পাসপোর্ট না দিলে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি দিয়েছে সৌদি আরব৷ সৌদি কর্মকর্তারা মনে করেন, বিষয়টির সঙ্গে সৌদি প্রবাসী ২২ লাখ বাংলাদেশির ভাগ্যও জড়িয়ে যেতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ছিলেন এমন প্রমাণ দেখাতে পারলে পাসপোর্ট দেয়া যেতে পারে৷ পাশাপাশি সৌদি আরবকে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও বলেছেন তিনি৷
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেন,‘‘সৌদি আরব তো জানে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক৷ তাই স্বাভাকিভাবেই তাদের মিয়ানমারকে বলা উচিত৷ আমরা সৌদি আরবকে বলেছি. তোমরা আগে মিয়ানমারকে বলো৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘৩০-৪০ বছর আগে সৌদি বাদশাহ যখন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয় তখন অনেক রোহিঙ্গা সেখানে যায়৷ তখন অনেকের পাসপোর্ট ছিল না৷ তারা ছিল রাষ্ট্রহীন নাগরিক৷ তখন বলেছে, ওদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দাও৷ এখন ওদের আগে পাসপোর্ট দেয়ার কোনো প্রমাণ যদি কেউ দেখাতে পারে তাহলে আমরা পাসপোর্ট ইস্যু করবো৷ তবে তারা (সৌদি আরব) বলেছে, পাসপোর্ট ইস্যুর অর্থ এই নয় যে, তাদের আমরা বিতাড়িত করবো৷ যেহেতু আমরা কোনো স্টেটলেস লোক রাখি না, সেইজন্য তাদের পাসপোর্ট দরকার৷ এই অবস্থায় আমাদের আলোচনা হচ্ছে৷’’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ নিয়ে পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি হয়েছে৷ তারা বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন৷ জানা গেছে, সৌদি আরবে যেসব রোহিঙ্গার হাতে বাংলাদেশি এমআরপি পাসপোর্ট আছে তাদের পাসপোর্ট দেয়া হতে পারে, তবে অন্যদের নয়৷ তাদের পাসপোর্ট দেয়া হলেও বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে না দিয়ে কোনো বিশেষ ধরনের পাসপোর্ট দেয়া হতে পারে৷ কতজন রোহিঙ্গার হাতে এই এমআরপি পাসপোর্ট আছে সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি৷
এটা তাদের একটা অন্যায় আবদার: অধ্যাপক সি আর আবরার
এই পাসপোর্ট দেয়ার সঙ্গে সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশের ২২ লাখ প্রবাসীর বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে৷ এ নিয়ে আলোচনায় সৌদি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেছেন, রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট না দেয়া হলে ওই ২২ লাখের ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে৷
১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে যেসব রোহিঙ্গা সৌদি আরবে গেছেনম তাদের একটি অংশ গেছেন সরসরি মিয়ানমার থেকে৷ আরেকটি অংশ বাংলাদেশ থেকে গেছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়৷ তারা ১৯৭৭ সাল পরবর্তী সময়ে গিয়েছেন৷
সৌদি আরব গত এক বছর ধরে এ নিয়ে কথা বলছে এবং তালিকা পাঠাচ্ছে৷ তবে এবার একবারে ৫৪ হাজারের তালিকা পাঠিয়েছে তারা৷
সৌদি আরবের এই অবস্থানকে কেনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা৷ তারা মনে করেন, এ নিয়ে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানে যাওয়া উচিত৷ সৌদি আরব একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকে এই প্রস্তাব দিতে পারে না বলেও মনে করেন তারা৷
অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিচার্স ইউনিট (রামরু)-র নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘‘এটা তাদের একটা অন্যায় আবদার৷ তারা (রোহিঙ্গা) তো বিদেশি নাগরিক৷ তাদের পাসপোর্ট দিতে বলা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে৷ বাংলাদেশের উচিত তীব্র প্রতিবাদ জানানো এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া’’
বিদেশে দূতাবাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিয়েছে: সাবেক রাষ্ট্রদূত শহীদুল হক
