‘যে-কোনো মুহূর্তে’ মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলার আশঙ্কা করছিল সিরিয়া৷ কিন্তু শনিবার ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যুদ্ধে যাওয়ার আগে মার্কিন কংগ্রেসের সম্মতি চাইলেন। তাই আপাতত পিছিয়ে গেল যুদ্ধ।
ছবি: picture alliance/AP Photo
বিজ্ঞাপন
এবার অপেক্ষা। প্রথমত, আগামী অধিবেশনে কংগ্রেস সিরিয়া বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়, তার ওপর। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা তাঁদের রিপোর্টে কী পান, হয়ত সেটাও দেখা দরকার।
অথচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা শুক্রবার কিন্তু মোটামুটি পরিষ্কারভাবেই সিরিয়ার উপর হামলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন৷ ফলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর সিরিয়ায় হামলার বিষয়টি ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিরিয়ার নিরাপত্তা কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, ‘‘আমরা যে-কোনো মুহূর্তে হামলা প্রত্যাশা করছি৷ আর আমরা যে-কোনো মুহূর্তে হামলার জবাব দিতেও প্রস্তুত৷''
জাতিসংঘের পরিদর্শকরা সিরিয়া ছেড়ে গেছেনছবি: picture-alliance/dpa
ওকে সেল্সট্রমের নেতৃত্বাধীন ১৩ সদস্যের জাতিসংঘ পরিদর্শক দল শুক্রবারই দামেস্ক ত্যাগ করেন৷ সড়ক পথে লেবাননে পৌঁছে গেছেন তাঁরা৷ একুশে আগস্ট আসলেই বিষাক্ত গ্যাস হামলা হয়েছিল কিনা তা নির্ধারণে ব্যাপক চেষ্টা করেছে এই দল৷ পরিদর্শকরা সরাসরি জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনকে তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করবেন৷
ওবামা প্রশাসন অবশ্য জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দলের প্রতিবেদনের ওপর ভরসা করে নেই৷ নিজেদের গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে সেদেশ জানিয়েছে, গ্যাস হামলার পেছনে সরকারি বাহিনী জড়িত থাকার তথ্যপ্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে৷ সিরিয়ার অভ্যন্তরে এই হামলায় ৪২৬ শিশুসহ ১,৪২৯ জন নিহত হয়েছে বলেও দাবি যুক্তরাষ্ট্রের৷
তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবি মানতে রাজি নয় সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া৷ সেদেশের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন রাসায়নিক হামলার পেছনে সিরিয়া সরকার জড়িত থাকার দাবিকে ‘‘সম্পূর্ণ বাজে কথা'' উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তথ্যপ্রমাণ চেয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মার্কিন সহকর্মীরা, যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন সিরিয়ার সরকারি বাহিনী রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে এবং বলছেন তাদের কাছে তথ্যপ্রমাণ আছে - তাদের উচিত সেসব তথ্যপ্রমাণ জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক এবং নিরাপত্তা পরিষদকে প্রদর্শন করা৷''
সিরিয়া যুদ্ধের ঘটনাপঞ্জি
সিরিয়ায় উপর খুব শীঘ্রই সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারে কয়েকটি পশ্চিমা দেশ৷ গত প্রায় আড়াই বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে সেদেশে৷ অথচ এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুদ্ধ এবং বিশৃঙ্খলা
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে এক লাখের মতো মানুষ৷ সম্প্রতি সেদেশে কথিত রাসায়নিক হামলায় কয়েকশত মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ৷ সিরিয়ায় সামরিক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা৷ প্রশ্ন হচ্ছে, সম্ভাব্য হামলা কি সেদেশে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে?
ছবি: Reuters/Goran Tomasevic
শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ
২০১১ সালের মার্চ মাসে সিরিয়ায় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শুরু হয়৷ আরব বসন্তে অনুপ্রাণিত হয়ে সেদেশের বিরোধী দল প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ডাক দেয়৷ দারা এবং দামেস্কে জনগণ রাস্তায় নেমে আসেন৷ তাঁরা সিরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানান, মুক্তির দাবি করেন রাজনৈতিক বন্দিদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রতিবাদকারীদের হটাতে ট্যাংক
এক পর্যায়ে প্রতিবাদকারীদের হটাতে রাস্তায় ট্যাংক নামায় আসাদ প্রশাসন৷ ফলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রতিবাদকারীদের সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ মৃত্যুর মিছিলের সঙ্গে বাড়তে থাকে প্রতিবাদীদের ক্ষোভও৷ ফলে সিরিয়ার উপর নিষিধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ পাশাপাশি সিরিয়া সরকারের বিরোধী বিভিন্ন পক্ষ তুরস্কে একটি জোট গঠন করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পর্যবেক্ষক দল, বিদ্রোহী এবং ইসলামপন্থিরা
