এক কিশোরের মৃত্যু বহু প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে আমাদের৷ দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত এক আবাসনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল ১৭ বছরের ঐ তরুণ৷ হাসপাতালে পাঠানোর পর জানা যায়, অতিরিক্ত রক্তক্ষণের কারণেই মারা গেছে সে৷
বিজ্ঞাপন
কিশোরটির হাতের তালুতে, ঊর্ধবাহুতে এবং বাহুসন্ধিতে গভীর ক্ষত ছিল৷ ভাঙা কাচ, বা ঐ ধরনের কোনো ধারাল জিনিসের আঘাতে যে ধরনের ক্ষত হয়৷ ছড়িয়ে পড়ে দু'টি সম্ভাবনার কথা৷ হয় কেউ তাকে ভাঙা বোতল দিয়ে মারাত্মক আঘাত করেছে, যার ফলে সে মারা যায়৷ অর্থাৎ এটা খুন! অথবা, ছেলেটি নিজেই কোনোভাবে পড়ে যায় ভাঙা কাচের ওপর এবং গুরুতর চোট পায়৷ অর্থাৎ এটা দুর্ঘটনা!
কোনটা যে সত্যি, তার তদন্ত এখনও চলছে৷ সম্ভবত বেশ কিছুটা সময় লাগবে আসল ঘটনা সামনে আসতে৷ কিন্তু তার আগেই যে সব আনুষঙ্গিক তথ্য সামনে এসেছে, সেগুলো অত্যন্ত অস্বস্তিকর৷ এক কিশোরের অকালমৃত্যুর শোক ছাপিয়ে যেগুলো বৃহত্তর, গভীরতর কিছু সামাজিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ লোকে বিস্মিত, ব্যথিত, ক্ষুব্ধ, কিন্তু তার থেকেও বেশি চিন্তিত৷
সাতটি হত্যাকাণ্ড যা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, গোঁড়ামি, ঘৃণা, উচ্চাশা – এমন নানান কারণে বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ ও জনপ্রিয় ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে এমনই সাত হত্যাকাণ্ডের কথা৷
ছবি: Fotolia
জুলিয়াস সিজার
খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ রোমান সেনাপতি সিজারকে হত্যা করা হয়েছিল৷ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বেশ কয়েকজন সিনেটর৷ সিজারের মরদেহে মোট ২৩টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল৷ সিজার হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন তাঁরই পরম বন্ধু মার্কুস ব্রুটাস৷ সিজারের মৃত্যুর পর খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ সাল পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল৷
ছবি: Hulton Archive/Getty Images
ফ্রানৎস ফার্ডিনান্ড
১৯১৪ সালের ২৮ জুন সারায়েভোতে ফার্ডিনান্ডের গাড়িতে হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়৷ তিনি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী ছিলেন৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অন্যতম কারণ হিসাবে মনে করা হয় এই হত্যাকাণ্ডকে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আব্রাহাম লিংকন
১৮৬১ ও ১৮৬৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল সেটা থামাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন দেশটির ১৬তম প্রেসিডেন্ট লিংকন৷ এছাড়া তাঁর সময়েই যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের অবসান হয়েছিল৷ ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ হত্যায় প্রাণ যাওয়া প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন লিংকন৷ হত্যাকারী জন বুথ দাসত্বপ্রথা বিলুপ্তের চরম বিরোধী ছিলেন৷ ছিলেন ‘কনফেডারেসি’-র সমর্থক৷
ছবি: National Archives/Newsmakers
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’-খ্যাত মার্টিন লুথার কিংকে হত্যা করা হয় ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল৷ যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য সমান অধিকার চালুর পক্ষে সোচ্চার ছিলেন তিনি৷ এজন্য তাঁকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: William H. Alden/Evening Standard/Getty Images
জন লেনন
বিটলস খ্যাত লেনন যখন নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে তাঁর বাড়িতে ঢুকছিলেন তখন তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর এই ঘটনা ঘটে৷
ছবি: Keystone Features/Getty Images
মাহাত্মা গান্ধী