এর সঙ্গে সৌদি আরবে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে দেয়ার শর্ত যুক্ত করাকে আরেকটি অন্যায় চাপ বলে মনে করেন তিনি৷ এক্ষেত্রেও তিনি মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশের শক্ত কূটনেতিক তৎপরতা চালানো উচিত৷’’
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক মনে করেন, এখন না বললেও যদি পাসপোর্ট দেয়া হয়, তাহলে এরপরই সৌদি আরব ওই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা তুলবে৷ তাই বাংলাদেশকে সতর্ক হয়ে আলোচনা করতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘বিদেশে আমাদের দূতাবাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিয়েছে৷ এটা আমি লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত থাকার সময়ও দেখেছি৷ সেখানেও রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট৷ আমি সৌদি আরবে গিয়েও একই পরিস্থিতি দেখেছি৷’’
তার মতে, বাংলাদেশকে এখন ‘টেকনিক্যাল’ হতে হবে৷ পাসপোর্টের পুলিশ ভ্যারিফিকেশনে যদি সতর্ক এবং স্বচ্ছ অবস্থান নেয়া যায় তাহলে ওই রোহিঙ্গাদের কোনোভাবেই নতুন করে পাসপোর্ট পাওয়ার কথা নয়৷ কারণ, তারা বাংলাদেশে তাদের কোনো স্থায়ী ঠিকানা এবং এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেখাতে পারবে না৷
তিনি মনে করেন, সৌদি এই তৎপরতার পিছনে কোনো বাংলাদেশি থাকতে পারে৷ আবার যেসব রোহিঙ্গা নারী সৌদি নাগরিকদের বিয়ে করেছেন, তারাও প্রভাব বিস্তার করতে পারে৷
যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি
প্রতি বছরই বাংলাদেশিরা কাজ নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে৷ বৈধপথে বিদেশে যাওয়া এসব প্রবাসীর হিসাব রাখে সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি৷
ছবি: DW
এক কোটি প্রবাসী
বাংলাদেশের ঠিক কতজন নাগরিক প্রবাসে আছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ বিএমইটি-র হিসাবে ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তবে কতজন ফিরে এসেছেন সেই পরিসংখ্যান নেই সেখানে৷
ছবি: Positive light
১৪ লাখ কোটি টাকা
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের আয়৷ এর কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভের অঙ্কটাও এখন বেশ শক্তিশালী৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে মাত্র ২৪ লাখ ডলার বা প্রায় ৩৬ কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে৷ সেই তুলনায় রেমিটেন্স অনেক বেড়েছে৷ শুধু গত বছরই এসেছে ১৮৩৫ কোটি ডলার বা এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা৷ সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার বা ১৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা৷
ছবি: AFP
এক তৃতীয়াংশ সৌদি আরবে
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর গন্তব্য সৌদি আরব, যেখানে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ৪১ লাখ ৮৪ হাজার বাংলাদেশি পাড়ি জমিয়েছেন৷ ১৯৭৬ সালে মাত্র ২১৭ জন দিয়ে এই শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু৷ ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৫১ হাজার কাজ নিয়ে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে৷ আর চলতি মে পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছেন এক লাখ ৩৪ হাজার জন৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
আরব আমিরাতের মন্দা বাজার
শুরুর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতই ছিল বাংলাদেশের বড় বাজার৷ ২০০৮ সালে দেশটিতে একবছরে সবচেয়ে বেশি ৪ লাখ ১৯ হাজার জন বাংলাদেশি গেছেন৷ তবে ২০১৩ সালের পর থেকে এই বাজারটিতে মন্দা চলছে৷ গতবছর মাত্র তিন হাজার ৩১৮ জন দেশটিতে পাড়ি জমানোর সুযোগ পেয়েছেন৷ ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৩ লাখ ৭২ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্য ছিল আরব আমিরাত, যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ১৮ ভাগের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/J. Schwenkenbecher