জুলাই নাগাদ সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা ১৪০০ ছাড়িয়ে যায়৷ তাসত্ত্বেও রাস্তায় অবস্থান নেয় অসংখ্য মানুষ৷ সেসময় সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য দলত্যাগ করে বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দেন৷ বিদ্রোহী বিভিন্ন মিলিশিয়া দলের সঙ্গে মিলে ২০১১ সালের অক্টোবরে তাঁরা তৈরি করেন ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি৷’ বিদ্রোহীদের সঙ্গে উগ্র ইসলামপন্থী আল-কায়দা গোষ্ঠীর কিছু অনুসারীও আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে৷
ছবি: Reuters
গৃহযুদ্ধ
২০১১ সালের শেষের দিকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের পরিধি বাড়তে থাকে৷ সেবছরের ডিসেম্বরে সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক পাঠায় আরব লিগ৷ কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত হয় না৷ একের পর এক বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে রাজধানী দামেস্ক৷ পর্যবেক্ষকরাও বাধ্য হয়ে সরে যান৷ সরকারি বাহিনী হোমসসহ বিভিন্ন শহরে বিদ্রোহীদের দমনে কঠোর অভিযান শুরু করে৷
ছবি: Salah Al-Ashkar/AFP/Getty Images
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
২০১২ সালের মে মাসে হোমসে সরকারি বাহিনীর হামলায় কয়েকশত বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারান৷ সেসময় প্রথমবারের মতো উদ্যোগী হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ৷ জাতসিংঘের পক্ষ থেকে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বলা হয়, একইসঙ্গে সিরিয়ায় সরকার বাহিনীর নিপীড়নের নিন্দা জানানো হয়৷ আর বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে আসাদকে সতর্ক করে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷
ছবি: Getty Images
বিদ্রোহীদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা
আসাদের অনুগত বাহিনী বিদ্রোহীদের বিভিন্ন আস্তানায় বোমা বর্ষণ করে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন তখন বিদ্রোহীদের সহায়তা করতে শুরু করে৷ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করে দেশ দু’টো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শরণার্থী
২০১২ সালের নভেম্বরে সিরিয়া সরকারের বিরোধীদের নিয়ে গঠিত ‘‘জাতীয় পরিষদ’’-কে সেদেশের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কয়েকটি দেশ৷ তবে উগ্রপন্থী আল-নুসরা গোষ্ঠী এই পরিষদের মধ্যে নেই৷ সিরিয়ার কয়েক মিলিয়ন মানুষ এখন যুদ্ধ থেকে বাঁচতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন অনেক সিরীয়৷
ছবি: picture alliance / dpa
কথিত গ্যাস হামলা
২০১৩ সালের জুনে লেবাননের হিজবুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর কুশিয়ার পুর্নদখল করে সিরিয়ার সেনাবাহিনী৷ আগস্টে কথিত গ্যাস হামলায় ঘুতা শহরে কয়েকশত মানুষ নিহতের খবর প্রকাশ হয়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ মনে করে, এই গ্যাস হামলার জন্য দায়ী বাশার আল-আসাদ৷ আর এ ধরনের হামলা ওবামার ঠিক করে দেওয়া ‘রেড লাইন’-এর লঙ্ঘন৷
ছবি: Reuters
শুধুই ধ্বংস
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামরিক উপায়ে কোনো পক্ষই জিততে পারবে না৷ পশ্চিমাদের হামলার আশঙ্কা সত্ত্বেও ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নন বাশার আল-আসাদ৷ অন্যদিকে, শান্তিপূর্ণ কোনো সমাধানে বিশ্বাসী নয় বিরোধী পক্ষ৷ আন্তর্জাতিক সমাজও তেমন কিছু করতে পারছে না৷ ফলে সিরিয়ায় চলমান সংঘাত থামার আশু কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
বলাবাহুল্য, রাশিয়া এবং চীনের বাধার কারণে সিরিয়ায় সামরিক অভিযান জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন পায়নি৷ পাশাপাশি ব্রিটেনের সংসদেও ভোটাভুটিতে এই অভিযান অনুমোদন পায়নি৷ ফলে সম্ভাব্য সিরিয়া অভিযানে ব্রিটেনকে পাশে পাচ্ছেনা যুক্তরাষ্ট্র৷ শুধু তাই নয়, জার্মানি এবং ক্যানাডাও অভিযানে অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছে৷
শনিবার প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল সিরিয়া ইস্যুতে রাশিয়া এবং চীনের অবস্থানের সমালোচনা করেছেন৷ তাদের কারণে আন্তর্জাতিক সমাজ সম্মিলিতভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না বলে জানান ম্যার্কেল৷ তিনি বলেন, ‘‘জাতিসংঘ, ন্যাটো কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ম্যান্ডেট ছাড়া জার্মানি কোনো সামরিক হস্তক্ষেপে অংশ নিতে পারে না৷''
এদিকে, ব্রিটেন না থাকলেও সিরিয়ায় সামরিক অভিযানে ফ্রান্সকে পাশে পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ আগামী বুধবারের মধ্যেই সিরিয়ায় সামরিক হামলা সম্ভব বলে জানিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদ৷
উল্লেখ্য, ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলে পাঁচটি মার্কিন ‘ডেস্ট্রয়ার' যুদ্ধজাহাজ সিরিয়ায় হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ এসব জাহাজে কয়েকশত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে৷ ভূমধ্যসাগরে ফরাসি যুদ্ধজাহাজও রয়েছে৷ আবু ধাবি এবং জিবুতিতে যুদ্ধবিমানও মজুদ রেখেছে ফ্রান্স৷
তবে শনিবার ওবামার সর্বশেষ বক্তব্য অনুযায়ী, যুদ্ধ এখনই শুরু হচ্ছে না।