বাংলাভাষার সংকট
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ শীতার্ত মানুষের যেমন প্রয়োজন হয় অগ্নিকুণ্ডের, সংকটাপন্ন মুক্তিকামী বাঙালিরও তেমনি প্রয়োজন হয় একুশে ফেব্রুয়ারির কাছে যাওয়ার৷ ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে এসেছিল বাঙালির স্বাধীনতা৷ স্বাধীন হওয়ার পরও বাঙালির জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রয়োজন একটুকু ম্লান হয়ে যায়নি৷ প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি বিজয়ে বাঙালি বারবার ছুটে যায় একুশের শহীদ মিনারে৷ উত্তাপ গ্রহণ করে উজ্জীবনের, উজ্জীবিত হওয়ার৷
একুশে ফেব্রুয়ারি কি শুধুই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রাম ছিল? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়৷ সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্ত রাজনৈতিক চেতনায় সৃষ্ট যে রাষ্ট্র পূর্ব বঙ্গের বাঙালিরা পেয়েছিল – সে রাষ্ট্রের প্রগতিবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র স্পষ্ট হতে সময় লাগেনি৷ সামন্তবাদী ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য আক্রমণটা প্রথমে আসে বাংলাভাষার ওপরে৷ এটা ছিল হিসাবকষা আক্রমণ৷
নতুন পাওয়া রাষ্ট্রে শিক্ষাদীক্ষায় পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন প্রত্যাশা করেছিল৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের ভাষা বাংলা৷ তাই তাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা৷ বাংলা হবে উচ্চশিক্ষার বাহন৷ অফিস-আদালতে চলবে বাংলা৷
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশের রাজার মতো পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী সামন্তশ্রেণিও মনে করত, যারা যত বেশি জানে, তারা তত কম মানে৷ পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠলে তাদের আসন টলে উঠবে এই আশংকায় তারা প্রথমেই বাংলাভাষাকে আঘাত করলো৷
বাংলাভাষাকে রক্ষার সরাসরি সংগ্রাম প্রথম শুরু হয় ১৯৪৮ সালে৷ প্রাথমিক ধাক্কা খাওয়ার পর প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী এবং তাদের দোসররা এরপর শুরু করে বাংলাভাষাকে বিশৃঙ্খল করে তাকে দুর্বল করে ফেলার প্রয়াস৷ একদিকে শুরু হয় আরবি হরফে বাংলা লেখার অপচেষ্টা৷ অন্যদিকে, একদল লেখক বাংলাভাষা থেকে তথাকথিত বিধর্মী সংস্কৃত শব্দকে বিতাড়ন করে তার বদলে আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ দিয়ে তৈরি মুসলমানি বাংলা নামে এক অদ্ভুত খিচুড়ি ভাষা নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিল – যা এককালে প্রচলিত ছিল বটতলার পুঁথিতে৷ বলাবাহুল্য, এসব কিছুই ছিল পুঁজিবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের শোষণ ব্যবস্থার অপকৌশল৷ তারা চেয়েছিল বাংলাভাষা যেন কিছুতেই জ্ঞান বিজ্ঞানচর্চার যোগ্য বাহন হয়ে উঠতে না পারে৷
এর প্রতিবাদ হিসেবেই এলো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি৷ অমর একুশের শহীদদের রক্তদানে বাংলাভাষাই যে কেবল সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত হলো তা নয়, পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ হয়ে উঠতে শুরু করল আধুনিক, প্রগতিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক৷ পূর্ববঙ্গের বাঙালির চিন্তাজগতে লাগল হঠাৎ আলোর ঝলকানি৷ বাঙালি হয়ে উঠল প্রতিবাদী৷ এই প্রতিবাদ, আন্দোলন, সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি পেলো স্বাধীনতা – স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ – যে প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা৷
