1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভুল ক্রীড়াবোধ কেড়ে নিচ্ছে সব

মামুন মোস্তফা
৭ নভেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশে ক্রকেট ছাড়া আর কোনো খেলায় দর্শকদের যেন কোনো আগ্রহ নেই৷ তাই নেই স্পন্সরও৷ এভাবে চললে, কয়েক বছর পর হয়ত বাংলাদেশে একটাই খেলা থাকবে৷ আর বাকিগুলোর? তাদের জায়গা হবে শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায়৷

Fußball in Bangladesch
ছবি: Khandakar Tarek

১.

১৯৮৫-র এশিয়া কাপ হকির ফাইনাল দেখতে কত লোক এসেছিল?

- কত ঠিক বলতে পারব না৷ তবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারি পুরো ভর্তি ছিল মনে আছে৷

হুঁ, আনুমানিক ৫০ হাজার৷ তখন গ্যালারির সেরকমই ধারণ ক্ষমতা ছিল৷

- আচ্ছা৷

আর এবারের ফাইনালের দর্শক কত হবে?

তখনো ফাইনাল শুরু হতে ঘণ্টাখানেক বাকি৷ পরিচিত এক সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে কথোপকথনের এই পর্যায়ে গ্যালারিটা একটু ভালো করে দেখি৷ মনে হয় সব মিলিয়ে হাজারখানেক দর্শক হবে৷ বললাম সংখ্যাটা৷ তিনি মানলেন না৷ তাঁর দাবি, সংখ্যাটা হলো ‘৫০'৷

হ্যাঁ,  ৫০৷ ১৯৮৫-তে ছিল ৫০ হাজার আর এবার ৫০ জন৷

- কীভাবে? এই ভিআইপি গ্যালারিতেই তো শ'পাঁচেক লোক আছে৷

তা আছে, কিন্তু এরা সবাই হকির সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে সম্পৃক্ত৷ কোনো সাব-কমিটির সদস্য বা খেলোয়াড়দের পরিবার-পরিজন৷ শুধু খেলার টানে এসেছে সাধারণ দর্শক – এই যদি হয় বিবেচনা, তাহলে সংখ্যাটা পঞ্চাশের বেশি না৷

ভালো করে তাকালাম৷ সত্যি, যাঁদের দেখছি তাঁরা হকির চেনামুখই৷ এর বাইরে কিছু যে খেলোয়াড় বা কর্তাদের পরিবার-পরিজন সেটা বোঝা যায়৷ বাদ দিয়ে খেলার টানে আসা নিছক দর্শকের সংখ্যা হয়ত ৫০ নয়, কিন্তু এমন কিছু বেশিও নয়৷

ঘটনাটা বলছি এ কারণে যে, একটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট, যেটা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় খেলার একটা মহাদেশীয় আসর, সেটার প্রতি এই হলো দর্শকের আগ্রহ৷ আর এই আগ্রহ বা অনাগ্রহই জানিয়ে দেয় ক্রিকেট বাদ দিলে বাংলাদেশের বাকি খেলাগুলোর কী হাল!

দর্শক দেখে না৷ ফলে আগ্রহ নেই৷ নেই বলে স্পন্সরের আগ্রহ নেই৷ ফলে নেই টাকা-পয়সা৷ তাই ভুগছে এবং ডুবছে৷ এভাবে চললে, কে জানে কয়েক বছর পর হয়ত বাংলাদেশে একটাই খেলা থাকবে – ক্রিকেট৷ আর বাকিগুলোর জায়গা হবে ইতিহাসের পাতায়৷ পরের প্রজন্ম জানবে, বাংলাদেশে একসময় ফুটবল-হকি-টেনিস এ সব খেলাও হতো!

২.

