অমর একুশে গ্রন্থমেলা সাধারণভাবে প্রকাশকদের প্রথাগত বইমেলা নয়৷ এই বইমেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদদের স্মৃতি৷ এর সঙ্গে মিশে আছে বঙালির চেতনা, মাতৃভাষার জন্য আবেগ-ভালোবাসা৷
বিজ্ঞাপন
বইমেলা একাকার হয়ে যায় এই দিনটিতে৷ বাঙালির সাহস, ভালোবাসা এবং প্রতিবাদের প্রতীক এই বইমেলা৷ একুশের ইতিহাস তাই আজও শাসন জুগিয়ে চলেছে লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের৷ জোর করে তাঁদের মুখ বন্ধ করা যায়নি৷
জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফির দীপনকে জঙ্গিরা হত্যা করে ২০১৫ সালের ৩১শে অক্টোবর৷ অপরাধ, ব্লগার ও লেখক ড. অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করতেন তিনি৷ প্রকাশ করতেন মুক্তমনাদের বই৷ কিন্তু তাঁকে হত্যা করেও থামানো যায়নি তাঁর প্রকাশনাকে৷ থামানো যায়নি মুক্তমনাদের বই প্রকাশকেও৷
বর্তমানে সেই প্রকাশনা সংস্থার হাল ধরেছেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলি৷ একুশে বইমেলায় জলির হাত ধরে জাগৃতি প্রকাশনীর বড় স্টল হয়েছে এবার৷ তবে গতবছরও জগৃতির স্টল বাদ পড়েনি৷ দীপন হত্যার তিন মাসের মাথায় বইমেলা হলেও শোক কাটিয়ে দীপনের প্রকাশনা সংস্থার স্টল দিয়েছিলেন স্ত্রী জলি৷
রাজিয়া রহমান জলি
জলি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি চেষ্টা করছি দীপনের কাজকে এগিয়ে নিতে৷ ব্যক্তি দীপনকে হত্যা করা যায়৷ কিন্তু তাঁর কাজ বা বিশ্বাসকে হত্যা করা যায় না৷ আমরা এখনো মুক্তমনা এবং নতুন লেখকেদের বই প্রকাশ করছি৷ এবারো অনেক নতুন বই নিয়ে এসছে বইমেলায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘একুশ যেমন আমাদের একটি শক্তি, তেমনি একুশের বইমেলাও আমাদের শক্তি৷ এই মেলা আমাদের সব ভয় আর শঙ্কা দূর করে দেয়৷''
অমর অকুশের দিনের বইমেলার দিনটি সব সময়ই আলাদা৷ এদিন সকাল আটটা থেকে মেলার গেট খুলে যায়৷ আর শহিদ মিনারের পথ গিয়ে মেশে বইমেলায়৷
মেলার দোকান খোলার পর থেকেই বইপ্রেমী আর ভাষাপ্রেমীরা ভিড় জমান স্টলে৷ মেলায় সকালে সপরিবারে আসেন হাসানুল কাদির৷ তিনি বলেন, ‘‘গত ২০ দিন ধরে বইমেলা চললেও আসিনি৷ তবে আজ সকালে শহিদ মিনারে ফুল দিয়েই সরাসরি বইমেলায় চলে এসছি৷ পছন্দের বই কিনবো৷ সন্তানদের কিনে দেবো৷ ইচ্ছা আছে সারাদিন কাটাবো বইমেলা এবং সংলগ্ন এলাকায়৷'' তিনি বলেন, ‘‘মেলার পরিসর বেড়েছে, নিরাপত্তা ব্যবস্থাও সন্তোষজক৷''
এবারের বইমেলার শুরু হওয়ার আগেই দু'টি বিষয় নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়৷ ব-দ্বীপ প্রকাশনের মালিকের মুক্তি দাবি করায় রবিন আহসানের শ্রাবণ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ না দেয়ার সিদ্ধান্ত এবং বইয়ের ওপর পুলিশের নজরদারির ঘটনা ঘটে৷ প্রতিবাদেও মুখে শ্রাবণ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়৷ কিন্তু পুলিশের নজরদারি অব্যাহত থাকে৷ পুলিশ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘত লাগে এমন বই খুঁজছে মেলায়৷ তবে দু'দিন আগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত আমরা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কোনো আপত্তিকর বই পাইনি৷''
বইমেলায় এবার চার হজারেরও বেশি নতুন বই প্রকাশের আশা করছেন লেখক-প্রকাশকরা৷ গত বছর নতুন বই প্রকাম হয়েছে সাড়ে তিন হাজার৷ বই বিক্রি হয়েছে ৪০ কোটি টাকারও বেশি৷ এবার যা পরিবেশ, তাতে বই বিক্রি বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে৷
শাকুর মজিদ