অহিংস আন্দোলনের পথিকৃত গান্ধীকে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হত্যা করা হয়৷ ১৯৩৪ সাল থেকে তাঁকে পাঁচবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল৷
ছবি: AP
জন এফ কেনেডি
১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫তম প্রেসিডেন্ট কেনেডির হত্যার খবর সারা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল৷ ডালাসে খোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত প্যারেডে অংশ নেয়ার সময় তাঁকে গুলি করেন লি হার্ভে ওসওয়াল্ড৷
ছবি: picture-alliance/dpa
7 ছবি1 | 7
প্রথমত, যে মেয়েটির জন্মদিনের পার্টিতে যাওয়ার নাম করে ওই কিশোর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, সেই মেয়েটির ঠাকুমা তিন দিন আগেই মারা গেছেন৷ তার পরেও মেয়েটির যারা বন্ধু, তারা মেয়েটির জন্মদিনে ‘সারপ্রাইজ পার্টি' দেবে বলে ওর বাড়িতে গিয়েছিল৷ মেয়েটির বাড়ি থেকে তাদের বলা হয়েছিল, এই শোকের আবহে বাড়ির মধ্যে কিছু না করে, বাইরে গিয়ে পার্টি করতে৷
প্রশ্ন উঠছে, এরা কী রকম বন্ধু যে একটি বাড়িতে শোকাবহ একটি মৃত্যুর ঘটনা জেনেও জন্মদিনে ‘পার্টি' দেওয়ার জন্য নেচে ওঠে? এবং মেয়েটির বাড়িতেই বা শোক কতটা আন্তরিক যে বাড়ির বাইরে গিয়ে পার্টি করার অনুমতি দেওয়া হয়? বাড়ির মধ্যে থাকলে শোকপালন, বাড়ির বাইরে উৎসব? এ কেমন শোক? প্রশ্ন উঠেছে৷
মানুষ হত্যায় সিদ্ধহস্ত নারীরা
‘সিরিয়াল কিলার’ জ্যাক দ্য রিপারের কথা সবাই জানেন৷ আরো অনেক কুখ্যাত খুনির কথাও শুনেছেন হয়ত৷ তবে কোনো নারী সিরিয়াল কিলার বা খুনির কথা কি শুনেছেন? ছবিঘরে থাকছে এমনই ভয়ঙ্কর পাঁচ নারীর কথা৷
ছবি: gebphotography - Fotolia.com
রক্ত দিয়ে গোসল করতেন অ্যার্জেবেত বাথোরি
হাঙ্গেরিতে ১৫৬০ সালে জন্ম, মৃত্যু ১৬১৪ সালে৷ তার গল্প শুনলে মনে হবে কোনো ভৌতিক ছবির কাহিনি শুনছেন৷ বলা হয়ে থাকে, ৫৪ বছরের জীবনে তিনি ৮০ থেকে ৬০০ জনকে খুন করেছিলেন৷ যাঁদের খুন করতেন, তাঁদের রক্ত দিয়ে গোসলও করতেন অ্যার্জেবেত বাথোরি৷ ভয়ঙ্কর খুনি হিসেবে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম আছে তাঁর৷
টাকা আর সম্পত্তির লোভে খুন করতেন বেল গানেস
নরওয়ের বেল গানেসের জন্ম ১৮৫৯ সালে, মৃত্যু ১৯০৮ সালে৷ ইতিহাসে ইনি ‘ব্ল্যাক উইডো’ নামে পরিচিত৷ নরওয়ের এই নারী জীবনে ৪০ জনের মতো মানুষকে হত্যা করেছেন৷ নিহতদের মধ্যে তাঁর স্বামী, পানিপ্রার্থী, বোন, এমনকি সন্তানও ছিল বলে ধারণা করা হয়৷ মূলত জীবন বিমার টাকা এবং অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার জন্যই খুন করতেন তিনি৷ খুনের সাক্ষী না রাখতে গিয়ে অনেক জনকে হত্যা করতে হয়েছে তাঁকে৷
ছবি: picture-alliance/United Archives/TopFoto
সন্তানকে বাঁচাতে তিন খুন
লিওনার্দা চিয়ানচিউলি (১৮৯৪-১৯৭০)৷ ইটালির এই নারী মাত্র তিনজনকে হত্যা করেই বিশ্বকুখ্যাত৷সন্তানকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেতে হবে শুনে ভাবনায় পড়ে যান লিওনার্দা৷ সন্তানকে যুদ্ধ থেকে দূরে রেখে বাঁচানোর একটা উপায়ই এলো মাথায়৷ লিওনার্দা ভাবলেন, সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে অন্যের প্রাণ উৎসর্গ করলে ছেলেকে বাঁচানো যাবে৷ তারপর একে একে তিনজন মধ্যবয়সি নারীকে হত্যা করলেন লিওনার্দা৷
কুস্তিগির থেকে সিরিয়াল কিলার
মেক্সিকোর হুয়ানা বারাথা৷ জন্ম ১৯৫৭ সালে৷ ছিলেন পেশাদার কুস্তিগির৷ তবে মানুষ হত্যায় নেমে সেই পরিচয় প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছেন৷ হুয়ানাকে এখন ঠান্ডা মাথার সিরিয়াল কিলার হিসেবেই চেনে সবাই৷ কমপক্ষে ১১ জনকে খুন করেছেন৷ আরো ৪৯ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পেছনেও তাঁর হাত আছে বলে সন্দেহ করা হয়৷ ১১ জনকে খুন করার জন্য ৭৫৯ বছরের জেল হয়েছে হুয়ানার৷ এখনো জেলেই আছেন হুয়ানা৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Deolarte
ধর্ষকামীদের হত্যা?