এবার এশিয়া কাপ নিয়ে মিডিয়ার একটা অংশের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ছিল৷ মানুষের মনে টুর্নামেন্টটাকে পৌঁছাতে প্রচার-প্রচারণাও কম হয়নি৷ বাংলাদেশ-পাকিস্তান প্রথম ম্যাচটার পটভূমিতে ১৯৮৫ সালের কীর্তি টেনে রং দেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছিল৷ তাতে একটু কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম৷ মানুষ মাঠমুখী হয় কিনা...৷ প্রথম ম্যাচে হাজার পাঁচেক দর্শক হয়েছিল৷ কিন্তু বাংলাদেশের বড় হারে সেই যে মানুষের বিমুখ হওয়া, সেখান থেকে ভারত-পাকিস্তানের তারকারাও আর তাদের ফেরাতে পারেননি৷ একজন ব্যাখ্যায় বললেন, ‘‘বাংলাদেশ ভালো না করলে মানুষ আসবে কেন? নিজের দল যখন পারে না...৷''

এটা হয়ত একটা কারণ৷ কিন্তু এই কারণ বা মনস্তত্ত্বটাই আসলে তৈরি করছে একটা ঘোর বিভ্রান্তি৷ খেলা মানেই যেন বাংলাদেশ এবং খেলা মানেই সাফল্য৷ দু'টোই ভুল৷ অবশ্যই বাংলাদেশি হিসেবে বাংলাদেশের সাফল্য আমরা আর দশটা ক্ষেত্রের মতো খেলাতেও চাইব, কিন্তু খেলাকে পুরো জাতীয়তাবাদের মোড়কে ঢেকে ফেলাই ভুল৷ ‘‘বাংলাদেশ পারলে খেলা দেখব, নইলে নয়'', ‘‘এই খেলা খেলে বা দেখে কী হবে যাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা নেই'' – এই ভুল ভাবনার ঘোরেই আসলে তলিয়ে যেতে বসেছে দেশের সব খেলা৷ ক্রিকেটের সাফল্য যেখানে গৌরবের ব্যাপার, সেখানে এটাই ব্যবহৃত হচ্ছে অন্য খেলাগুলোকে ডুবিয়ে দিতে৷ সব কিছুতে উদাহরণ ক্রিকেট৷ ক্রিকেট আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারছে, কাজেই অন্যদেরও তাদের মতো পারতে হবে, যেহেতু পারছে না, কাজেই সেগুলো বাদ৷ এভাবে সব বাদ দিয়ে দিয়ে বাকি খেলাগুলোকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের দিকে আর বঞ্চিত হচ্ছি নিখাদ ক্রীড়ানন্দ থেকে৷

জাতীয়তা বা দেশের সাফল্য ক্রীড়া অনুসরণে একটা বিবেচনা হতে পারে, কোনোভাবেই একমাত্র নয়৷ ইংল্যান্ড আন্তর্জাতিক ফুটবলে এমন কিছু সাফল্য পায় না, তাই বলে তাদের মানুষরা ফুটবল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি৷ আজও তাদের ক্লাব ফুটবল প্রতি সপ্তাহে জুগিয়ে চলেছে অনন্ত বিনোদন৷ বাংলাদেশেও তো বিষয়টা এই সেদিনও এরকমই ছিল৷ বছর ত্রিশেক আগের কথা মনে করুন৷ ফুটবল এক নম্বর খেলা, সবাই তাতে মেতে থাকতো৷ কিন্তু ক্রিকেট বা হকি মাঠেও কি মানুষ যেতো না? কিংবা ধরুন টেবিল টেনিস, টেনিস, কুস্তি?

স্মৃতিচারণ করুন, দেখবেন টিটি তারকা কচি, রচি, সাদী, কিসলু; টেনিসের শোভন জামালী, সরদার ইফতেখার; কুস্তির টাইগার জলিল, ব্যাডমিন্টনের ডানা-মরিয়ম এঁদের কথা মনে পড়বে৷ কিন্তু চেষ্টা করেও মনে করতে পারবেন না গত বছরের টেনিসের জাতীয় চ্যাম্পিয়নের নাম৷ কুস্তি এখন কারা খেলে তা কি আপনি জানেন? জানেন না এবং এই নিয়ে কোনো গ্লানিবোধও আপনার নেই৷ মনে করেন, এসব তুচ্ছদের চিনতে হবে কেন? আর এভাবে ওদের তুচ্ছ বানিয়ে, ছোট খেলাগুলোকে ‘ছোটলোকের খেলায়' পরিণত করে কোন স্বর্গে যে যাচ্ছি আমরা, আসলে হয়ে যাচ্ছি একটা ক্রীড়াবিমুখ জাতি৷ খেলার মধ্যে দেশ-রাজনীতি-সাফল্যক্ষুধা ঢুকিয়ে আমরা আসলে সত্যিকারের ক্রীড়াপ্রেমী জাতি একটুও নই৷ আমরা আসলে অদ্ভুত রকমের জাতীয়তাবাদী, যারা আসলে খেলাকে বানিয়ে নিয়েছি দেশপ্রেম দেখানোর মঞ্চ৷ কে জানে হয়ত এটা দেখানো খুব সহজ বলে! অন্য কোনোভাবে দেশপ্রেম প্রকাশ করতে হলে কিছু করতে হয়৷ কিছু ত্যাগ, কিছু পরিশ্রম, কিছু কষ্ট৷ এখানে কিচ্ছু না৷ শুধু লাফালেই হয়৷ আর জটিল অঙ্কের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রীড়াবোধ৷ এবং ক্রীড়া৷