লেখক শাকুর মজিদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবারের বইমেলার সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো নতুন লেখকদের, তরুণ লেখকদের বই বেশি আসছে৷ এর থেকে যদি শতকরা ১০ ভাগও লেখক হিসেবে শেষ পর্যন্ত টিকে যান, তবে তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যেও জন্য অনেক কাজের হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এবার বইমেলার পরিবেশ ভালো, স্টল বেশি, নতুন বইও বেশি৷ শুরুতে পুলিশের নজরদারি বিতর্কে ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল৷ তবে তা কেটে গেছে৷ আমি মনে করি ইচ্ছে করেই একটি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হয়েছিল৷''
প্রসঙ্গত, এবারের বইমেলায় প্রায় সাতশ' স্টল আর প্রকাশনা সংস্থা চারশ'রও বেশি৷
অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ সৃজনশীল বই প্রকাশ হয়৷ আর এই বইমেলা একুশের চেতনা থেকে উৎসারিত৷ একুশের আত্মত্যাগের কারণে আজ আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষা৷ ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস৷ তারপরও বাংলা তার কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি আজও৷ তাই তো একুশের সকালে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে শহিদ মিনারে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়, স্বীকার করতে হয় ব্যর্থতা৷
তিনি মঙ্গলবার সকালে শহিদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণের পর বলেন, ‘‘সরকারি অধিদপ্তরগুলোয় বাংলা চালু হলেও আদালতে সেটা বাস্তবায়ন করা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি৷ এ জন্য আমরা খুবই দুঃখিত৷ অবশ্য হাইকোর্ট বিভাগের কয়েকজন বিচারক খুব সুন্দরভাবে বাংলায় রায় লিখছেন৷ এটা অন্যদের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে৷ আপিল বিভাগেও আমরা এটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি৷ প্রযুক্তির এই যুগে যদি কোনো ডিভাইস আসে, যার মাধ্যমে আদালতে ঘোষণা করা রায় বাংলায় রূপান্তর হয়ে যাবে, তাহলে অনায়াসে বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব৷''
ঢাকার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যান প্রাঙ্গণে চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা৷ পয়লা ফেব্রুয়ারি এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ ছবিঘরে উঠে এসেছে মেলার জানা অজানা নানা কথা৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘মুক্তধারা’-র স্টল৷ নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গঠনের পরের বছরই চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরেই শুরু হয়েছিল একুশে গ্রন্থমেলার৷ দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়সের সমান তাই গ্রন্থমেলার বয়সও৷
ছবি: DW/M. Mamun
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
এ বছর একুশে গ্রন্থমেলার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ ভালো৷ প্রতিটি প্রবেশপথেই দর্শণার্থীদের তল্লাশি করেন পুলিশ সদস্যরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রবেশ পথ
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বেশ কয়েকটি প্রবেশপথ থাকায় এ বছর মেলার প্রবেশ পথে আগের বছরগুলোর তুলনায় দর্শকদের দীর্ঘ সারি কম ছিল৷
ছবি: DW/M. Mamun
সব্যসাচী লেখকের অনুপস্থিতি
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চারুলিপি প্রকাশনের স্টলে কবি সৈয়দ শামসুল হকের ছবি৷ এ বছর থেকে আর কখনো একুশের গ্রন্থমেলায় পাঠকরা দেখতে পাবেন না সব্যসাচী এই লেখককে৷ ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