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর প্রত্যাশা করা হয়েছিল জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে, উচ্চশিক্ষায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষায় বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করে সাধারণ মানুষের জন্য উচ্চতর শিক্ষা সহজ ও বোধগম্য করে তোলা হবে৷ এ চেষ্টা শুরু করাও হয়৷ তবে প্রতিবন্ধকতা ছিল অনেক৷ অফিস আদালতে বাংলা প্রচলনের ধীরগতিতে বিরক্ত বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১২ই মার্চে জারি করা এক পরিপত্রে লেখেন, ‘‘মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই, দেশের প্রতি যে তার ভালবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়৷''
বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণের পরে ঘটে বাংলাদেশের রাজনীতির পট পরিবর্তন৷ পরিবর্তন শুধু রাজনীতিতে নয়, সর্বত্রই ঘটে৷ স্বাধীনতার পরে যে নব্য ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠতে থাকে হঠাৎ তারা অস্বাভাবিক দ্রুততায় অগ্রসর ও একত্র হতে শুরু করে৷ এর পরে তাতে যুক্ত হয় নতুন এক মাত্রা – তার নাম বিশ্বায়ন৷ এর মাধ্যমে এককালের প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী সামন্তবাদ রূপান্তরিত হয় আধুনিকতার খোলসে মোড়া দুর্ধর্ষ বেনিয়া পুঁজিবাদে৷ শুধু পুঁজিবাজার নয়, এরা দখল করতে শুরু করে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ক্ষেত্রগুলো৷ এরা তৈরি করতে শুরু করে তাদের কাজে আসবে এমন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর তাদের কাজে লাগবে এমন সব রেডিয়ো ও টেলিভিশন চ্যানেল৷
এদের গড়ে তোলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাভাষা ব্রাত্য৷ এদের তৈরি প্রচারমাধ্যমে বাংলাভাষা বিকৃত৷ এরা একুশে ফেব্রুয়ারি বললেও পরের দিনটাকে বলে বাইশ ফেব্রুয়ারি৷ এরা বড় বেশি আন্তর্জাতিক৷ এদের প্রচারমাধ্যমের একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শহীদ দিবস নয়, শুধুই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস৷ এদের প্রচারমাধ্যমের উপস্থাপক ও নাটকের চরিত্রের মুখে যুগপৎ ইংরেজি আর আঞ্চলিক বাংলার খই ফোটে৷ জ্ঞানচর্চার বাহন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাংলাভাষার যে রীতিটাকে আমাদের প্রাজ্ঞজনেরা প্রমিত ভাষা নাম দিয়েছিলেন, ইদানিং দেখা যাচ্ছে অনেক তথাকথিত জনপ্রিয় লেখক তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন৷ এঁদের মতে প্রমিত ভাষা কৃত্রিম তাই তাঁরা লিখতে চান তাঁদের প্রিয় বর্তমান তরুন প্রজন্ম আর নিম্নবর্গের মানুষের ভাষায়৷ এঁদের কাছে বাংলা শুধুই মনের ভাবপ্রকাশের ভাষা অর্থাৎ নাটক, উপন্যাস আর কবিতা লেখার ভাষা, জ্ঞানচর্চার ভাষা নয়৷
বাংলাভাষা যেন শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার বাহন হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট সুশৃঙ্খল, দৃঢ় ও শক্তিশালী না হয়ে উঠতে পারে সেজন্য একদা পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বাংলাভাষাকে অযথা আরবি, ফারসি আর উর্দুতে ভরিয়ে দিয়েছিল৷ সেই প্রতিক্রিয়াশীলতা আধুনিকতার লেবাসে পুনরায় যেন ফিরে আসছে৷ এরা চায় না নিম্নবর্গের মানুষ উপরে উঠে আসুক৷ বিশুদ্ধ ভাষার শক্তিকে এদের বড় ভয়৷ তাই তাঁরা মুখের ভাষার নামে বাংলাভাষাকে বিশৃঙ্খল করে দিতে চায় সচেতনভাবে৷
বাংলাভাষার এই পরিকল্পিত বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টির প্রয়াস দেখে প্রবীণ ভাষাতত্ত্ববিদ ও শিক্ষাবিদ রফিকুল ইসলাম বলতে বাধ্য হয়েছেন, এখন আর ‘আ মরি বাংলাভাষা' নয়, এখন চলছে ‘আয় মারি বাংলাভাষা'৷ অন্যদিকে নবীন শিক্ষাবিদ ও গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন, বাংলাভাষার এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষতে আরেকবার ভাষা আন্দোলন অপরিহার্য হয়ে উঠবে৷
প্রতিবেদন: ফরহাদ খান
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন