নিউটন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করে গেছেন, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে৷' বাংলাদেশের আদালতে একদিনে ১৩টি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো নীরব কেন? ‘ক্রিয়া' তো এক, প্রতিক্রিয়া অন্যরকম কেন?
বিজ্ঞাপন
মানবাধিকার সংস্থার মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অববস্থান খুব যৌক্তিক এবং মানবিক৷ আধুনিক বিশ্বে অনেকটা ‘খুনের বদলা খুন'-এর মতো যুক্তিতে হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না হওয়া অবশ্যই ভালো৷ এক হত্যায় এক মায়ের বুক খালি তো হয়েছেই, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আরেক মায়ের বুক খালি করা কি ঠিক? এই ঠিক-বেঠিকের মাঝখানে এখনো বিশ্বের অধিকাংশ দেশই দাঁড়িয়ে৷ একুশ শতকে এসে হাতে গোনা কয়েকটি দেশই শুধু মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে৷
অনেক দেশে বাতিল হয়নি বলে বাংলাদেশেও হবে না – এমনটি ধরে নেয়ার কোনো মানে নেই৷ এমন দিন হয়ত আসবে যখন বাংলাদেশেও আর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থাকবে না৷ কিন্তু যতদিন আছে ততদিন তো আদালতে সর্বোচ্চ অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হবে৷ এখনো তা-ই হচ্ছে৷ কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংস্থাগুলো কেন যেন সবসময় সরব হচ্ছে না৷ শুধু মাঝে মাঝে সরব হওয়ার কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজটি কঠিনই থেকে যাচ্ছে৷
মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে যেসব দেশ
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশে এখনও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর রয়েছে৷ তবে চলতি শতকে কয়েকটি দেশ এই শাস্তি প্রথা বাতিল করেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলবেনিয়া
বাতিল: ২০০০; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৯৫
ছবি: Fotolia/Matthias Krüttgen
আর্মেনিয়া
বাতিল: ২০০৩; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৯২
ছবি: AP
ভুটান
বাতিল: ২০০৪; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৭৪
ছবি: DW
বুরুন্ডি
বাতিল: ২০০৯; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ২০০০
ছবি: picture-alliance/Philipp Ziser
চিলি
বাতিল: ২০০১; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৮৫
ছবি: picture-alliance/dpa
ফিলিপাইন
বাতিল: ২০০৬; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ২০০০
ছবি: DW/P. Hille
গ্যাবন
বাতিল: ২০১০; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৮১
ছবি: AP
কাজাখস্থান
বাতিল: ২০০৭; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ২০০৩
ছবি: picture-alliance/dpa
মাদাগাস্কার
বাতিল: ২০১৪; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৫৮
ছবি: picture alliance / blickwinkel
মন্টোনেগ্রো
বাতিল: ২০০২; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৯২
ছবি: imago/P. Widmann
সেনেগাল
বাতিল: ২০০৪; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৬৭
ছবি: Alexander Joe/AFP/Getty Images
সার্বিয়া
বাতিল: ২০০২; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৯২
ছবি: picture-alliance/dpa
টোগো
বাতিল: ২০০৯; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৭৮
ছবি: DW/J. von Mirbach
তুরস্ক
বাতিল: ২০০২; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ১৯৮৪
ছবি: Bulent Kilic/AFP/Getty Images
উজবেকিস্তান
বাতিল: ২০০৮; সবশেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর: ২০০৫
ছবি: picture-alliance/dpa
15 ছবি1 | 15
বাংলাদেশে অনেক অপরাধীর বিরুদ্ধেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত৷ এখনো দিচ্ছে৷ কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সব মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদ বা নিন্দা জানাতে দেখা যায় না৷ প্রশ্ন হলো, মৃত্যুদণ্ডই যদি সবচেয়ে বড় আপত্তির কারণ হয়ে থাকে, তাহলে প্রতিবাদ, নিন্দায় কেন ধারাবাহিকতা নেই?
প্রতিবাদ, নিন্দার ধারাবাহিকতা থাকলে আজ বিশ্বের সব দেশের সংবাদমাধ্যমে নিশ্চয়ই ছাপা হতো একটি খবর, যার শিরোনাম হতো, ‘বাংলাদেশে একদিনে ১৩টি মৃত্যুদণ্ড, মানবাধিকার সংস্থার তীব্র প্রতিবাদ৷' কিন্তু সেরকম খবর দেখছি না তো!
বাংলাদেশের পাঠকপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের খবর অনুযায়ী, বুধবার বাংলাদেশের দু'টি আদালত ১১ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে৷ খবরে জানানো হয়, ২০১১ সালে স্কুল ছাত্র হিমেল দাশ সুপনকে হত্যা করার দায়ে ৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২৷ একই দিনে রংপুরের আদালত ৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ পীরগঞ্জের এক শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীকে হত্যার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে এই রায় দেয় রংপুরের আদালত৷
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেশের তালিকা
২০১৩ সালে মোট ২২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ ছবিঘরে থাকছে সেসব কথা৷
ছবি: Fotolia/lafota
চীন
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, চীনে প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ তবে ব্যাপারটিকে যেহেতু চীনে রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয় হিসেবে দেখা হয় তাই অ্যামনেস্টির পক্ষে নির্দিষ্ট সংখ্যা জানানো সম্ভব হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইরান
তিনভাবে ইরানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় – গুলি করে, পাথর ছুড়ে আর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে৷ ২০১৩ সালে এভাবে কমপক্ষে ৩৬৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে৷ সামান্য অভিযোগে সাংবাদিক সহ মানবাধিকার কর্মীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে মাঝেমধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়ে দেশটি৷
ছবি: ISNA
ইরাক
সাদ্দাম হুসেনের আমলে ইরাকে বেশি সংখ্যায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা ঘটতো৷ ২০১৩ সালে ১৬৯ জনের বেশি বন্দিকে এই শাস্তি পেতে হয়েছে বলে জানিয়েছে অ্যামনেস্টি৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী৷
ছবি: picture alliance/dpa
সৌদি আরব
২০১৩ সালে ১৮ বছরের কম বয়সি তিনজন সহ কমপক্ষে ৭৯ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সৌদি আরব৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Abir Abdullah
যুক্তরাষ্ট্র
ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে বিষ ঢুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ এভাবে ২০১৩ সালে ৩৯ জনকে শাস্তি দেয়া হয়৷ অবশ্য সে বছর কমপক্ষে ৮০ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যদণ্ডের রায় দেয়া হয়৷
ছবি: CHANTAL VALERY/AFP/Getty Images
বাংলাদেশ ১৮ নম্বরে
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেশের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে আছে সোমালিয়ার নাম৷ ২০১৩ সালে সেদেশে ৩৪ জনের বেশি বন্দির প্রাণ নেয়া হয়৷ তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে ১৮ নম্বরে৷ অ্যামনেস্টির হিসেবে ঐ বছর বাংলাদেশে দু’জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এই ১১ বা ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলোর এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া নেই৷
অথচ বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ পর্যন্ত যে সাতজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে তাদের প্রায় প্রত্যেকের বেলায়ই প্রতিক্রিটা খুব তড়িৎ ছিল৷ কখনো কখনো মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়ায় তুমুল বিতর্ক, ব্যাপক বিক্ষোভও হয়েছে৷
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি প্রসঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতির প্রতিবাদে বাংলাদেশে বিক্ষোভ মিছিলও হয়েছে৷ গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার তখন অ্যামনেস্টিকেই ‘মানবতাবিরোধী' বলেছিলেন৷ অ্যামনেস্টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিচার দাবি করায় ইমরান ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় বোমা মেরে নারী-শিশুসহ মানুষদের হত্যা করে তখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মানবাধিকারের উদয় হয় না৷ এখন তারা মার্কিনীদের দোসর পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের মুক্তির দাবি করছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে৷ তাদের এই বিবৃতি প্রমাণ করে, অ্যামনেস্টি এখন আর কোনো মানবাধিকার সংগঠন নয়, তারা মানবতাবিরোধী সংগঠন, একটি জঙ্গিবাদী সংগঠন৷'' অ্যামনেস্টিকে ‘জঙ্গিবাদী সংগঠন' বলার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে লন্ডনে অ্যামনেস্টির প্রধান কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার বরখাস্ত হওয়ার দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছিলেন ইমরান এইচ সরকার৷
মৃত্যুদণ্ড প্রশ্নে অ্যামনেস্টিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো আবার নীরব৷ এই নীরবতার কারণ কী? প্রত্যেক ক্রিয়ার বা কাজের প্রতিক্রিয়া তো একই হওয়া উচিত৷ মৃত্যুদণ্ডের প্রশ্নে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিক্রিয়া সবসময় একরকম নয় কেন?
মানবাধিকার সংস্থাগুলির কি সব মৃত্যদণ্ডের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করা উচিত নয়? জানান নীচের ঘরে৷
বিভিন্ন দেশে যেভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের জন্য একেক দেশ একেক রকম পদ্ধতি ব্যবহার করে৷ ছবিঘরে থাকছে তেমন কয়েকটি উপায়ের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইনজেকশন
অ্যানেস্থেশিয়ার জন্য সোডিয়াম পেন্টোনাল, সম্পূর্ণ অক্ষম করার জন্য প্যানকিউরোনিয়াম ব্রোমাইড আর হৃদযন্ত্র থামিয়ে দেয়ার জন্য পটাশিয়াম ক্লোরাইড নামের তিনটি রাসায়নিক উপাদান ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢুকিয়ে অনেক দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভিয়েতনামে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: BilderBox
গুলি
ইন্দোনেশিয়া, চীন, সৌদি আরব, তাইওয়ান, উত্তর কোরিয়া সহ কয়েকটি দেশে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷ এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির চোখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে তাকে বসিয়ে বা দাঁড় করিয়ে রাখা হয়৷ এরপর সামরিক বা নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য একের পর এক গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন৷
ছবি: Fotolia/Scanrail
বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে
অভিযুক্তকে কাঠের চেয়ারে বসিয়ে তার মাথা ও পায়ের মাধ্যমে শরীরে ৫০০ থেকে ২,০০০ ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ প্রতিবার ৩০ সেকেন্ড করে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কয়েকবার এভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়৷ এই পদ্ধতিটা যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ফাঁসি
বাংলাদেশ সহ আফগানিস্তান, ভারত, ইরান, ইরাক, জাপান, মালয়েশিয়া ও কুয়েতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের প্রচলন রয়েছে৷
ছবি: vkara - Fotolia.com
শিরশ্ছেদ
কয়েক হাজার বছর ধরেই শিরশ্ছেদ বিষয়টি রয়েছে৷ তবে বর্তমানে শুধু সৌদি আরবে এই পদ্ধতিটি চালু রয়েছে৷ সাধারণত শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর মসজিদ প্রাঙ্গনে শিরশ্ছেদ করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Abir Abdullah
অন্যান্য উপায়
পাথর ছুড়ে মারা, গ্যাস চেম্বারে ফেলে দেয়া, অনেক উঁচু থেকে অভিযুক্তকে নীচে ফেলে দেয়ার মাধ্যমেও কোথাও কোথাও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