যুক্তরাষ্ট্রের আয়েলিন ক্যারল ওয়ারনোস ১৯৮৯ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে সাতজনকে খুন করেছিলেন৷ আয়েলিনের দাবি, ওই সাতজন পতিতা হিসেবে কাজ করার সময় তাঁকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, আত্মরক্ষার্থে হত্যা করতে হয় তাদের৷এ দাবির সত্যতা প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ফ্লোরিডার আদালত৷ তাঁর জীবনকাহিনী নিয়ে টিভি সিরিয়াল, পূর্ণ দৈর্ঘ ছবিও হয়েছে৷ ‘মনস্টার’ ছবিতে আয়েলিনের চরিত্র রূপায়ন করে অস্কার জেতেন শার্লিজ থেরন৷
ছবি: Getty Images/Florida DOC
5 ছবি1 | 5
বাড়ির বাইরে জন্মদিন পালন করতে সবাই মিলে গিয়েছিল কাছের একটি উচ্চকোটির ক্লাবে৷ সেখানে অনেকেই মদ্যপান করেছিল, যাদের মধ্যে এই কিশোরও ছিল৷ প্রশ্ন উঠেছে, জন্মদিনের পার্টি করতে বিত্তবানের ক্লাবে যায় যে ১৭/১৮ বছরের ছেলে-মেয়েরা, তাদের আর্থিক সামর্থ ঠিক কত? সেই অর্থ কারা জোগায় তাদের? বাবা-মায়েরা? তা হলে ঠিক কীভাবে তাঁরা মানুষ করতে চাইছেন সন্তানদের? নাকি বাড়িতে, সংসার এবং সন্তানদের নিজেরা যথেষ্ট সময় দিতে পারছেন না বলেই মাত্রাতিরিক্ত পকেট খরচ দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে চাইছেন? অর্থ দিয়ে ঢাকতে চাইছেন নিজেদের অপরাধবোধ? সেই অর্থে ছেলে-মেয়েরা ক্লাব সংস্কৃতির বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে৷ কৈশোরেই তাদের আসক্তি হচ্ছে মদ্যপান এবং অন্যান্য নেশায়৷ অপরিণত বয়সে এবং অপরিণত মাথায় সেই নেশা থেকে খুন অথবা দুর্ঘটনা ঘটার দায় তা হলে কে নেবে?
আর এ সবের বাইরে যে প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে, সেটা আরও অস্বস্তিকর৷ দল বেঁধে মেয়েটির বাড়িতে আসা, সেখান থেকে ক্লাবে যাওয়া, খানাপিনা, ফের ওই আবাসনে ফিরে আসা — সব সময় ঐ কিশোর ছিল বন্ধুদের সঙ্গে৷ অথচ যে মুহূর্তে সে দুর্ঘটনায় পড়ল, অথবা মতান্তরে বন্ধুদেরই কারও হাতে আক্রান্ত হলো, তখন তার পাশে আর কেউ থাকল না৷ যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে সে এসেছিল, সে পালালো সবার আগে৷ তার পরে বাকিরাও৷ আহত, রক্তাক্ত শরীরে ছেলেটি পড়ে ছিল একা৷ কেউ তাকে সাহায্য করার ছিল না৷ প্রশ্ন হলো, এ কেমন বন্ধু, যে আরেক বন্ধুকে বিপদের মধ্যে ছেড়ে পালিয়ে যায়? এ কৈশোরই বা কেমন, যা আক্রান্ত, অসুস্থ, আহত, অসহায়কে সাহায্য করতে শেখায় না! যে বয়সে ছেলে-মেয়েরা অপরিচিত, অনাত্মীয়ের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, সেই বয়সের ধর্মও কি এদের চেতনায় নেই? রক্তে নেই সেই জোশ, যা নিজের কথা ভুলে আগে অন্যের কথা ভাবতে প্ররোচিত করে? আর বন্ধুত্ব, যা জীবনের সবথেকে নিঃস্বার্থ, আন্তরিক এবং পারস্পরিক সম্পর্ক, তার মর্যাদা দিতেও শেখেনি এরা?
আর এ সবের মধ্যে থেকেও উঠে আসছে সেই অমোঘ প্রশ্ন — এ কোন নির্মম ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা?
বন্ধু, সত্যি কি আমরা এক নির্মম ভবিষ্য়তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি? লিখুন নীচের ঘরে৷