৩.

সেদিনই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ছবিটা৷ জাতীয় জুনিয়র সাঁতার প্রতিযোগিতায় সাঁতারুদের খাবার দেওয়া হচ্ছে৷ লঙ্গরখানার মতো লাইন করে ওরা খাবার নিচ্ছে৷ পাতে শুধু ভাত আর সবজি৷ এক টুকরো মাছ বা মাংস নেই৷ এসব খেলার আয়োজকদের প্রশ্ন করলে তাঁরা বলবেন, মানুষ দেখে না, মিডিয়া কভারেজ দেয় না বলে তাঁরা প্রয়োজনীয় স্পন্সর পান না৷ টাকা-পয়সার অভাব তাই!

কথাগুলো যে ঠিক সেটা আগেই বলেছি৷ কিন্তু সেই অবস্থাটা বদলানোর জন্য কী করেছেন তাঁরা? কোনো লক্ষ্য নেই, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই৷ বাংলাদেশ এমনিতে হুজুগের দেশ বলে যেখানে প্রচার, সেখানেই সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দৌড়াবে স্বাভাবিক, কিন্তু এই বিমুখ মানুষগুলোকে নিজেদের দিকে আনাই তো সংগঠকদের দায়িত্ব৷ এই কাজের জন্যই তো ওরা ওখানে বসে৷ কিন্তু নির্বাচনের সময় কমিটিতে ঢোকার জন্য যে শক্তি ব্যয় করেন, মেয়াদের পুরো সময় খেলার জন্য এর অর্ধেক ব্যয় করলেও অন্তত শাক-ভাত খেয়ে খেলোয়াড়দের খেলতে হতো না৷ আমাদের সামাজিক বাস্তবতা, সাফল্যমুখী হুজুগ সব ঠিক আছে, কিন্তু সেগুলো বদলানোর মতো দূরদর্শী মানুষও নেই এই ছোট খেলাগুলোতে৷ এখানেও রাজনীতি-বাণিজ্য আর দলবাজির ত্রিধারা মিলিত হয়ে সত্যিকারের সংগঠকদের গলা টিপে রাখছে৷

