিলাম আমার গিন্নির এক প্রবীণ আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে৷ পশ্চিম জার্মানি যখন এফআরজি ছিল, আর পূর্ব জার্মানি জিডিআর, সে আমলের কথা৷ জার্মানির তখন যে দশা, অর্থাৎ বিভাজন, তা তখন ইউরোপেরও ছিল৷ ভালো বাংলায় বলা হতো লৌহ যবনিকা৷ সেই যবনিকার এপারে আর ওপারে আকাশপাতাল তফাৎ৷
যে প্রাচীর মানুষে-মানুষে বিভাজন সৃষ্টি করে
শরণার্থীদের দূরে রাখতে হাঙ্গেরি ইউরোপের দক্ষিণে কাঁটাতারের বেড়া গড়ে তুলেছে৷ তবে মানুষে-মানুষে বিভাজন সৃষ্টি করতে প্রাচীর গড়ার দৃষ্টান্তের অভাব নেই৷ বার্লিন থেকে শুরু করে পশ্চিম তীর – যুগে যুগে এমন উদ্যোগ দেখা গেছে৷
ছবি: dapd
পূর্ব-পশ্চিম জার্মানি
১৯৬১ সালের ১৩ই আগস্ট তৎকালীন পূর্ব জার্মানি বার্লিন প্রাচীর তৈরির কাজ শুরু করে৷ ১৯৬১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ লক্ষ পূর্ব জার্মান নাগরিক পশ্চিমে পালিয়ে যায়৷ কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ভয় ছিল, এমনটা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে৷ ১৯৮৯ সালের ৯ই নভেম্বর সেই প্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মরক্কো-স্পেন
আফ্রিকার ভূখণ্ডে এক টুকরো ইউরোপ শরণার্থীদের যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে৷ মরক্কো উপকূলে স্পেন নিয়ন্ত্রিত দুই ছিটমহল সেউটা ও মেলিয়া-কে ১৯৯৩ সালে কার্যত দুর্গে পরিণত করা হয়৷ ৬ মিটার উঁচু কাঁটাতারের বেড়া আফ্রিকার শরণার্থীদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে দূরে রাখবে – এটাই ছিল উদ্দেশ্য৷
ছবি: Marco Di Lauro/Getty Images
গ্রিস-তুরস্ক
শরণার্থীদের দূরে রাখতে গ্রিস ২০১৩ সালে তুরস্ক সীমান্তে প্রায় ১০ কিলোমিটার জুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়ানের বহির্সীমা মজবুত করতে সে দেশের সরকার সীমান্তবর্তী এক নদীর উপরেও টহলদারি বাড়িয়ে দেয়৷
ছবি: dapd
ইরান-পাকিস্তান
বেআইনি অনুপ্রবেশ ও চোরাচালান বন্ধ করতে ইরানের সরকার ২০০৭ সাল থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাকিস্তান সীমান্তে বেড়া তৈরির কাজ শুরু করে৷
ছবি: IRNA
ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন
সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধ করতে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ২০০৩ সাল থেকে পশ্চিম তীরের সীমান্তে প্রায় ৮ মিটার উঁচু প্রাচীর নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷ এ ভাবে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সীমা আগেভাগেই স্থির করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শোনা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Xinhua /Landov
ভারত-বাংলাদেশ