না থেকেও আছেন হুমায়ূন
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে হুমায়ূন আহমেদের ছবি৷ গত পাঁচ বছর ধরে মেলায় তাঁর উপস্থিত না থকালেও পাঠকদের কাছে তিনি আজও সমান সমাদৃত৷
ছবি: DW/M. Mamun
জাগৃতি প্রকাশনী
ফয়সাল আরেফিন দীপনের জাগৃতি প্রকাশনীতে তাঁর স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলি৷ দীপন চলে যাওয়ার পর প্রকাশনীটির হাল ধরেছেন তিনি৷ এ বছর জাগৃতি প্রকশনী থেকে তিনি প্রকাশ করেছেন ৫২টি নতুন বই৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রতিদিন নতুন বই
প্রতিদিনই মেলায় আসছে নতুন নতুন বই৷ বাংলা একাডেমির তথ্যমতে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেলায় আসা নতুন বইয়ের সংখ্যা ২,৭৪৫৷
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় সেলফি তুলছেন মাদ্রাসার দুই শিক্ষার্থী৷
ছবি: DW/M. Mamun
ছুটির দিনে উপচে পড়া ভিড়
ছুটির দিনগুলোতে গ্রন্থমেলায় দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়৷ সাধারণ দিনগুলোতে মেলার দুয়ার বিকেল ৩টায় খোলা হলেও শুক্র ও শনিবারে মেলা শুরু হয় বেলা ১১টা থেকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়ন
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্থায়ী বিক্রয় কেন্দ্র ছাড়াও মেলার দু’টি চত্ত্বরে আরো দশটি প্যাভিলিয়ন ও স্টল থেকে পাঠকরা কিনতে পারবেন বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই৷
ছবি: DW/M. Mamun
নতুন বইয়ের স্টল
এবারের মেলায় নতুন বইয়ের একটি স্টল চালু করেছে বাংলা একাডেমি৷ মেলায় প্রকাশ হওয়া প্রতিদিনের নতুন সব বই একই জায়গায় চোখ বোলানোর সুযোগ পাচ্ছেন পাঠকরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের স্টল
দিনাজপুরের কান্তনগর মন্দিরের আদলে তৈরি এ স্টলটি নজর কেড়েছে সবার৷
ছবি: DW/M. Mamun
গ্রন্থমেলার পরিসর
সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে গ্রন্থমেলার একটি প্যাভিলিয়ন৷ এবারের গ্রন্থমেলায় একাডেমি চত্বরে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ১১৪টি ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ৩২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৪৯টি ইউনিটসহ মোট ৪০৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৬৩টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
একাডেমির প্যাভিলিয়ন রয়েছে দু’টি
এর বাইরে বাংলা একাডেমিসহ ১৪টি প্রকাশনা সংস্থাকে মোট ৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের ১৫টি প্যাভিলিয়ন দেয়া হয়েছে৷ এরমধ্যে একাডেমির প্যাভিলিয়ন রয়েছে দু’টি৷
ছবি: DW/M. Mamun
শিশু প্রহর
প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে ১.৩০ মিনিট শিশু প্রহর৷ মেলার এ সময়টি শুধুই শিশুদের জন্য৷
ছবি: DW/M. Mamun
জনপ্রিয় লেখক
অমর একুশে গ্রন্থমেলার সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে লেখক জাফর ইকবালকে ঘিরে ভক্তরা৷ অটোগ্রাফ নেয়ার পাশাপাশি ভক্তরা লেখকের সঙ্গে সেলফি তোলার সুযোগও হাতছাড়া করছেন না৷
বাংলা একাডেমির মঞ্চে মেলার প্রতিদিনই থাকছে আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সমকালীন প্রসঙ্গ এবং বিশিষ্ট বাঙালি মনীষার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ফুড কোর্ট
এবারের মেলায় বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বসেছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ফুড কোর্ট৷ ফলে মেলায় আগত দর্শনার্থীরা ভালো মানের খাবার পাচ্ছেন৷