একদিনে দুই ভোট, গুরুত্ব হারাবে গণভোট?
২১ নভেম্বর ২০২৫
এই মুহূর্তে একদিনে দু'টি ভোট করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন কতটুকু প্রস্তুত? এখনো গণভোট করার জন্য আইন সংশোধন হয়নি। তবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আইন সংশোধন হয়ে যাবে।
একদিনে দু'টি ভোট করার জন্য নির্বাচন কমিশনের সার্বিক প্রস্তুতির অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের, সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। চ্যালেঞ্জ তো আছেই। তারপরও সরকার যেহেতু চাচ্ছে, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
রাজনৈতিক নেতারা কি নিজের দলের প্রতীকের বাইরে গিয়ে গণভোটের পক্ষে প্রচারণা চালাবেন? গণভোটকে আলাদাভাবে গুরুত্ব না দিলে সাধারণ ভোটাররা কিভাবে তা বুঝবে? এই প্রসঙ্গে আখতার আহমেদ বলেন, "এটা তো সরকারের দায়িত্ব, তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। নিশ্চয়ই তারা প্রচার চালাবেন, আমরাও প্রচারণা চালাবো।”
গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আব্দুর নূর তুষার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এই সরকার জাতির সঙ্গে তামাশা করছে। এত জটিল হিসাব-নিকাশে কি গণভোট হয়? সর্বশেষ গণভোট হয়েছে ১৯৯১ সালে। তখন প্রশ্ন কী ছিল? ৪৮টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমতে পৌঁছেছে। এগুলো সাধারণ মানুষকে জানাবে কে? আর আপনি যখন বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করছেন, সেখানে কি গণভোটের বিধান আছে? নেই। তাহলে কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করে এই গণভোট অবৈধ, আপনি কী করবেন? কারণ, সংবিধানে তো এটা নেই। ফলে, যে প্রক্রিয়ায় গণভোট হচ্ছে, সেটা হওয়া বা না হওয়াতে কিছু আসে যায় না।”
একদিনে দুই ভোটের ‘চ্যালেঞ্জ' সম্পর্কে
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রচারণা। এছাড়া স্বল্প সময়ে ভোটকেন্দ্র বাড়ানো, ব্যালট প্রস্তুত, লোকবল বাড়ানোর বিষয় তো আছেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা দলীয় প্রতীকের পক্ষে প্রচারণা চালান। ফলে, দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার আবহ তৈরি হয়। তবে গণভোট নিয়ে প্রার্থীদের তেমন কোনো স্বার্থ নেই। তাই এ দায়িত্ব সরকারকে নিজের কাঁধে তুলে নিতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকেও দায়িত্ব নিতে হবে।
। এর মধ্যে নারী ভোটার গড়ে সময় পাবেন ৫৭ সেকেন্ড আর পুরুষ ভোটার পাবেন ৪৮ সেকেন্ড। একটি নারী বুথে ৫০০ আর পুরুষ বুথে ৬০০ এবং সব মিলিয়ে একটি কেন্দ্রে তিন হাজার ভোটার ভোট দেবেন - এমন হিসাব কষে এবার কেন্দ্র ও বুথবিন্যাস করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
সাধারণত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা আট ঘণ্টা ভোট গ্রহণ হয়। সে হিসাবে ৪৮০ মিনিটের মধ্যে একটি নারী বুথে ৫০০ জন এবং পুরুষ বুথে ৬০০ জনকে ভোট দিতে হবে। বিশ্লেষকরা অবশ্য ইসির এই সিদ্ধান্তকে ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন। নির্বাচন কমিশনের একাধিক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে জানান, সম্ভাব্য কেন্দ্রের যে তালিকা তারা ইসি সচিবালয়ে পাঠিয়েছিলেন, সেখানে একটি ভোট, অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে গণভোট হবে - এমন তথ্য তাদের কাছে ছিল না।
এবার ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে বুথ কমানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ এরই মধ্যে এই সিদ্ধান্তকে নিজেদের সাফল্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, প্রতিটি কেন্দ্রে বুথের সংখ্যা পুননির্ধারণের মাধ্যমে কমিশন প্রায় ১০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করবে। বুথপ্রতি ভোটার বাড়ানোর কারণে প্রায় ৪৯ হাজার ভোটকক্ষ কমানো গেছে।
নির্বাচন কমিশনের সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, ইসির মাঠ কর্মকর্তাদের প্রস্তাব আমলে নিয়েই কেন্দ্র নির্বাচনের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ৩০০ সংসদীয় আসনে কেন্দ্র ৪২ হাজার ৭৬১টি। পুরুষদের জন্য এক লাখ ১৫ হাজার ১৩৭টি এবং নারীদের জন্য এক লাখ ২৯ হাজার ৬০২টি বুথ রাখা হয়েছে, অর্থাৎ, মোট বুথ দাঁড়াচ্ছে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৯টি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্র ছিল ৪২ হাজার ১৫০টি। বুথ ছিল দুই লাখ ৬১ হাজার ৪৭২টি। ভোটের অন্তত ২৫ দিন আগে ইসি কেন্দ্রের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা তো ধারণা করেছিলাম গণভোট হওয়ার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, যাতে গণভোটের একটা আইনী ভিত্তি তৈরি হয়। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, সেটা তো ৭২-এর সংবিধান অনুযায়ী ভোট হচ্ছে। ফলে যে উদ্দেশ্যে গণভোটের আয়োজন, সেই উদ্দেশ্য ভন্ডুল হয়ে যেতে পারে। আর প্রার্থীরা কি আলাদাভাবে গণভোটের জন্য প্রচারণা চালাবেন? তা না করলে সাধারণ ভোটাররা কিভাবে বুঝবে এই গণভোটের প্রয়োজনীয়তা? আমার মনে হয়েছে এটা প্রহসনমূলক।”
গণভোটে কী প্রশ্ন থাকবে?
চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নে হবে গণভোট। গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটি প্রশ্নে ‘হ্যাঁ' বা ‘না' ভোট দিয়ে জনগণ মতামত জানাবেন। গণভোটে ‘হ্যাঁ' জয়ী হলে আগামী সংসদ হবে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর পদ্ধতি) ১০০ সদস্য নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। চারটি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হওয়া গণভোটের ব্যালটে কোন ধরনের প্রশ্ন থাকছে- এ নিয়ে প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে।
‘জুলাই সনদের আলোকে গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপনীয় প্রশ্নে' উল্লেখ করে বলা হয়, আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?
ক. নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ. সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধীদল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।
ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
সবগুলো প্রশ্নের একটি উত্তর দিতে হবে ‘হ্যাঁ বা না'। ফলে অনেক ভোটরই বিভ্রান্ত হতে পারেন বলে মনে করেন সাংবাদিক মাসুদ কামাল। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, এখানে গণভোট গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। দলগুলো নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাবেন। আর গণভোটের প্রশ্নগুলো এমন যে, সবগুলোর উত্তর একজন মানুষের কাছে এক না-ও হতে পারে। ফলে, এত জটিল হিসাব-নিকাশে না-ও যেতে পারেন ভোটাররা।
কমবে ব্যয়, সময় বাড়বে গণণায়
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট করতে গেলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ খরচ বাড়তি লাগবে। ব্যয় কমানোর জন্যই একই দিনে দুটি ভোট করা হচ্ছে বলে দাবি করেছে নির্বাচন কমিশন। এখন পর্যন্ত বড় দুটি নির্বাচন একদিনে হয়নি। প্রায় পৌনে ১৩ কোটি ভোটার। ভোটকেন্দ্র বাড়াতে হবে। ভোটকক্ষও বাড়াতে হবে। ভোট দিতে সময় লাগবে। গণনাকারী দুই রকম লাগবে। একদল জাতীয় ভোট গণনা করবে, অন্যদল গণভোট।
গণভোট সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারি ও বিধি প্রণয়ণের পরই সার্বিক বিষয়ে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যাবে। এবার সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রায় দুই হাজার ৮শ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। গণভোট একসঙ্গে করলে ব্যয় সাশ্রয় হবে বলে সংশ্লিষ্টদের অনেকেই মনে করছেন। ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। সংসদ নির্বাচনের জন্য পৌনে ১৩ কোটি ভোটার ও প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটার বিবেচনায় রেখে ব্যালট পেপার মুদ্রণের পরিকল্পনা চলছে। ৪৩ হাজার ভোটকেন্দ্রে প্রায় দুই লাখ ৪৫ হাজার ভোটকক্ষ থাকবে। ৯ থেকে ১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাত থেকে আট লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন ভোটে।
গণভোট আইন কবে?
আগামী ৩-৪ কার্যদিবসের মধ্যেই গণভোট আইন প্রণয়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। বৃহস্পতিবার ফরেন সার্ভিস একাডেমির মিলনায়তনে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, "গণভোট আইন খুব দ্রুত করা হবে, আগামী তিন-চার কার্যদিবসের মধ্যেই হয়ে যাবে।”
এর আগে গত বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, গণভোট অনুষ্ঠান কীভাবে হবে, সে বিষয়ে আগে আইন তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রেফারেন্ডামের (গণভোট) কথা আসছে। গণভোট কীভাবে করবো না করবো, তা নিয়ে তো আমাকে আগে আইনটা করতে হবে।''
এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘‘জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ গণভোট করেছিলেন মার্শাল প্রিপারেশনের আন্ডারে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একটা আইন করে করেছিলেন। গণভোট কীভাবে হবে- এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন। অনেকে এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। আইনটা হওয়ার পর এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো।''
গণভোটের প্রচার হবে কিভাবে?
গণভোটের গুরুত্ব সম্পর্কে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মানুষের মধ্যে যে সংশয় তৈরি হয়েছে তাতে গণভোট গুরুত্বহীণ হয়ে যেতে পারে, সঙ্গত কারণেই এটা হয়েছে। বিগত তিনটি নির্বাচন তরুণ ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। তারা কিন্তু চেয়েছে সরকার পরিবর্তনের জন্য যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, সেই ভোট। এই ভোটের জন্যই ক্ষোভ- বিক্ষোভ থেকে বিগত সরকারের পতন ঘটিয়েছে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ। এখন যে প্রক্রিয়ায় গণভোট হচ্ছে, সেটা একটা প্রশ্নের সৃষ্টি তো করতেই পারে?”
গণভোটের প্রচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকার এটা প্রচারণা চালাবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোও প্রচারণা চালাবে। ফলে, একদিনে দুই ভোট হওয়ার কারণে কোনোটি গুরুত্বহীণ হবে না। দু'টি ভোটেরই প্রয়োজন রয়েছে এবং যেভাবে হচ্ছে তাতে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।”
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র যুগ্ম আহবায়ক মনিরা শারমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা তো চেয়েছিলাম আগে গণভোট হোক। সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে - এই কারণে আমরা একই দিনে দুই ভোটের ব্যাপারে রাজি হয়েছি। এখন সকল রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নিজেদের প্রর্থীর পক্ষে প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি গণভোটের পক্ষেও প্রচারণা চালানো।”