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের কিছু অংশেও কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে৷ কিন্তু ফেলানির মর্মান্তিক মৃত্যুর মতো ঘটনা এমন প্রাচীরের অমানবিক দিকও তুলে ধরে৷ তা সত্ত্বেও প্রায় চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের বাকি অংশেও কাঁটাতারের বেড়া লাগানো এবং নদীনালা বা জলাভূমির উপরেও বিশেষ বেড়া লাগানোর উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে৷
ছবি: Str/AFP/Getty Images
ভারত-পাকিস্তান
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা কোনোকালই দূর হয় না, শুধু বাড়ে বা কমে৷ বিশেষ করে বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ছোটবড় সংঘর্ষ লেগেই আছে৷ বিপুল সেনা তৎপরতার মধ্যে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই সীমান্ত পেরোনোর সুযোগ নেই বললেই চলে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/C. Anand
7 ছবি1 | 7
কমিউনিস্ট দুনিয়ায় সন্দেহ বাতিকটা যে একটু বেশি প্রবল, তা চেকোস্লোভাকিয়ায় কূটনীতিক হিসেবে কাজ করার সময় থেকেই জানতাম৷ চেকরাও তখন কমিউনিস্ট, সেই সঙ্গে স্লোভাকরাও, তবে ব্রাতিস্লাভা না গেলে তাদের দেখা পাওয়া যেত না....যাই হোক, প্রাগ-এই শুনেছিলাম, যদি কট্টর কমিউনিস্ট কোথাও পাওয়া যায়, তবে পূর্ব জার্মানিতে৷ বলতে কি, ভোপো-র পুলিশ ট্রেনে উঠে পশ্চিম থেকে আসা প্রতিটি যাত্রীর কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখছিল৷ আমি আবার ভারতীয়, সাথে ভারতীয় পাসপোর্ট৷ কাজেই মানিব্যাগ খুলে দেখাতে হল, তা-তে কী আছে: প্রতিটি নোট, প্রতিটি কাগজ৷
বাইরে তখন কয়শোজ-গুলোর বিরাট বিরাট দিগন্তবিস্তারী গম কিংবা অন্য কোনো ফসলের খেত৷ মাঝেমধ্যে পুরনো রেলপুলের তলায় এক ঝলক ধুলিধূসরিত, বা কালিঝুলি মাখা কোনো গ্রাম; বাড়িগুলো যেন দু-দু'টো বিশ্বযুদ্ধ সবে সামলে উঠেছে, এখনো ঘা শুকোয়নি৷ এমন মলিন, বিষণ্ণ জনপদ যে থাকতে পারে – তা-ও আবার একটা দেশে যার নামের মধ্যে জার্মানি রয়েছে, এ আমাকে বললেও বিশ্বাস করতাম না৷ পরে যখন ওয়ারশ পৌঁছানোর আগে দেখলাম খেতের কালো মাটি খুঁড়ে আলু তোলা হচ্ছে, পাশে ধুনি জ্বলছে, তখন বুঝলাম, ইউরোপ আসলে একটি নয়, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ছবির বিভিন্ন সিন কিংবা দৃশ্য৷ আপনি যে কোন শতাব্দীতে এসে পড়েছেন, এখানে সেটা বলে দিতে হয়৷
সেই পূর্ব জার্মানিতে পরে বহুবার গেছি: বড়মেয়ে পড়ত লাইপজিগ বিশ্ববিদ্যালয়ে; পরে তো সেখানেই তার প্র্যাকটিস৷ বার্লিনে তো গেছিই, যদিও বার্লিনের কাণ্ডকারখানাই আলাদা, ঠিক সাবেক লর্ড মেয়র ভোভেরাইট যেমন বলেছিলেন: বার্লিন গরিব হলেও ‘সেক্সি'৷ আর বাকি পূর্ব জার্মানি, থুড়ি, সাবেক পূর্ব জার্মানি? একবার নয়, বেশ কয়েকবার যানজটে পড়ে মোটরওয়ে ছেড়ে গ্রামাঞ্চলের ভেতরের রাস্তা দিয়ে গেছি; প্রতিবারেই অবাক হয়েছি, জার্মানরা কিভাবে তাঁদের দেশটাকে বদলে ফেলে; এখানে দেশ পুরনো হয় না, শুধু নতুন হয়৷ পূর্ব বার্লিনের – থুড়ি, বার্লিনের পূর্বাংশে – ফ্রিডরিশহাইনে একটির পরে একটি রাস্তার বাড়িগুলোকে সারিয়ে, চুনকাম করে নতুন করে ফেলা হচ্ছে৷ কমিউনিজমের সেই কালো পর্দা আর ধোঁয়াশাটা যেন ধীরে ধীরে ঘষে তুলে ফেলে অন্ধকারে আলো আনা হচ্ছে৷