পড়তিতে ওমান
প্রবাসীদের গন্তব্যের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে পারস্য উপসাগরের দেশ ওমান৷ ১৫ লাখ ১৮ হাজার বাংলাদেশি কাজ নিয়ে গেছেন সেখানে৷ তবে গত ৩ বছর ধরে এই বাজারটিতেও প্রবাসী যাওয়ার সংখ্যা কমছে৷ ২০১৬ সালে যেখানে এক লাখ ৮৮ হাজার জন ওমানে পাড়ি জমিয়েছেন, গেল বছর তা নেমে এসেছে ৭২ হাজার ৬৫৪ জনে৷ আর চলতি বছর মে পর্যন্ত গেছেন মাত্র ১৭ হাজার ৪০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/A. Farnsworth
আকর্ষণীয় মালয়েশিয়া
বাংলাদেশিদের কাছে মালয়েশিয়া আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে শুরু করে মূলত ১৯৯০ সালের পর থেকে৷ ২০০৭ সালে সেখানে সবচেয়ে বেশি ২ লাখ ৭৩ হাজার জনের বেশি শ্রমিক কাজের জন্যে গেছেন এশিয়ার দেশটিতে৷ মাঝে এই প্রবণতা কমলেও সম্প্রতি আবার বেড়েছে৷ ২০১৮ সালে দেশটিতে গেছেন প্রায় এক লাখ ৭৬ হাজার জন আর ২০১৯ এ মাত্র ৫৪৫ জন৷ সব মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে পাড়ি জমিয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশি৷
ছবি: picture-alliance/FOTOGRAMMA/M. Alberico
সম্ভাবনার কাতার
২০০৬ সাল পর্যন্তও কাতারের বাজার বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রপ্তানিতে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না৷ তবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিও এখন বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷ কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন সেখানে অনেক বাংলাদেশির জন্যেই কাজের সুযোগ তৈরি করেছে৷ এখন পর্যন্ত আট লাখ ১১ হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে কাজ নিয়ে গেছেন৷
ছবি: picture-alliance
দক্ষ শ্রমিকের বাজার সিঙ্গাপুর
দেশের দক্ষ শ্রমিকদের জন্য পছন্দের এক গন্তব্য সিঙ্গাপুর৷ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশটিতে এখন পর্যন্ত চাকরি নিয়ে ৭ লাখ ৯২ হাজার বাংলাদেশি পা রেখেছেন, যা মোট প্রবাসীর ছয় ভাগের কিছু বেশি৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ হাজার জন গেছেন ২০১৩ সালে৷
ছবি: picture-alliance/Global Travel Images
কুয়েতে ৫ ভাগ
বাংলাদেশিদের জন্য কুয়েতের মতো গুরুত্বপূর্ণ এক শ্রমবাজার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলা চলে৷ ২০০৮ থেকে ২০১৩— এই সময়ে মাত্র ৪১৪ জন দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন৷ ২০১৪ সাল থেকে তা বাড়তে শুরু করলেও গত দুই বছর ধরে আবার পড়তির দিকে৷ সব মিলিয়ে ছয় লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি গেছেন কুয়েতে, যা মোট প্রবাসীর প্রায় ৫ ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/G. Hellier
পারস্য উপসাগরের দ্বীপে
চার লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্যের দেশ বাহরাইন৷ ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৭২ হাজার মানুষ কাজ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পারস্য উপসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে৷ তবে ২০১৯ সালে গেছেন মাত্র ১৩৩ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.Al-Shaikh
ইউরোপে সর্বোচ্চ ইটালিতে
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে ইটালিতে৷ ২০০২ সাল থেকে সেখানে পাড়ি জমানোর তথ্য আছে বিএমইটির কাছে৷ সে অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫৫ হাজার বাংলাদেশি বৈধ পথে গেছেন পশ্চিম ইউরোপের দেশটিতে৷