সংগঠক বলতে যাঁদের আমরা বুঝতাম, যাঁরা জীবন-যৌবন সঁপে দিতেন খেলা আর খেলোয়াড় তৈরির জন্য, তাঁরা আজ হারিয়ে যাওয়া প্রজাতি৷ এখন নির্বাচনের মাধ্যমে জিতে আসেন দুটো পক্ষ৷ একটা দল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট, আরেকটা হচ্ছে হালের টাকাওয়ালা মানুষ৷ এই দুটো হাত ধরাধরি করে এমন একটা শক্তির বলয় তৈরি করেছে যে, সত্যিকারের সংগঠকরা জেনে গেছেন তাঁদের পক্ষে কোনো ফেডারেশনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব নয়৷ তাঁরা হাত গুটিয়ে নিয়েছেন৷ তরুণ সংগঠকরাও এই অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে চলে যাচ্ছেন অন্য লাইনে৷ তাই তৃণমূলে খেলা আয়োজন, খেলোয়াড় তৈরি– এসবের লাইনটাই হারিয়ে গেছে৷ ছোট খেলা খেলেও যে বড় হওয়া যায় সেই স্বপ্ন দেখানোর মানুষই আর নেই৷ তবু যে এই খেলাগুলো কিছু কিছু খেলোয়াড় খেলে তাই দেখে মাঝেমধ্যে বিস্ময় লাগে! এসবের ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে৷ এসএ গেমস পর্যায়ে যা ছিলাম, তার চেয়ে আরো পিছিয়ে যাচ্ছি৷ শ্যুটিং, আর্চারি, সাঁতার এ সব জায়গায় বিচ্ছিন্ন দু-একটি সাফল্য হয়তো আসে, কিন্তু সামগ্রিক অর্থে বলার মতো কিছু না৷ ফুটবলের মতো খেলা মানুষের মন থেকে হারিয়ে গিয়ে এখন লড়াই হয় আক্ষরিক অর্থেই ফাঁকা মাঠে; পৃথিবীর কোথাও বোধ হয় এতটা নিরাসক্তির মধ্য দিয়ে লিগ আয়োজিত হয় না৷ সেই লিগে আবার যখন-তখন বিরতি৷ এসবের কারণে জাতীয় দলের ফলও যাচ্ছেতাই৷ তবে ঘোর অন্ধকারে এটাই আশার কথা যে, যুব ফুটবলে বেশ কিছু ভালো পারফরম্যান্স দেখা গেছে সম্প্রতি৷ অনূর্ধ্ব-১৬ এবং অনূর্ধ্ব-১৮ কয়েকটি প্রতিযোগিতায় দেখিয়েছে, সম্ভাবনা তাদের মধ্যে আছে৷ তাই দেখে কেউ কেউ নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেন৷ কিন্তু খুব একটা আশাবাদী হতে পারি না৷ কারণ, এর পরে ওদের বিকাশের যে সময় সেই সময়টা কাটবে খুব অযত্নে৷ ওরা চলে যাবে ক্লাবে, বাংলাদেশের সেই ক্লাবগুলোতে, যেখানে খেলোয়াড় তৈরির চেয়ে ধ্বংসের পরিবেশই বেশি৷ আশা নেই কোথাও৷ হতাশার অন্ধকারই চারদিকে৷

সাংবাদিক মোস্তফা মামুনছবি: MIRFARID

৪.

ছবি বদলানোর উপায়? খুব সম্ভব ক্রীড়াবোধ থেকে উগ্র সাফল্যের ক্ষুধা ছেঁটে ফেলা৷ এই খেলা খেললে আন্তর্জাতিক সাফল্য পাওয়া যাবে না, কাজেই এটা খেলার দরকার নেই – এই তত্ত্ব বাদ দিলেই সব বদলে যাবে৷ তখন ছোট্ট একটা বাচ্চা মনের আনন্দে টেবিল টেনিস খেলতে চাইলে কেউ বলবে না, এই খেলা খেলে লাভ কী! লাভ-ক্ষতির অঙ্ক না ভেবে সে মেতে থাকবে ক্রীড়ানন্দে৷ সেই আনন্দ হয়তো সঞ্চার হবে আরো অনেকের মধ্যে৷ কেউ আবার খেলবে ভলিবল৷ কেউ হকি৷ এটাই ক্রীড়াচর্চার নিয়ম৷ এভাবেই খেলা বেঁচে থাকে আনন্দের অফুরন্ত ঝরনা হয়ে৷

আর লাভ-ক্ষতি, সাফল্য-আন্তর্জাতিক খ্যাতি – এই অঙ্ক নিয়ে পড়ে থাকলে সবাই ক্রিকেটই খেলতে চাইবে৷ সেখানেই সব স্পন্সররা দৌড়াবে৷ এই ক্রিকেটীয় লড়াইয়ে কেউ কেউ শীর্ষে পৌঁছাবে৷ সাফল্য আনবে৷ আর বাকিরা পরাজিত হয়ে, নিজেদের ব্যর্থ মেনে পালিয়ে যাবে খেলার জগৎ থেকে৷ এবং তখন এ দেশের ভবিষ্যৎ মানুষরা ইতিহাস বইয়ে পড়বে, ‘‘একসময় বাংলাদেশে ফুটবল-হকি এসব খেলাও হতো!''

লেখাটি কেমন লাগলো বন্ধু? জানান নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