বার্লিন প্রাচীরকে ঘিরে শিল্পকর্ম
জার্মানির রাজধানী বার্লিনে গেলে বার্লিন প্রাচীর নিয়ে অনেক শিল্পকর্ম চোখে পড়বে৷ তার কয়েকটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে এই ছবিঘরে৷
ছবি: DW/Frederike Müller
‘ইস্ট সাইড গ্যালারি’
বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর ১৯৯০ সালে ২১ দেশের ১১৮ জন শিল্পীর উদ্যোগে এই গ্যালারির সৃষ্টি হয়৷ অরিজিনাল বা মূল বার্লিন প্রাচীরের প্রায় ১.৩ কিলোমিটার অংশজুড়ে থাকা এই গ্যালারিতে অনেক চিত্রকর্মের দেখা পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/Frederike Müller
রাজনৈতিক ও অবৈধ
মূল বার্লিন প্রাচীরের এই অংশটির নাম ‘হিন্টারলান্ডমাওয়ার’৷ এখানে কয়েকদিন পরপর নতুন দেয়ালচিত্র অঙ্কন করা হয়, যার বিষয় কখনও কখনও রাজনৈতিক হয়ে থাকে৷ তবে এই দেয়ালে আঁকার কাজটা কিন্তু অবৈধ৷ তাই শিল্পীদের মাঝেমধ্যে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হতে হয়৷
ছবি: DW/Frederike Müller
আশ্চর্য শিল্পকর্ম
পশ্চিম বার্লিনের সাবেক বাসিন্দা ও পূর্ব জার্মানির নাগরিকদের মধ্যে যাঁদের ভিসা বা বিশেষ ‘পাস’ ছিল, তাঁরা এই সেতু দিয়ে জার্মানির অভ্যন্তরীণ সীমানাটা পার হতেন৷ শিল্পী গাব্রিয়েল বাশ এই সেতুতে ‘গোল্ডেন ওয়েস্ট’ নামের একটি চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেছেন, যেখানে সে সময়ে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের আশা প্রতিফলিত হয়েছে৷
ছবি: DW/Frederike Müller
মাঝখানে প্রাচীর
বর্তমানের যে বার্লিন শহর, তার একেবারে মাঝখান দিয়ে বার্লিন প্রাচীর চলে গিয়েছিল৷ ১৯৯০ সালে সেখানে ‘পার্লামেন্ট অফ ট্রিস’ নামের একটি চিত্রকর্ম তৈরি করা হয়৷ মূল প্রাচীরের এই অংশে নিয়ন্ত্রণ, সংঘাত ও মুক্তি বিষয়ক নানা ছবি স্থান পেয়েছে৷
ছবি: Lars Wendt
১৫ মিটার উঁচু চিত্রকর্ম
গত শতকের আশির দশকে বার্লিন-ক্রয়েৎসব্যার্গ এলাকায় বাস করতেন শিল্পী ইয়াদেগার আসিসি৷ সে সময় বার্লিনের ছবি কেমন ছিল সেটা দেখা যাচ্ছে ১৫ মিটার উঁচু এই চিত্রকর্মে৷ এর দেখা পাওয়া যাবে বার্লিনের বিখ্যাত ‘চেকপয়েন্ট চার্লি’ এলাকায়৷
ছবি: Tom Schulze
এক টুকরো বার্লিন প্রাচীর কেনা
চেকপয়েন্ট চার্লি এলাকার ‘ফ্রিডম পার্ক’ নামক স্থানে গেলে আপনি টুকরো টুকরো বার্লিন প্রাচীর দেখতে পাবেন যেগুলোর গায়ে অনেক শিল্পকর্ম রয়েছে৷ চাইলে সেগুলো কেনাও যাবে!
ছবি: DW/Frederike Müller
মানুষের অস্তিত্ব
জোনাথন বোরোফস্কি-র ‘মলিকিউল ম্যান’ নামক এই শিল্পকর্মটি স্প্রে নদীর মাঝে অবস্থিত৷ পূর্ব আর পশ্চিম জার্মানিকে আলাদা করেছিল এই নদী৷ ফলে স্প্রে নদীর মাঝে স্থাপিত ৩০ মিটার উঁচু ও ৪৫ টন ওজনের এই শিল্পকর্মটি (যেখানে তিনটি মানবদেহ পরষ্পরকে ধরে আছে) বিশেষ একটা অর্থ বহন করছে৷